৪৮% করোনা রোগীর এলাকাভিত্তিক তথ্য নেই

>দেশে করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭৭ জনের। জেলা বা এলাকাভিত্তিক তথ্য রয়েছে ৮০ হাজার ২৯৯ জনের।

দেশে এখন পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া মোট করোনা রোগীর ৪৮ শতাংশেরই এলাকাভিত্তিক তথ্য নেই। সরকার জেলাভিত্তিক রোগীর যে তথ্য দিচ্ছে, তা মোট রোগীর চেয়ে ৭২ হাজার ৯৭৮ জন কম। এমন পরিস্থিতিতে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে করোনা সংক্রমণের প্রায় চার মাস হতে চললেও এ ধরনের তথ্যবিভ্রাট অনভিপ্রেত। এ কারণে সংক্রমণের প্রকৃত চিত্র বোঝা যাচ্ছে না। 

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) ওয়েবসাইটে দৈনিক জেলাভিত্তিক করোনা শনাক্তের তথ্য দেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও করোনা রোগীদের জেলাভিত্তিক তথ্য থাকে। কিন্তু এই দুই ওয়েবসাইটের জেলাভিত্তিক তথ্যে বিস্তর ফারাক রয়েছে। এই তথ্য বিভ্রাটের জন্য সরকারের দুই প্রতিষ্ঠান একে অপরকে দায়ী করছে। 

আইইডিসিআর বলছে, বর্তমানে জেলাভিত্তিক রোগী শনাক্তের তথ্য প্রস্তুত করছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম (এমআইএস) বিভাগ। এমআইএসের দেওয়া তথ্যই তারা ওয়েবসাইটে তুলছেন। আর এমআইএস বিভাগ বলছে, জেলাভিত্তিক শনাক্ত রোগীর তালিকা তৈরির কাজটি করছে আইইডিসিআর। 

সরকারি কাজে যে সমন্বয় নেই, এই তথ্যবিভ্রাট তার বড় প্রমাণ বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির শুরু থেকেই তথ্য নিয়ে জগাখিচুড়ির মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে। দায়বদ্ধতা না থাকায় এই কাজটুকুও হচ্ছে না। 

দেশে গতকাল পর্যন্ত করোনা শনাক্ত হয়েছে ১ লাখ ৫৩ হাজার ২৭৭ জনের। আইইডিসিআরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গতকাল পর্যন্ত জেলাভিত্তিক তথ্য রয়েছে ৮০ হাজার ২৯৯ জনের। জেলা বা এলাকাভিত্তিক তথ্য নেই ৭২ হাজার ৯৭৮ জনের। 

আইইডিসিআরের পরিচালক অধ্যাপক মীরজাদী সেব্রিনা বলেন, আগে পরীক্ষাকেন্দ্রগুলো থেকে তথ্য নিয়ে জেলাভিত্তিক তথ্য হালনাগাদ করা হতো। এখন জেলা থেকে শনাক্ত রোগীর তথ্য পাঠানোর পর সেটি হালনাগাদ করা হয়। কয়েকটা জেলা থেকে তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। তিনি বলেন, করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা দেওয়ার আগে একটি ফরম পূরণ করতে হয়। সেই ফরম পূরণের সময় অনেকে শুধু ফোন নম্বর ও নমুনা কেন্দ্রের নাম উল্লেখ করেন। অন্য তথ্য ঠিকমতো দেন না। যে কারণে রোগী কোন এলাকার, সেটি চিহ্নিত করা কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটেও জেলাভিত্তিক করোনা রোগীদের তথ্য দেওয়া হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জেলাভিত্তিক তথ্যের সঙ্গে মোট রোগীর পার্থক্য আরও বেশি। গতকাল বিকেল পাঁচটায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুযায়ী, খুলনা জেলায় শনাক্ত রোগী ৮০০। একই সময়ে আইইডিসিআরের ওয়েবসাইট বলছে, খুলনায় করোনা শনাক্ত রোগী ১ হাজার ৭৮৬ জন। প্রতিটি জেলার ক্ষেত্রেই আইইডিসিআর ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যে এমন ফারাক রয়েছে। 

আইইডিসিআর ঢাকা মহানগরীর ২২২টি এলাকার নাম এবং এলাকাভিত্তিক শনাক্ত রোগীর সংখ্যাও প্রকাশ করছে। প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা মহানগরীতে শনাক্ত রোগীর তথ্য সর্বশেষ হালনাগাদ করেছে ২৭ জুন। আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে মিরপুর ১, ২, ১০, ১৩ নম্বর এলাকায় শনাক্ত রোগীর সংখ্যা আলাদাভাবে উল্লেখ রয়েছে। আবার শুধু ‘মিরপুর’ এলাকায় ১ হাজার ৪২৭ জন রোগী শনাক্ত বলে উল্লেখ আছে। এটি মিরপুরের কোন এলাকা তা আলাদা করা নেই। উত্তরার ক্ষেত্রেও তাই। উত্তরায় ৭০৭ জন শনাক্ত বলা হলেও কোন সেক্টরে কত রোগী, তা ভাগ করা নেই। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআর সূত্র বলছে, রোগীর নমুনা সংগ্রহের ফরম পূরণ করার সময় পুরো ঠিকানা লেখা থাকে না। ফরম সঠিকভাবে পূরণ করা হলে এই জটিলতা হতো না। এ ছাড়া নমুনা সংগ্রহকারীদের গাফিলতি থাকে। নমুনা সংগ্রহকারীদের অনলাইনে প্রশিক্ষণ দিয়েছিল আইইডিসিআর। প্রশিক্ষণে সোয়াপ স্টিকে শ্লেষ্মা বা লালা সংগ্রহের বিষয়টি যতটা গুরুত্ব পেয়েছে, ফরম পূরণের বিষয়টি ততটা গুরুত্ব পায়নি। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস বিভাগের পরিচালক হাবিবুর রহমান বলেন, মোট রোগীর সঙ্গে জেলাভিত্তিক রোগীর তথ্যে এত ব্যবধান কেন, তা আইইডিসিআর বলতে পারবে। প্রতিদিন জেলা থেকে পাঠানো তথ্যের ভিত্তিতে তারা এটি প্রস্তুত করেন। আর ফরম পূরণের সময় পুরো ঠিকানা লেখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। 

জেলাভিত্তিক তথ্যের এই সীমাবদ্ধতা প্রভাব ফেলেছে করোনা প্রতিরোধ কর্মকাণ্ডে। সংক্রমণ বিবেচনায় লাল, হলুদ ও সবুজ এলাকা চিহ্নিত করছে সরকার। লাল অঞ্চলের ছোট এলাকা লকডাউন করা হচ্ছে। এই লকডাউন পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা এলাকার সঠিক তথ্য পাচ্ছেন না। তাই সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে। 

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি জেলাভিত্তিক তথ্যে গরমিলের বিষয়টি প্রায় দেড় মাস আগে ধরতে পারে এবং বিষয়টি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে জানায়। কিন্তু সমস্যার সমাধান হয়নি। অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য আবু জামিল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ভুল এক-দুই দিন হতে পারে, চার মাস হয়ে যাওয়ার পরেও কেন ভুল থাকবে। যাঁরা কাজ করছেন, তাঁরা সমস্যাটা সমাধান করছেন না। এটি লজ্জাজনক।