করোনা আর বন্যার মধ্যেই ভোট, নৌকার প্রচারণা, নেই বিএনপি

করোনার সংক্রমণ ও মৃত্যুর দিক থেকে রাজশাহী বিভাগে শীর্ষে থাকা বগুড়া শহরের রেড জোন ঘোষিত এলাকায় সপ্তাহ দুই ধরে চলছে লকডাউন। জেলায় করোনা শনাক্ত রোগী ৩ হাজার ৩০০ ছাড়িয়েছে। কোভিডে সরকারি হিসাবেই মৃত্যু ৬১ জন। করোনার সংক্রমণ–ঝুঁকির সঙ্গে বন্যায় জেলার তিন উপজেলার ৯৭টি গ্রামের হাজারো মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছে। করোনার ঝুঁকি আর বন্যার এই দুর্ভোগের মধ্যেই চলছে বগুড়া-১ (সারিয়াকান্দি-সোনাতলা) শূন্য আসনের উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রচারণা।

নির্বাচন কমিশন ১৪ জুলাই ভোট গ্রহণের সিদ্ধান্ত জানানোর পরপরই আজ রোববার থেকে নৌকায় ভোট চেয়ে প্রচারণায় মাঠে নেমেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকার প্রার্থী সাহাদারা মান্নান ও তাঁর সমর্থকেরা।

তবে মাঠে নেই বিএনপি মনোনীত প্রার্থী আহসানুল তৈয়ব জাকির। তিনি বলেন, করোনা মহামারি আর বন্যার দুর্ভোগে মানুষের মধ্যে ভোটের নামে প্রহসনের আরেকটি নাটক মঞ্চায়নের প্রস্তুতি চলছে। নির্বাচনী এলাকার অর্ধলক্ষাধিক মানুষ বন্যায় চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে। দুর্গত এলাকায় ত্রাণ নেই, আশ্রয়হীন মানুষ খোলা আকাশের নিচে দিন কাটাচ্ছে। দুই উপজেলায় দেড় শতাধিক মানুষ করোনায় সংক্রমিত। করোনা ও বন্যায় বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে।

আহসানুল তৈয়ব আরও বলেন, ‘দুই উপজেলার ৯ ইউনিয়নের ৭০-৮০টি গ্রামের ৬০ থেকে ৭০ হাজার মানুষ পানিবন্দী। অনেক ভোটকেন্দ্র জলমগ্ন রয়েছে। এ রকম একটি অবস্থার মধ্যে মানুষের কাছে ভোট চাইতে যাওয়া বিব্রতকর। তবু দলীয় সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছি। দল থেকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। দলীয় সিদ্ধান্ত জানার পরপরই প্রচারে মাঠে নামব।’

সারিয়াকান্দি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রাসেল মিয়া জানান, তাঁর উপজেলায় আটটি ইউনিয়নের বন্যায় প্লাবিত ৬৮টি গ্রামের অর্ধলক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী। বিশেষ করে চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের অধিকাংশ চর এখন যমুনার ঢলে প্লাবিত। আগামী কয়েক দিনের মধ্যে আরও এক দফা বন্যা পরিস্থিতির আভাস দিয়েছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)।

ইউএনও রাসেল মিয়া বলেন, এরপরও ইসির সিদ্ধান্ত মোতাবেক উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণের জন্য প্রস্তুত তাঁরা। তবে ইসির ভোটকেন্দ্র–ঘোষিত চকরতিনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, রোহদহ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিজামউদ্দিন উচ্চবিদ্যালয় ও ঘুঘুমারি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় এখনো জলমগ্ন। আবার দলিকার চর, শিমুলতাইড়, বিরামের পাঁচগাছি ও আউচারপাড়া চরও জলমগ্ন। এসব চরে ভোটকেন্দ্র রয়েছে। তিনি বলেন, বন্যার উন্নতি হচ্ছে। নতুন করে অবনতি না হলে ১৪ জুলাই ভোট গ্রহণে তেমন সমস্যা হওয়ার কথা নয়। তবে আরেক দফা বন্যা হলে এসব কেন্দ্র পার্শ্ববর্তী সুবিধামতো জায়গায় স্থানান্তর করতে হবে।

সোনাতলা উপজেলার সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা এস এম জাকির হোসেন বলেন, তাঁর উপজেলায় যমুনার চরাঞ্চলের মহেশপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও তেকানিচুকাইনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। ভোটকেন্দ্র–ঘোষিত এই দুই বিদ্যালয়ে ভোট গ্রহণ সম্ভব হবে কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার জন্য তিনি সরেজমিনে দুটি চর পরিদর্শনে যাচ্ছেন। যদি বন্যা পরিস্থিতিতে কোনো ভোটকেন্দ্র সরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে, তবে তা ইসিকে জানানোর পর তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

২০০৮ থেকে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নির্বাচন পর্যন্ত তিন দফায় আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সাংসদ হন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও প্রয়াত নেতা আবদুল মান্নান। গত ১৮ জানুয়ারি তাঁর মৃত্যুর কারণে আসনটি শূন্য হয়। নির্বাচন কমিশন ২৯ মার্চ ভোট গ্রহণের দিন ধার্য করে তফসিল ঘোষণা করে। ৯ মার্চ প্রতীক বরাদ্দ পেয়ে প্রচারণা শুরু করেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা।

নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীরা হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও সাবেক সাংসদ আবদুল মান্নানের স্ত্রী সাহাদারা মান্নান (নৌকা), বিএনপি মনোনীত প্রার্থী এ কে এম আহসানুল তৈয়ব জাকির (ধানের শীষ), জাতীয় পার্টির প্রার্থী মোকছেদুল আলম (লাঙ্গল), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী নজরুল ইসলাম (বটগাছ), বাংলাদেশ প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দলের (পিডিপি) মো. রনি (বাঘ) ও স্বতন্ত্র প্রার্থী ইয়াসির রহমতুলল্লাহ (ট্রাক)।

মার্চে দেশে করোনার সংক্রমণ দেখা দেওয়ায় প্রার্থীদের প্রচারে ছেদ পড়ে। বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে নির্বাচন স্থগিতের দাবি তোলা হয়। ২১ মার্চ নির্বাচন স্থগিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন।

স্থগিত ভোট গ্রহণের ঘোষণায় উচ্ছ্বসিত আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী ও তাঁর সমর্থকেরা। আজ সকাল থেকেই নৌকায় ভোট চেয়ে যমুনার চরাঞ্চলে গণসংযোগে ব্যস্ত দিন কাটান আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাহাদারা মান্নান। প্রথমে কাজলার চরের আনন্দবাজারে নির্বাচনী পথসভা হয়। এতে নৌকায় ভোট চেয়ে প্রার্থী সাহাদারা মান্নান ছাড়াও সারিয়াকান্দি উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা বক্তব্য দেন। দুপুরের দিকে নৌকার পক্ষে নির্বাচনী পথসভা হয় চালুয়াবাড়ি ইউনিয়নের মানিকদাইড় চরে। এ ইউনিয়নের ১০ থেকে ১২টি চর এখন বন্যায় প্লাবিত। হাজার হাজার মানুষ নদীভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে। দুর্গত এলাকায় নৌকায় রাত কাটছে চরের মানুষ।

মানিকদাইড় চরের নির্বাচনী সভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক, যুগ্ম সম্পাদক মতিউর রহমান ও চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী নৌকায় ভোট চেয়ে বক্তব্য দেন।

নৌকার প্রার্থী সাহাদারা মান্নান নির্বাচনী সভায় ভোটারদের উদ্দেশে বলেন, এলাকার মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন সাংসদ আবদুল মান্নান। তিনি সব সময় যমুনা-বাঙ্গালী নদীর সঙ্গে লড়াই করে বেঁচে থাকা সারিয়াকান্দি ও সোনাতলা উপজেলার মানুষের সুখে–দুঃখে পাশে ছিলেন। তাঁর অবর্তমানে এলাকাবাসী এতিম হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘তাঁর (আবদুল মান্নান) শূন্যস্থান হয়তো পূরণ করতে পারব না। তবে তাঁর ছায়া হয়ে সুখে–দুঃখে আপনাদের পাশে থাকতে চাই। তাঁর রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ শেষ করতে এবং এলাকার উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে জননেত্রী শেখ হাসিনা আমার হাতে নৌকা তুলে দিয়েছেন। মাঝি হয়ে সেই উন্নয়নের নৌকায় আপনাদের তুলে নিতে চাই। ১৪ জুলাই নৌকায় ভোট চাই।’

বহাইল ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও ইউপি সদস্য ধারাবর্ষা চরের বাসিন্দা বাদশা মিয়া বলেন, করোনার তিন মাস কোনো প্রার্থীই চরে পা ফেলেননি। করোনা-বন্যার মধ্যে চরের ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত করা কষ্টসাধ্য হবে। তবে দলীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

হাটশেরপুর ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য ও চকরতিনাথ চরের বাসিন্দা আবদুর রশিদ বলেন, ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত করা চ্যালেঞ্জ, তবে অসাধ্য নয়। ভোটারদের বুঝিয়েই কেন্দ্রে নিতে হবে।

চালুয়াবাড়ি ইউপি চেয়ারম্যান শওকত আলী বলেন, করোনা ও বন্যায় চরের মানুষ দুর্ভোগ-কষ্টে আছে। ভোটারদের কেন্দ্রে উপস্থিত করা চ্যালেঞ্জিং হবে। তবে প্রয়াত সাংসদের প্রতি ভালোবাসা থেকেই ভোটাররা কেন্দ্রে এসে ভোট দেবেন।

নৌকার প্রার্থী সাহাদারা মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, ছয় মাস ধরে এলাকায় নির্বাচিত সাংসদ নেই। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড স্থবির হয়ে রয়েছে। লোকজন তাদের চাওয়া, দাবির কথা কাউকে জানাতে পারছেন না। স্থগিত ভোট গ্রহণের ঘোষণায় উচ্ছ্বসিত ভোটাররা। তাঁরা নির্বাচিত সাংসদ চান। বন্যা-নদীভাঙনের সঙ্গে লড়াই করে অভ্যস্ত মানুষ। করোনা-বন্যায় ভোটের ওপর কোনো প্রভাব ফেলবে না। ভোটার উপস্থিতি আশাতীত হবে।

তবে বগুড়া জেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও বগুড়া-৬ আসনের সাংসদ গোলাম মোহাম্মদ সিরাজ বলেন, করোনার সংক্রমণে দেশে জাতীয় সংকট বিরাজ করছে। করোনা মহামারিতে এখন মানুষের মৃত্যুর মিছিল চলছে। চিকিৎসা মিলছে না। নমুনা পরীক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ নেই। নমুনা দিতে গিয়ে রোগী-স্বজনেরা সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে মার খাচ্ছেন, লাঞ্ছিত হচ্ছেন। বন্যায় লাখো মানুষ পানিবন্দী। মানুষ নানা সংকটে দিশেহারা। এ রকম পরিস্থিতিতে নির্বাচনের কোনো পরিবেশ নেই। জাতীয় সংকটের এমন সময়ে উপনির্বাচনে ভোট গ্রহণের নামে ভোটারবিহীন কেন্দ্রে ব্যালট কেটে বাক্স ভরানোর অশুভ ফন্দি আঁটা হচ্ছে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত হবে আত্মঘাতী। তিনি বলেন, তাঁর দলের হাইকমান্ড দ্রুত এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে। দলীয় নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত ধানের শীষের প্রার্থী মাঠে নামবেন না।