আর বাজছে না পাটকলের সাইরেনটা

প্রধান ফটকে সাঁটানো বিজ্ঞপ্তি পড়ছেন বেকার হয়ে পড়া শ্রমিকেরা। শনিবার সকাল ১০টার দিকে রাজশাহী জুট মিলসে। ছবি: প্রথম আলো
প্রধান ফটকে সাঁটানো বিজ্ঞপ্তি পড়ছেন বেকার হয়ে পড়া শ্রমিকেরা। শনিবার সকাল ১০টার দিকে রাজশাহী জুট মিলসে। ছবি: প্রথম আলো

৫০ বছর বয়সের মধ্যে প্রায় ৩০ বছর রাজশাহী জুট মিলস লিমিটেডে কাজ করেছেন আবুল কালাম। শনিবার সকালে এই পাটকলে এসেছিলেন নিজের বিছানাপত্র নেওয়ার জন্য। চলে যাওয়ার সময় স্থানীয় শ্যামপুরের এই বাসিন্দা কেঁদেই ফেললেন। বলছিলেন, এই কারখানার সাইরেন শুনে আর কর্মযজ্ঞ দেখে তিনি বড় হয়েছেন। এরপর চাকরি করেছেন প্রায় তিন দশক। দু-তিন দিন ধরে আর সেই সাইরেন বাজছে না। সব কর্মযজ্ঞ মুখ থুবড়ে পড়েছে। এমনটা হবে, তিনি কখনো চিন্তাই করেননি।

আবুল কালামের মতো এলাকার সবার কাছে এই পাটকলের সাইরেনটা খুব পরিচিত। এই শব্দ শুনেই বহু বছর তাঁরা নিত্য কাজের সময়সীমা নির্ধারণ করে নিয়েছেন। সময় দেখতে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকাতেও হতো না। কারণ, ২৪ ঘণ্টায় নির্দিষ্ট সময় পরপর অন্তত ১০ বার সাইরেন বাজত। তা শুনে কারও ঘুম ভাঙত, শিক্ষার্থীরা স্কুলে যেত, কেউ আবার রাতে পড়তে বা খেতে বসতেন। বিরক্তির সাইরেনটা এভাবে ধীরে ধীরে মানুষের জীবনে খাপ খাইয়ে নেয়। সাইরেনের উৎস এই পাটকলটা হয়ে ওঠে তাঁদের একটা অর্থনীতিময় জীবন গড়ার উপলক্ষ।

সবকিছুর অবসান ঘটেছে সরকারি এক সিদ্ধান্তে। বৃহস্পতিবার রাতে রাজশাহী তথা উত্তরাঞ্চলের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলটি বন্ধ হয়ে গেছে। এটি রাজশাহীর পবা উপজেলার কাঁটাখালী পৌরসভার শ্যামপুর গ্রামে অবস্থিত।

কারখানা সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৯ সালে ৪৯ দশমিক ২ একর জমির ওপর গড়ে ওঠে রাজশাহী জুট মিলস লিমিটেড। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এটিকে জাতীয়করণ করা হয়। তখন থেকে পাটকলটি বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিটিএমসি) অধীনে চলে আসছে। মোট শ্রমিক সংখ্যা ১ হাজার ৭৫৭। তাঁদের মধ্যে স্থায়ী ৭০৭ জন এবং অস্থায়ী ১ হাজার ৫০ জন। পাটকলটি বন্ধের সিদ্ধান্তে সবাই বেকার হয়ে গেলেন।

পাটকলের ২৬ বছরের শ্রমিক মো. আলাল (৫৫)। তিনি সিরাজগঞ্জের কাজীপুর এলাকার বাসিন্দা। কাজের সূত্রে ২৬ বছর আগে শ্যামপুরে আসা। পরিবার-পরিজনকেও এখানে এনেছিলেন। আলালকে তাঁর নিজ এলাকার বেশির ভাগ মানুষ এখন চেনে না। তবু সেই গ্রামেই ফিরে যেতে হচ্ছে তাঁর।

আলাল বললেন, এই পাটকলে প্রচুর লাভ হতো। ১৯৯৫ সালে এটি উৎপাদনে মডেল হয়েছিল। পরে কী থেকে কী যে হলো! কর্মকর্তারা শুধুই বলেন, লোকসান। আসলে মৌসুমের শেষে গিয়ে তাঁরা বেশি দামে পাট কেনেন। আবার নতুন মেশিন এক সপ্তাহের মধ্যে নষ্ট হয়ে যায়। অথচ সব দোষ চাপানো হয় শ্রমিকদের ঘাড়ে। তাঁরা কাজ করেন না, অদক্ষ ইত্যাদি। বাস্তবে, শ্রমিকেরা এই কারখানাকে বাপ-মা মনে করতেন। নিজেদের উজাড় করে দিয়ে কাজ করেছেন। মূলত কিছু অসাধু কর্মকর্তার খামখেয়ালিপনা ও উপযুক্ত সময়ে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত না নেওয়ার কারণে এই অবস্থা হয়েছিল বলে মনে করেন আলাল।

সিরাজগঞ্জের আবু হানিফ (৬৭) রাজশাহী জুট মিলসে কাজ করতে এসে রাজশাহীতেই বিয়ে করেছেন। এত বছর ধরে কাজ করেছেন এই কারখানায়। অথচ শনিবার সকালে অনেক চেষ্টায়ও তিনি কারখানার ভেতরে প্রবেশের অনুমতি পেলেন না। হানিফ সবে কয়েক মাস আগে কারখানার কোয়ার্টারে সিট পেয়েছিলেন। সেখানে রয়ে গেছে তাঁর দরকারি কাগজপত্র ও বিছানাপত্র। সেগুলো আনতেই ভেতরে যেতে চাইছিলেন তিনি।

হানিফের মতো আরও কয়েকজন কারখানার ভেতরে যাওয়ার অনুমতি চেয়ে ব্যর্থ হলেন। এই প্রতিবেদকও ভেতরে যাওয়ার অনুমতি পেলেন না। প্রধান ফটকে দায়িত্ব পালনরত প্রহরী বলে দিলেন, ‘ভিতরে কিছু নাই। সবকিছু বন্ধ হয়ে গেছে। ভিতরে গিয়ে লাভ নাই।’

তালাবদ্ধ ফটকের সামনে ১০-১৫ জন একটি নোটিশ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ছিলেন। আক্ষেপ করে বলছিলেন, তাঁরা এত দিন এই কারখানায় কাজ করলেন, অথচ তাঁদের আজ ঢুকতেই দেওয়া হচ্ছে না। এই শ্রমিকেরা সংশয়ে আছেন, সরকার ঘোষণা দিলেও তাঁরা টাকা পাবেন কি না তা নিয়ে। কারণ, কাকে কত টাকা দেবে, কীভাবে দেবে, কখন দেবে তা কেউ জানেন না। এ কারণে কারখানা বন্ধ হয়ে গেলেও অনেকে এলাকা ছাড়েননি।

রাজশাহী জুট মিলসের সিবিএ সভাপতি জিল্লুর রহমান প্রায় অর্ধশত বছর পাড়ি দিয়েছেন এই কারখানায়। কারখানার অনেক উত্থান-পতন তাঁর নিজ চোখে দেখা। সেসব আর তিনি এখন মনে করতে চান না। তিনি আক্ষেপ করে বললেন, তাঁরা আশাবাদী ছিলেন, বর্তমান সরকার আরও ভালো করে পাটকলগুলো চালু করবে। ঘটল ঠিক তার উল্টোটা। তবে এক অর্থে ভালোই হয়েছে। এভাবে কোনো প্রতিষ্ঠান চলতে পারে না। এখন সরকারি প্রতিশ্রুতির টাকা সঠিকভাবে তাঁরা পেলেই কোনোমতে বেঁচে যাবেন।