৯৫ দিনে এক হাজার মৃত্যু, ২৫ দিনে দ্বিগুণ

করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স
করোনাভাইরাস। ছবি: রয়টার্স

দেশে করোনাভাইরাসে সংক্রমণ ও মৃত্যু দুটোই দ্রুত বাড়ছে। সপ্তাহখানেক ধরে মৃত্যুর ঊর্ধ্বগতিতে একটি নতুন মাত্রা দেখা যাচ্ছে।

গতকাল রোববার এক দিনেই করোনায় ৫৫ জনের মৃত্যুর তথ্য জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে দেশে করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা ২ হাজার ছাড়িয়ে গেল। সংক্রমণ শনাক্তের ১২০ দিনে করোনায় মারা গেছেন মোট ২ হাজার ৫২ জন। করোনায় প্রথম ১ হাজার মানুষের মৃত্যু ছাড়াতে সময় লেগেছিল ৯৫ দিন। এরপরের মাত্র ২৫ দিনের ব্যবধানে মৃত্যু দ্বিগুণ হয়ে গেছে। এই ২৫ দিনে মারা গেছেন ১ হাজার ৪০ জন।

করোনায় আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে শীর্ষ ২০টি দেশের একটি বাংলাদেশ। তবে আক্রান্তের শীর্ষে থাকা দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় তুলনামূলক মৃত্যুর হার কম। এর মধ্যে বাংলাদেশে মৃত্যুর হার আরও কম। শুরু থেকে দেশে নারীর তুলনায় পুরুষ এবং ষাটোর্ধ্ব মানুষ বেশি মারা যাচ্ছেন। কিছুদিন ধরে পুরুষ এবং ষাটোর্ধ্বদের মৃত্যু আরও বেড়েছে।

মৃত্যু বাড়ছে

৮ মার্চ দেশে প্রথম কোভিড-১৯ শনাক্তের খবর জানানো হয়। প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে এর ১০ দিনের মাথায় ১৮ মার্চ। সংক্রমণের প্রথম এক মাস দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা ১০-এর নিচে ছিল। পরে সংক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুও বেড়েছে। তবে শুরু থেকে প্রতি সপ্তাহেই আক্রান্তের সংখ্যা আগের সপ্তাহের চেয়ে বাড়তে দেখা গেলেও মৃত্যুর ক্ষেত্রে তা ছিল কিছুটা ব্যতিক্রম। কোনো সপ্তাহে মৃত্যু বেশি হয়েছে, আবার কখনো সেটা কমেছে।

২৬ মার্চ থেকে সংক্রমণ ঠেকাতে দেশে শুরু হয় সাধারণ ছুটি। অফিস-আদালত, গণপরিবহন বন্ধ করে কার্যত লকডাউন (অবরুদ্ধ) পরিস্থিতি তৈরি হয়। এর মধ্যে ২৬ এপ্রিল থেকে পোশাক কারখানা খুলে দিলে লকডাউন আগের চেয়েও ঢিলেঢালা হয়ে যায়। এর দুই সপ্তাহ পর সংক্রমণের দশম সপ্তাহ (১০-১৬ মে) থেকে সংক্রমণ ও মৃত্যু দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ওই সপ্তাহে প্রতিদিন গড়ে ১৪ জনের বেশি মারা গেছেন। মে মাসের মাঝামাঝি ঈদের কেনাকাটার জন্য দোকানপাট খুলে দেওয়া হয়। ৩১ মে থেকে সরকারি ছুটিও তুলে দেওয়া হয়। এরপর থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতি সপ্তাহেই মৃত্যুর সংখ্যা আগের সপ্তাহের চেয়ে বাড়তে দেখা যায়।

দেশে সংক্রমণের ১৪তম সপ্তাহে (৭-১৩ জুন) দৈনিক মৃত্যুর গড় ছিল প্রায় ৪২। এরপরর দুই সপ্তাহ মৃত্যুর সংখ্যা কিছুটা কমে আসে। ১৬তম সপ্তাহে দৈনিক মৃত্যুর গড় ৪০-এর নিচে নেমেছিল। তবে পরের সপ্তাহ থেকে মৃত্যু আবার বাড়তে শুরু করেছে। গত শনিবার শেষ হওয়া সংক্রমণের ১৭তম সপ্তাহে দিনে গড়ে ৪৩ জনের বেশি মারা গেছেন।

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, পবিত্র ঈদুল ফিতরের পর থেকে মৃত্যু বেড়েছে। এখনো সেটা অব্যাহত আছে। কিছুদিন ধরে দৈনিক মৃত্যু বাড়তে দেখা যাচ্ছে। আরও কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করে বোঝা যাবে মৃত্যু জাম্প (লাফ) করবে কি না। তবে চলাচল সীমিত না করলে পবিত্র ঈদুল আজহার পর সংক্রমণ ও মৃত্যুতে বড় ধরনের জাম্প দেখা যাওয়ার আশঙ্কা আছে। তিনি বলেন, সংক্রমণ যত বাড়বে, ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে সংক্রমণ তত বেশি বিস্তৃত হবে। এতে মৃত্যুর হার বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকিও বাড়বে।

এক দিনে ৫৫ জনের মৃত্যু

গতকাল দেশে সংক্রমণের ১৮তম সপ্তাহ শুরু হয়েছে। সপ্তাহের প্রথম দিনেই ৫৫ জনের মৃত্যুর খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। গতকাল নিয়মিত সংবাদ বুলেটিনে অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা এই তথ্য জানান। এটি এক দিনে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ মৃত্যু। এর আগে গত ৩০ জুন এক দিনে ৬৪ জনের মৃত্যু হয়।

নাসিমা সুলতানা বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ১৩ হাজার ৯৮৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এর মধ্যে ২ হাজার ৭৩৮ জনের দেহে সংক্রমণ পাওয়া গেছে। এ নিয়ে মোট আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়াল ১ লাখ ৬২ হাজার ৪১৭। আর সুস্থ হয়েছেন মোট ৭২ হাজার ৬২৫ জন।

মৃত্যুহার তুলনামূলক কম

গতকাল পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে মোট আক্রান্তের সংখ্যা বিবেচনায় মৃত্যুর হার ১ দশমিক ২৬ শতাংশ। অবশ্য সরকারি হিসাবের বাইরে প্রতিদিন করোনার উপসর্গ নিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গায় মৃত্যুর খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজের (সিজিএস) একটি প্রকল্প বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরি (বিপিও) গণমাধ্যমে প্রকাশিত এ ধরনের মৃত্যুর খবরের হিসাব রাখছে। তাদের হিসাবে ২৭ জুন পর্যন্ত করোনার উপসর্গ নিয়ে দেড় হাজার মানুষের মৃত্যু হয়েছে। তবে তাঁরা করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন কি না, তা নিশ্চিত নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বে আক্রান্তের শীর্ষে থাকা ২০টি দেশের মধ্যে ১৮টিতেই মৃত্যুর হার বাংলাদেশের চেয়ে বেশি। এই দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মৃত্যুর হার সৌদি আরবে, ১ শতাংশের কম। ১২টি দেশে মৃত্যুর হার সাড়ে ৩ শতাংশের ওপরে। এই তালিকায় থাকা দক্ষিণ এশিয়ার তিনটি দেশেই মৃত্যুর হার ৩ শতাংশের কম। ভারতে ২ দশমিক ৯ শতাংশ এবং পাকিস্তানে ২ দশমিক ১ শতাংশ।

আক্রান্তের শীর্ষে থাকা ২০টি দেশের মধ্যে মৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি যুক্তরাজ্যে ১৫ দশমিক ৫৩ শতাংশ। সবচেয়ে বেশি আক্রান্তের দেশ যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর হার ৪ দশমিক ৬ শতাংশ।

দেশে মৃত্যুর হার কম হওয়ার কারণ নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো গবেষণা পাওয়া যায় না। আইইডিসিআরের পরামর্শক মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মৃত্যুর হার কম হওয়ার একটি কারণ হতে পারে, দেশে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা কম। জনসংখ্যার বড় অংশই তরুণ ও যুবক। দ্বিতীয়ত ইতালি বা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে বৃদ্ধাশ্রমে খুব বেশি মানুষ থাকেন না। দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী বেশি পারিবারিক সুরক্ষা পায়।

বিশ্বে প্রথম করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ধরা পড়ে চীনের উহানে। ফেব্রুয়ারির শেষে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও চীন একটি যৌথ প্রতিবেদন প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়, ৬০ বছরের বেশি বয়সী এবং যাঁদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদ্‌রোগ ও দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসতন্ত্রের রোগ আছে, তাঁদের মৃত্যুঝুঁকি বেশি। চীনে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৮০ শতাংশের বয়স ছিল ৬০-এর ওপরে।

বাংলাদেশেও ষাটোর্ধ্ব মানুষ বেশি মারা যাচ্ছেন। তবে সেটা চীনের চেয়ে কম। বাংলাদেশে মারা যাওয়াদের ৪৩ শতাংশের বয়স ষাটের ওপরে।

সাধারণত করোনায় আক্রান্তদের সিংহভাগেরই লক্ষণ উপসর্গ মৃদু, তাঁদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় না। মূলত যাঁদের অবস্থা গুরুতর, তাঁদেরই মৃত্যুঝুঁকি বেশি এবং হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। কিন্তু দেশে যাঁরা মারা যাচ্ছেন, তাঁদের একটি বড় অংশের মৃত্যু হচ্ছে বাড়িতে। আরেকটি অংশ মারা যাচ্ছে হাসপাতালে নেওয়ার পরপরই। রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে মৃত্যুর ৩৫ শতাংশ হয়েছে ভর্তির প্রথম দিনে।

প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও ইউজিসি অধ্যাপক এ বি এম আবদুল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, বয়স্ক ও অন্য রোগে আক্রান্তদেরই মৃত্যুঝুঁকি বেশি। অনেকে চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে যেতে চান না বা যেতে দেরি করেন। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষার ফল পেতেও অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। এতে চিকিৎসাসেবা থেকে বঞ্চিত হতে হয়। পরিস্থিতি খারাপ হলে দ্রুত হাসপাতালে যেতে হবে। পরীক্ষা বাড়াতে হবে এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে রোগ নির্ণয় করতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসাসুবিধা বাড়াতে হবে। এসবের মাধ্যমে মৃত্যু আরও কমিয়ে আনা সম্ভব।