গাইবান্ধার কামারজানি ইউনিয়ন: করোনায় পঙ্গু, বন্যায় শেষ

বন্যার কারণে হাতে কাজ নেই। তাই ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ত্রাণের আশায় বসে আছেন নারী-পুরুষেরা। সোমবার সকালে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট গ্রামে। ছবি: শাহাবুল শাহীন
বন্যার কারণে হাতে কাজ নেই। তাই ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে ত্রাণের আশায় বসে আছেন নারী-পুরুষেরা। সোমবার সকালে গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গোঘাট গ্রামে। ছবি: শাহাবুল শাহীন

ময়েজ উদ্দিন (৫০) পেশায় দিনমজুর। বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের বাটকামারি গ্রামে। আগে তাঁর ২০ বিঘা জমি ছিল। দৈনিক তিন-চারজন দিনমজুর তাঁর বাড়িতে কাজ করতেন। গত ১০ বছরে নদীতে সব বিলীন হয়েছে। এখন তিনি নিজেই দিনমজুরের কাজ করেন। করোনার আগে দৈনিক ৪৫০ টাকা মজুরি পেতেন। এখন প্রায় দুই মাস কাজ বন্ধ। ঘরে তিনটি ছাগল ছিল। সেগুলো বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছিলেন। সেই টাকাও শেষ হয়। এমন সময় লকডাউন খুলে দেওয়া হয়। পুনরায় তিনি দিনমজুরের কাজ শুরু করেন। কিন্তু বন্যা আসায় সেই দিনমজুরি বন্ধ। এখন ধারদেনা করে চলছেন।

ময়েজ উদ্দিন বলেন, ‘করোনা আমাদের পঙ্গু করে দিয়েছে। সেই ঘা এখনো শুকায়নি। এর মধ্যেই বন্যা এসেছে। যেন মরার উপর খাঁড়ার ঘা।’ তিনি বলেন, ‘১০ দিন ধরে পানির সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। ঘরে খাবার নেই। কিন্তু চেয়ারম্যান–মেম্বাররা ত্রাণ দিলেন না।’

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে ইউনিয়নটি অবস্থিত। ভৌগোলিক দিক থেকে ইউনিয়নটি উন্নয়নে পিছিয়ে। কারণ, ব্রহ্মপুত্র নদ এ ইউনিয়নের বুক চিরে প্রবাহিত হয়েছে। মোট ছয়টি গ্রামের চারটি নদের ওপারে অবস্থিত। পশ্চিমপারে মাত্র দুটি গ্রাম গোঘাট ও কড়ইবাড়ি। ওপারে চারটি গ্রাম হলো বাটকামারি, পারদিয়ারা, কুন্দেরপাড়া ও খারজানি।

সোমবার সকালে ইউনিয়নটি ঘুরে দেখা যায়, বন্যায় লোকজন চরম দুর্ভোগে রয়েছেন। ছেলেমেয়েরা কলার ভেলায় খেলা করছে। বড়দের কেউ বন্যার পানিতে মাছ ধরছেন। অনেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করছেন। পানি নেমে যাচ্ছে। ফলে কাদামাটি ও আটকে থাকা পানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি ও পথঘাট। বাড়ির উঠানে ও ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নারী-পুরুষের জটলা। সবার চোখমুখে হতাশার ছাপ। তাকিয়ে আছেন ত্রাণের আশায়।

ঘরে পানি ওঠায় আঙিনায় চৌকি পেতে তার ওপর রান্না করছিলেন গোঘাট গ্রামের মায়ারানী সাহা (৫৫)। তিনি বলেন, ‘১০ দিন থেকে পানির মধ্যে বাস করছি। উঁচু জায়গায় যেতে পারিনি। ঘরের মেঝেতে পানি। খড়কুটো ভিজে গেছে। কেনা খড়ি দিয়ে রান্না করছি।’ তিনি বলেন, ‘অনেক আগে স্বামী মারা গেছেন। দুই সন্তান নিয়ে ধারদেনা করে চলছি। ১০ দিনে কোনো ত্রাণ পাইনি।’

কড়ইবাড়ি গ্রামের রিকশাচালক আঙুর মিয়া (৪৫) বললেন, ‘হামরা নদীর পারের মানুষ। নদীত পানি বাড়লে হামারঘরে ঘরবাড়ি ডুবি যায়। বান আসি অবস্থা আরও খারাপ হচে। বানের পানিত পড়ি তিন মণ ধান ভাসি গেচে। ঘরের বেড়া নষ্ট হচে। উঁচা জাগাত যাই নাই। ১০ দিন থাকি কষ্ট করি পানির মদ্দে আচি।’

একই গ্রামের দিনমজুর রাজু মিয়া (৫০) বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে সাহায্য চাই না। সরকার আমাদের কাজ দিক। আমরা পরিশ্রম করে খাব। কিন্তু বন্যার সময় কাজ নাই। ত্রাণও পাচ্ছি না। চেয়ারম্যানের কাছে গেলে বলে, “যেটুকু ত্রাণ পেয়েছি, তা বিতরণ করেছি। কোথা থেকে ত্রাণ দেব।”’

কড়ইবাড়ি গ্রামের মনোয়ারা বেগম (৫৫) বলেন, অসুস্থ স্বামীকে নিয়ে তাঁর ছয়জনের সংসার। অন্যের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে কোনোমতে সংসার চালাতেন। কিন্তু এখন বন্যার কারণে কেউ কাজে নেয় না। এক মাস আগে ৩টি মুরগি ৭০০ টাকায় বিক্রি করে চাল কিনেছিলেন। সেই চালও শেষ। এখন ৯০০ টাকা ধার নিয়ে চলছেন।

পারদিয়ারা গ্রামের কৃষক আবদুল আজিজ (৫৫) বলেন, চারদিকে এত পানি, কিন্তু খাওয়ার পানি নেই। নলকূপ ডুবে গেছে। ডুবে যাওয়া নলকূপের পানি বিশুদ্ধ নয়। তাই নদের পানি ফুটিয়ে খাচ্ছেন। এতে অনেকের পেটের পীড়া দেখা দিয়েছে।

খারজানি গ্রামের স্কুলশিক্ষক সোলায়মান আলী বলেন, বন্যার পানিতে তাঁদের পায়খানা–প্রস্রাবখানার ঘর ভেসে গেছে। ভেলায় দূরে গিয়ে কাজ সারছেন। ফলে বন্যার পানি দূষিত হয়ে পড়েছে।

কামারজানি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুস ছালাম বলেন, তাঁর ইউনিয়নে মোট লোকসংখ্যা প্রায় ২০ হাজার। এর মধ্যে ৭০ ভাগ মানুষ অভাবী। নদীভাঙনেরও শিকার অভাবী লোকজন। কিন্তু সে অনুপাতে ত্রাণ বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। বন্যার কারণে এ পর্যন্ত ১৪ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছেন। প্রত্যেককে ১০ কেজি করে ১ হাজার ৪০০ জনের মধ্যে তা বিতরণ করেছেন। এ ছাড়া ২২০ প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। বর্তমানে তাঁর হাতে কোনো ত্রাণ নেই।

এ বিষয়ে সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) প্রসূন কুমার চক্রবর্তী বলেন, কামারজানি ইউনিয়নে অভাবী লোকের সংখ্যা বেশি ঠিক, কিন্তু অভাবী লোকের হিসাবে বরাদ্দ দেওয়া হয় না। প্রতিটি ইউনিয়নে মোট জনসংখ্যার ভিত্তিতে ত্রাণ বরাদ্দ দেওয়া হয়ে থাকে। কামারজানির বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।