করোনাকালে অনলাইন-ফটোগ্রাফি চর্চা

করোনাভাইরাস মহামারির সময়েও মানুষকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছে, শক্তি জুগিয়েছে এবং অনুপ্রেরণা দিয়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। গুজব, বিতর্ক ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর বিষয়গুলো বাদ দিলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো আতঙ্কগ্রস্ত মানুষের সামনে জানালার মতো খুলে গেছে। দূরে থেকেও পাশে থাকা নিশ্চিত করেছে ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টুইটার, লিংকডইন, ম্যাসেঞ্জার ও হোয়াটসঅ্যাপের মতো প্ল্যাটফর্ম। করোনাকালে অ্যাপগুলো মানুষকে শুধু সংযুক্তই করছে না—শিক্ষা, অভিজ্ঞতা ও তথ্য আদান-প্রদানেও বড় ভূমিকা রাখছে।

করোনাকালে পেশাগত কারণে ফটোসাংবাদিকদের মাঠে থাকতে হচ্ছে। অন্যান্য ক্ষেত্রের আলোকচিত্রীদের অনেকেই কর্মহীন। আবার অনেকের ইচ্ছে থাকলেও বাইরে বের হতে পারছেন না। ফটোগ্রাফির শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোও বন্ধ। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে ফটোগ্রাফি চর্চার নতুন দুয়ার খুলেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোয়। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে অনলাইনে চলছে ফটোগ্রাফি নিয়ে লাইভ আলোচনা ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান এবং আড্ডা। অনুষ্ঠানগুলো শুধু ফটোগ্রাফিপ্রেমীদের নয়—শিল্পমনস্ক দর্শকদেরও আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

ইতিমধ্যে জনপ্রিয়তা পাওয়া লাইভ অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে, আলোকচিত্রী অভিজিৎ বিশ্বাসের ‘ফটো ডিসকাশন’ আয়োজিত বিষয়ভিত্তিক অনুষ্ঠান, আলোকচিত্রী এম আমিনুর রহমানের ‘ক্যাজুয়াল: কাউচ টক উইদ এম’, কুমিল্লা ফটোগ্রাফি সোসাইটির ‘অনলাইন লাইভ ফটোটক’, ক্রিয়েটিভ ন্যাশনের ‘লাইভ সেশনস’, ফটোফি একাডেমি অব ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির ‘ফটোফি লাইভ’, থ্রু দ্য লেন্সের (টিটিএল) ‘কনভারসেশন’, আলোকচিত্রী এন্ড্রু বিরাজের সঞ্চালনায় ‘ফটোস অ্যান্ড স্টোরিস’, বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার্স অ্যাসোসিয়েশনের ‘লাইভ ফটো ডিসকাশন’, নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি আর্ট অ্যান্ড ফটোগ্রাফি ক্লাবের ‘আর্টিস্ট’স টক’, ফটোগ্রাফিক সোসাইটি অব রুয়েটের ‘অনলাইন ফটোগ্রাফি সেশনস’, ইউল্যাব মিডিয়া ক্লাবের ‘ক্রিয়েটিভ টক ১.০’ ইনডিপেনডেন্ট ফটোগ্রাফি ক্লাবের ‘লাইভ সেশন’ এবং ‘ফটো আড্ডা’ শিরোনামে বুয়েট ফটোগ্রাফিক সোসাইটি, বিজিএমইএ ইউনিভার্সিটি অব ফ্যাশন টেকনোলজি ফটোগ্রাফি ক্লাব ও বিইউপি ফটোগ্রাফি সোসাইটির লাইভ অনুষ্ঠান। অন্যদিকে খুলনা ইউনিভার্সিটি ফটোগ্রাফি সোসাইটি লাইভ না করলেও ফেসবুকে নিয়মিত শিক্ষামূলক ভিডিও প্রকাশ করছে।

নতুন ধারার এই ফটোগ্রাফি চর্চা সম্পর্কে অনলাইন ফটোগ্রাফি কমিউনিটি থ্রু দ্য লেন্সের (টিটিএল) প্রধান সাউদ আল ফয়সাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘দীর্ঘদিনের লকডাউনের মধ্যে আমরা দেশি-বিদেশি আলোকচিত্রীদের নিয়ে বেশ কিছু লাইভ সেশনের আয়োজন করি। এই আয়োজন সম্ভব হলো কারণ, বিখ্যাত আলোকচিত্রীরা এ সময় তুলনামূলকভাবে কম ব্যস্ত। আমরা এই সময়টাকে ব্যবহার করতে চেয়েছি, শেখার জন্য, জ্ঞান আর অভিজ্ঞতা ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্য। চারদিকে যখন আতঙ্ক—তখন এই লাইভ সেশনগুলো আমাদের দিয়েছে প্রাণশক্তি।’

ফটোফি একাডেমি অব ফাইন-আর্ট ফটোগ্রাফির প্রধান সমন্বয়ক সিরাজুল লিটন বললেন, ‘সংকট আছে বলে হাত–পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলে না। আমরা এই সংকটকেও সম্ভাবনা হিসেবে দেখতে চাই। এই নীরস সময়টাকে কাজে লাগানো সম্ভব। আতঙ্ক কাটিয়ে সময়টাকে প্রাণবন্ত ও আনন্দদায়ক করার উদ্দেশ্য থেকেই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে এবং আমরা দেখছি এই উদ্যোগ সফল।’

ফটোগ্রাফিবিষয়ক একাধিক লাইভ অনুষ্ঠানের উপস্থাপক এবং চেকমেট ইভেন্টসের প্রধান আলোকচিত্রী এম আমিনুর রহমান বললেন, আমাদের সমাজে অসাধারণ সব আলোকচিত্রী আছেন, যাঁরা এই প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমভিত্তিক বিভিন্ন লাইভ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। তাঁরা যোগাযোগমাধ্যমকে শিক্ষা আদান-প্রদানের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ব্যবহার করছেন।

এ ধরনের আয়োজন বাংলাদেশের ফটোগ্রাফি চর্চায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই অনুষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে দেশে-বিদেশে থাকা বিখ্যাত আলোকচিত্রীরা হাজার হাজার ফটোগ্রাফিপ্রেমীর সঙ্গে সংযুক্ত হচ্ছেন। নবীন আলোকচিত্রীরা জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রীদের সঙ্গে সহজেই সংযুক্ত হতে পারছেন এবং তাঁদের প্রশ্ন করে জেনে নিতে পারছেন নানা তথ্য। সাধারণ সময়ে যা করা কঠিন।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ফটোগ্রাফি-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কাউন্টার ফটো। এই প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ সাইফুল হক অমি এ ধরনের আয়োজনকে স্বাগত জানিয়ে বললেন, ‘এই দম বন্ধ করা পরিস্থিতির মধ্যে এই আলোচনাগুলো দারুণ। সংকটের সময় এ ধরনের অনলাইনভিত্তিক ফটোগ্রাফি-আলোচনা এক ধরনের উদ্ভাবনও, যা অনেক বড় ব্যাপার। এতে অনেক আলোকচিত্রীর কথা লম্বা সময় ধরে শোনার সুযোগ হচ্ছে। ক্যামেরার পেছনে যাঁরা থাকেন, তাঁরা সামনে আসছেন। তাঁরাও যে বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা করতে এবং নানা সামাজিক ইস্যুতে কথা বলার যোগ্যতা রাখেন তাও প্রমাণ হলো।’