লকডাউন নিয়ে এখনো অস্পষ্টতা

রাজাবাজারে লকডাউনের পর রাজধানীর ওয়ারীতে শুরু হয়েছে লকডাউন। ছবি: মাসুম আলী
রাজাবাজারে লকডাউনের পর রাজধানীর ওয়ারীতে শুরু হয়েছে লকডাউন। ছবি: মাসুম আলী

করোনা সংক্রমণ মোকাবিলায় লকডাউন (অবরুদ্ধ অবস্থা) নিয়ে অস্পষ্টতা কাটছে না। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউনের সফলতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শেষ দিনের নমুনা পরীক্ষায় ১৮ জনের মধ্যে ১১ জনের করোনা শনাক্ত হয়েছে। রোগী শনাক্তের হার ৬১ শতাংশ। একে অস্বাভাবিক বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

গতকাল শনিবার পুরান ঢাকার ওয়ারীতে নতুন করে লকডাউন শুরু হয়েছে। লকডাউন চলছে আরও কমপক্ষে ৯টি জেলার বিভিন্ন এলাকায়। পূর্ব রাজাবাজারে লকডাউন কার্যক্রম নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হলেও এসব জেলায় তা হচ্ছে না। এরই মধ্যে নতুনভাবে লকডাউন শুরু করার প্রস্তুতি নিচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) একাধিক কর্মকর্তা এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপের একাধিক সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকা শহরের কোন এলাকায় কত রোগী আছেন, সেটা নিয়ে দুই দফায় মানচিত্র তৈরি করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ছাড়া নতুনভাবে লকডাউন কর্মপদ্ধতিও চূড়ান্ত করা হয়েছে। কবে নাগাদ তা কার্যকর করা হবে বা আদৌ কার্যকর করা হবে কি না, তা নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না।

কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপের সদস্যসচিব মোহম্মদ জহিরুল করিম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউনের এসওপি (মানসম্মত কার্যপ্রণালিবিধি) অনুমোদনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আশা করি, দু–এক দিনের মধ্যে তা অনুমোদন পাবে।’

করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের পন্থা হিসেবে লকডাউন ব্যবহার করা হচ্ছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। মূল্য উদ্দেশ্য সংক্রমিত ও ঝুঁকিপূর্ণ মানুষকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। এর বড় প্রভাব পড়ে জীবিকার ওপর। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হন দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের মানুষ, যাঁদের জীবন চলে দৈনিক রোজগারের ওপর। লকডাউনের মেয়াদ কত দিন হবে, (১৪ দিন বা ২১ দিন) তা নিয়ে মতভেদ আছে।

দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ নিশ্চিত হয় ৮ মার্চ। সংক্রমণ মোকাবিলায় এপ্রিলে সফল লকডাউন হয়েছিল রাজধানীর টোলারবাগে। এ কাজে আইইডিসিআরকে সহায়তা দিয়েছিল ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সাংসদ, ফ্ল্যাট ও বাড়ি মালিক সমিতি, মসজিদ কমিটি। এ ছাড়া রাজধানীর ঢাকেশ্বরী, মাদারীপুরের শিবচর ও গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর এলাকায়ও লকডাউন সফল হয়েছিল বলে একাধিকবার বলেছেন আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা।

পূর্ব রাজাবাজারের অভিজ্ঞতা

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম পূর্ব রাজাবাজারের লকডাউন মূল্যায়ন নিয়ে প্রথম আলোর সঙ্গে কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘পূর্ব রাজাবাজারে লকডাউন সফলভাবে শেষ করতে পেরেছি। এলাকায় সংক্রমণের যে ধারা বা শিকল ছিল, তা ভাঙা সম্ভব হয়েছে।’

কিন্তু শেষ দিনে অনেক বেশি মানুষের করোনা শনাক্ত হলো কী করে—এমন প্রশ্নের উত্তরে আতিকুল ইসলাম বলেন, আইসোলেশনে (বিচ্ছিন্নকরণ) থাকা মানুষজন নিয়ম মানেননি। তাঁরা ঘরে থেকেও পরিবারের অন্যান্য সদস্য বা নিকট আত্মীয়ের সঙ্গে মেলামেশা করেছেন।

তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও আইইডিসিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, লকডাউনের শেষ দিকে করোনা শনাক্তের হার বেশি হওয়ার ঘটনা তলিয়ে দেখছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘পূর্ব রাজাবাজার আমাদের বড় শিক্ষা দিয়েছে।’

>

পূর্ব রাজাবাজারে শেষ দিনের পরীক্ষায় ১৮ জনের মধ্যে ১১ জন শনাক্ত
রোগ শনাক্তের সনদ রোগীরা পাচ্ছেন না, যাচ্ছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ে
পুরান ঢাকার ওয়ারীতে নতুন করে লকডাউন শুরু

পূর্ব রাজাবাজারে ৪০–৫০ হাজার মানুষ বাস করে। পরীক্ষামূলক লকডাউন শুরু হওয়ার আগে এই এলাকায় ৩১ জন রোগী শনাক্ত হয়েছিলেন বলে সরকারি তরফে বলা হয়েছিল। যদিও সেই সংখ্যা নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। এলাকায় লকডাউন শুরু হয় ৯ জুন রাত থেকে। এলাকার নাজনিন স্কুলে নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার বুথ বসানো হয়। শুরুর দিকে দৈনিক ৫–৬ জন করে রোগী শনাক্ত হয়। এরপর প্রতিদিন দু–চারজন করে শনাক্ত হতে থাকে। আস্তে আস্তে শনাক্তের সংখ্যা কমতে থাকে। ২৭ জুন পর্যন্ত লকডাউন চলাকালে নতুন করে ৫৫ জন শনাক্ত হয়েছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ৩০ জুন ছিল লকডাউনের শেষ দিন। ওই দিন ১৮ জন নমুনা দিয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে ১১ জনের করোনা শনাক্ত হয়। রোগী শনাক্তের হার ৬১ শতাংশ। জাতীয়ভাবে রোগী শনাক্তের হার ১৯ দশমিক ১২ শতাংশ। লকডাউন সফলতার একটি মাপকাঠি সংক্রমণ ও রোগী শনাক্ত কমে আসা। গতকাল আইইডিসিআরের ওয়েবসাইটে দেখা যায়, এই এলাকায় শনাক্ত রোগী ৮৫ জন।

রাজাবাজারে লকডাউনের পর রাজধানীর ওয়ারীতে শুরু হয়েছে লকডাউন। ছবি: মাসুম আলী
রাজাবাজারে লকডাউনের পর রাজধানীর ওয়ারীতে শুরু হয়েছে লকডাউন। ছবি: মাসুম আলী

এ বিষয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সাবেক পরামর্শক মুজাহেরুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘পূর্ব রাজাবাজার এলাকার সর্বশেষ পরীক্ষার তথ্যে দেখা যায়, সংক্রমণ কমেনি। শনাক্তের হার অস্বাভাবিক বেশি। পরিসংখ্যান থেকে বলা যায়, এ এলাকায় লকডাউন সফল হয়নি।’

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র বলছে, সংক্রমণ কমেনি নাকি ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি ছিল, তা দেখার চেষ্টা করছে আইইডিসিআর ও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন। ব্যবস্থাপনার ত্রুটির কথা প্রথম আলোর কাছে বলেছেন পূর্ব রাজাবাজারের একজন বাসিন্দা। তাঁর পরিবারের সদস্য ৩০ তারিখ নমুনা দিয়েছেন। নমুনা দেওয়ার সময় তাঁদের ই–মেইল আইডি নেওয়া হয়নি। তাঁরা অন্যভাবে পরীক্ষার ফলাফল জানতে পেরেছেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত তাঁরা কোনো সনদ পাননি।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নমুনা সংগ্রহ ফরমে নমুনাদাতার ই–মেইল আইডি ব্যবহার না করে স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তার ই–মেইল ব্যবহার করা হয়েছে। ১৮ জনের সনদ ওই ব্যক্তির ই–মেইলেই পাঠানো হয়েছে বলে জানা গেছে। কিন্তু কাউন্সিলরের কার্যালয় থেকে তা নমুনাদাতাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয়নি।

জনস্বাস্থ্যবিদ মুজাহেরুল হক বলেন, ‘এটা সম্পূর্ণ অনৈতিক একটি কাজ। এতে রোগীর গোপনীয়তা লঙ্ঘিত হয়েছে।’

শুধুই প্রস্তুতি

১৫ মে করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে রাজধানীসহ দেশের বড় শহর এলাকায় লকডাউন করার পরামর্শ দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি। প্রায় এক মাস পরে ১১ জুন লকডাউন নিয়ে কাজ করার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে প্রধান করে ১৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপ গঠন করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর লাল, হলুদ ও সবুজ এলাকা চিহ্নিত করে লকডাউন করার কথা বলতে শুরু করে। তারা রাজধানীর ৪৫টি এলাকাকে লাল এলাকা হিসেবেও চিহ্নিত করে। গণমাধ্যমে লাল এলাকার তালিকা প্রকাশ পেলে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। বিশাল এলাকা কী করে নিয়ন্ত্রণ করা হবে, তা নিয়ে নানা কথা হতে থাকে। জানা যায়, কোনো এলাকাকে লাল, হলুদ বা সবুজ বলে চিহ্নিত করার মতো গ্রহণযোগ্য তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ছিল না।

সূত্র বলছে, লকডাউন এলাকার সংজ্ঞায় পরিবর্তন আনা হচ্ছে। এখন ৫ জন রোগী থাকলে একটি এলাকাকে লাল এলাকা বলা যেতে পারে। এলাকা হবে ছোট ও নির্দিষ্ট।

এই পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, ছোট ছোট এলাকায় লকডাউন করলে মানুষের সুবিধা। কিন্তু বাস্তবায়ন করা কঠিন। ছোট এলাকার জন্য জনবল একটি সমস্যা। খরচ বেশি।

৯ জেলায় লকডাউন

বগুড়া, চুয়াডাঙ্গা, মুন্সিগঞ্জ, যশোর, মাদারীপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, মাগুরা, কুষ্টিয়া ও খুলনা—এই ৯ জেলায় বেশ কিছু ওয়ার্ড ও ইউনিয়নে লকডাউন চলছে।

লকডাউনের সফলতা–বিফলতার বাইরেও এর প্রয়োগের ধরন নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনস্বাস্থ্যবিদ ও চিকিৎসক নেতারা। বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের খুলনা শাখার সভাপতি শেখ বাহারুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘লকডাউন এলাকায় রোগী আছেন, এমন বাড়ির সামনে লাল পতাকা গেড়ে দেওয়া হচ্ছে। এতে ওই বাড়ির মানুষ সামাজিকভাবে হেয় হচ্ছেন। তাঁরা ওষুধ, খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনে বাড়ির বাইরে যেতে পারছেন না।’

জনস্বাস্থ্যবিদ ও আইইডিসিআরের সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুশতাক হোসেন বলেন, লকডাউন শব্দটা নেতিবাচকভাবে মানুষের কাছে যাচ্ছে। এর পরিবর্তে স্বাস্থ্যবেষ্টনী শব্দ ব্যবহার করা যেতে পারে। এলাকার মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে, সঙ্গে নিয়ে কাজ না করলে লকডাউন সফল হবে না।