'পানিত কষ্ট করিচ্চি, হামাকেরে কেউ অ্যাকনা খোঁজ লিচ্চে না'

যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দুর্গম চরে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ চরমে। বসতঘর জলমগ্ন হয়ে পড়ায় চরের বাসিন্দারা নৌকায় রাত কাটাচ্ছেন। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে জলমগ্ন বসতঘর থেকে ছাগল কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন চরের এক নারী। গত বুধবার দলিকার চরে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দুর্গম চরে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ চরমে। বসতঘর জলমগ্ন হয়ে পড়ায় চরের বাসিন্দারা নৌকায় রাত কাটাচ্ছেন। নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে জলমগ্ন বসতঘর থেকে ছাগল কোলে নিয়ে বেরিয়ে আসছেন চরের এক নারী। গত বুধবার দলিকার চরে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

‘দশ দিন থ্যাকে জলবন্দী জীবন। বুকসমান পানিত খুব কষ্ট করিচ্চি। লৌকাত সংসার। অ্যাকনা চাল আচলো, সেকনা কয়দিন ফুটে খাচি। বিয়ানবেলা আজ অ্যাকনা আনলা পান্তা ভাত খাচি, বিকাল গড়ায়ে যাচ্চে প্যাটত ভাত জোটেনি। খাওয়ার অ্যাকনা পানিও নাই। সগলি বানের পানি খাচ্চি। চরত কেউ অ্যাকনা হামাকেরে খোঁজ লিবার আসিচ্চে না, ইলিপও দিচ্চে না।’

আক্ষেপের এই কথাগুলো বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার যমুনা নদীর দুর্গম দলিকার চরের আলেফা বেওয়ার। গতকাল বৃহস্পতিবার যমুনার ঢলে প্লাবিত চরের লোকালয়ে ভেলায় ঘটিবাটিসহ বসে ছিলেন নাতনি রহিমাকে নিয়ে ত্রাণের আশায়। দলিকার চরের প্রায় ৩০০ পরিবার দুই দিন ধরে পানিবন্দী। আজ শুক্রবার পর্যন্ত সেখানে কোনো ত্রাণসহায়তা পৌঁছায়নি।

চরের বাসিন্দা রহমত উল্লাহ বলেন, ‘আট বিঘা জমিনত পাট আচলো। সব বানের ঢলের নিচে। ঘরত এখন খাবার নাই। ইলিপও নাই।’ চরের বাসিন্দা লাল মিয়া বলেন, ‘লদিত (নদীতে) মাছ ধরে হামাকেরে জীবন চলে। এখন লদি ভরা। ভরা লদিত জাল ফেলাপার পারি না।’ রূপবান বিবি বলেন, ‘ক্যা বারে হামাগরক অ্যাকনা ইলিপ দিবিন না? হামার অ্যাকনা নামটা লেকেন তো।’

দলিকার চর ঘুরে দেখা গেছে, বসতবাড়ি বুকসমান পানিতে তলিয়ে গেছে। মানুষজন গরু-ছাগল, ঘটিবাটি নিয়ে নৌকায় আশ্রয় নিয়েছেন। দশ দিন ধরে নৌকাতেই বসবাস তাঁদের। সেখানে খাদ্য ও খাওয়ার পানির সংকট রয়েছে। জেলে আকালু মিয়া বলেন, ‘বানের ঢলত সব শ্যাষ। ঘরত এক বকি পানি। লিজেকেরেই থাকার কষ্ট। গরু-ছাগল এক সাথে লৌকাত রাত কাটাচ্চি।’

কলার ভেলায় আলোক চুলা ফেলে আটা দিয়ে তেলপিঠা তৈরি করছিলেন সাজেদা বিবি। নৌকায় বসে ছোট দুই শিশুকন্যা আরজিনা আর নারজিনা। সাজেদা বলেন, ‘ঘরত দশ কেজি চাল আচলো। দশ দিন ধরে খ্যাচি। এখন ঘরত চাল নাই। এক কেজি গমের আটা আচলো। সেকনা দিয়ে ছলগুলাক পিটা ভাজে দিচ্চি।’

হাতে নোটখাতা-কলম দেখে কলার ভেলা ঠেলে বসতবাড়ির আঙিনা থেকে এগিয়ে আসেন গৃহবধূ গোলাপি বেগম। বলেন, ‘ঘরত চাল নাই। অ্যাকনা শুকনা চিড়া লিয়ে আচলো, বিয়ানবেলা সেকনা খায়্যা দিন যাচ্চে। হামার অ্যাকনা নাম লিকেন। বানের পানিত ভাসে থাকে প্যাটের কষ্ট আর সহ্য করবার পারিচ্চি না।’ চরের বাসিন্দা জাবিরুল ইসলাম জানান, এ চরের বাসিন্দারা বেশির ভাগই জেলে, দিনমজুর। অনেকেই বর্গাচাষি। অনেক কষ্ট করে পাট, আউশ ধান চাষ করেছিলেন। বন্যার পানিতে সব শেষ। যমুনার ঢলে সবাই নিঃস্ব।

যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দুর্গম চরে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ চরমে। বসতঘর জলমগ্ন হয়ে পড়ায় চরের বাসিন্দারা নৌকায় রাত কাটাচ্ছেন। জলমগ্ন বসতঘরেই ভাত রান্না করে রাখছেন এক নারী। গত বুধবার দলিকার চরে তোলা। ছবি: প্রথম আলো
যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বগুড়ার সারিয়াকান্দি উপজেলার দুর্গম চরে বানভাসি মানুষের দুর্ভোগ চরমে। বসতঘর জলমগ্ন হয়ে পড়ায় চরের বাসিন্দারা নৌকায় রাত কাটাচ্ছেন। জলমগ্ন বসতঘরেই ভাত রান্না করে রাখছেন এক নারী। গত বুধবার দলিকার চরে তোলা। ছবি: প্রথম আলো

দশ দিন ধরে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে পানিবন্দী পারুল বিবি। বলেন, ‘পানির মধ্যে খুব কষ্টে আচি। সংসারে চারডা সদস্য। ঘরত খাবার নাই। ইলিপোও পাচ্চি না। হামরায় বাঁচমো ক্যাংকা করে?’

হাটবাড়ি চরে গিয়েও পানিবন্দী মানুষের চরম দুর্ভোগ চিত্র দেখা গেল। প্রতিটি বসতবাড়িতে পানি। লোকজন নৌকা ও কলার ভেলায় করে চলাচল করছেন। এসব চরের লোকজন ত্রাণের আশায় রয়েছেন। সারিয়াকান্দি চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান শওকত আলী প্রথম আলোকে বলেন, এই ইউনিয়নে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার দুর্গত মানুষের জন্য আজ শুক্রবার পর্যন্ত ৭ মেট্রিক টন চাল আর ৩০০ প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ মিলেছে। দলিকার চরে এখন পর্যন্ত ত্রাণ বরাদ্দ মেলেনি।

সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাসেল মিয়া বলেন, যমুনায় পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৬৮টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সংখ্যা ১২ হাজার ৪০০। দুর্গত মানুষের সংখ্যা প্রায় ৫০ হাজার। বসতবাড়ি বিলীন হয়েছে প্রায় ৮০০। আজ পর্যন্ত দুর্গতদের জন্য ৩৩ দশমিক ৫ মেট্রিক টন চাল এবং আড়াই লাখ টাকা ত্রাণ বরাদ্দ মিলেছে।

বগুড়ার পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, যমুনা নদীর সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়া পয়েন্টে বিপৎসীমা ধরা হয় ১৬ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার। আজ সন্ধ্যা ছয়টায় সেখানে ১৭ দশমিক ৩০ সেন্টিমিটার অর্থাৎ বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছে। দুই দিন ধরে পানি স্থিতিশীল রয়েছে।