কৃষকের ক্ষতি সাধন প্রমাণিত হলেও কোনো পদক্ষেপ নেই

নাটোরের গুরুদাসপুরে অনুমোদনহীন পুকুরের কারণে ৩৬০ হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধ সেই জমি দেখাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক হাবিবুর রহমান। ছবি: প্রথম আলো
নাটোরের গুরুদাসপুরে অনুমোদনহীন পুকুরের কারণে ৩৬০ হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। জলাবদ্ধ সেই জমি দেখাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্ত কৃষক হাবিবুর রহমান। ছবি: প্রথম আলো

কৃষিজমি ও নালা বন্ধ করে প্রভাবশালীদের অনুমোদনহীন ১৪টি পুকুরের কারণে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলার মশিন্দা ইউনিয়নের টেওসাগাড়ি বিলের ৩৬০ হেক্টর আবাদি জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। আমন ধান, পাট ও ভুট্টা নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। এতে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

টেওসাগাড়ি বিলের জলাবদ্ধতা নিয়ে প্রথম আলোতে গত ১০ জুন ‘জলাবদ্ধতায় বিপাকে হাজারো কৃষক’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন ছাপা হয়। এরপর উপজেলা প্রশাসন ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর নড়েচড়ে বসে। গঠন করা হয় তদন্ত কমিটি।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুল করিমকে প্রধান করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির অন্য দুই সদস্য হলেন বিএডিসির (ক্ষুদ্র সেচ) উপসহকারী প্রকৌশলী এফ এম তাজমির হোসাইন ও সহকারী কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. মজিবুর রহমান। স্থানীয় সাংসদ মো. আবদুল কুদ্দুস, উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তমাল হোসেন ও নাটোরের উপপরিচালককে ২৫ জুন তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, মশিন্দা ইউনিয়নের মশিন্দা মৌজা, সাহাপুর মৌজা ও শিকার মৌজা নিয়ে টেওসাগাড়ি বিল। টেওসাগাড়ি বিলের পানি নিষ্কাশনের নালা বন্ধ করে কৃষিজমিতে অনুমোদনহীনভাবে পুকুর খনন করেছেন ইল্টু সরদার, বাবলু প্রামাণিক, সরোয়ার মোল্লা, আফতাব খাঁ ও আলতাব ডাক্তার। তাঁদের পুকুরের কারণে ১৩৫ হেক্টর এবং অন্যদিকে আবদুল জব্বার, আবদুল মজিদ মণ্ডল ও শাহজাহান আলী মাস্টারের পুকুরের কারণে ২২৫ হেক্টর জমিতে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া আরও ছয় ব্যক্তির পুকুরের কারণে পরোক্ষভাবে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, মশিন্দা চরপাড়া ও শেখেরপাড়া ব্রিজ থেকে মরা নদীর পাড়ের শুকুর মিস্ত্রির বাড়ি পর্যন্ত দুই কিলোমিটার নালা পুনঃখনন করা হলে পানি নিষ্কাশনে সহায়ক হবে। রক্ষা পাবে খেতের ফসল।

কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টেওসাগাড়ি বিলটি কৃষকদের আশীর্বাদ। মাটির উর্বরতার কারণে ধান-পাট, রসুনসহ মসলা জাতীয় ফসল ফলে। অপেক্ষাকৃত কম সেচ ও সার ব্যবহার করে ভালো ফসল ফলে সেখানে। এতে আর্থিক দৈন্যে পড়তে হয় না স্থানীয় কৃষকদের। কিন্তু যথেচ্ছভাবে পুকুর খনন অভিশাপ হয়ে উঠেছে কৃষি ও কৃষকদের জন্য।

ভুক্তভোগী কৃষক হাবিবুর রহমানের অভিযোগ, টেওসাগাড়ি বিলে ১০ বিঘা জমিতে ধান করেছিলেন। ধান পেকেও গেছে। কয়েক পশলা বৃষ্টিতেই দেখা দিয়েছে জলাবদ্ধতা। পাকা ধান ঘরে তুলতে পারেননি তিনি। তাঁর মতো সমস্যা ভুট্টা, পাট ও তিলচাষিদের। বৃষ্টির পানি নামতে না পারায় মাঠের পর মাঠ কৃষিজমিতে জলাবদ্ধতায় ডুবে থাকায় মরে যাচ্ছে ফসল। রোপা আমন ও রবিশস্য আবাদ নিয়েও শঙ্কিত কৃষক।

তদন্ত প্রতিবেদনে কৃষিজমিতে অনুমোদনহীন পুকুর খনন ও জলাবদ্ধতা সৃষ্টি করে কৃষি ও কৃষকের ক্ষতি সাধন প্রমাণিত হলেও এখন পর্যন্ত অভিযুক্ত পুকুরমালিকদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এমনকি লিখিতভাবে সতর্কও করা হয়নি তাঁদের। অথচ জলাবদ্ধতায় ডুবে রয়েছে মাঠের পর মাঠ খেতের ফসল।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তমাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কোন প্রক্রিয়ায় কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা খতিয়ে দেখে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য উপজেলা কৃষি কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে।

উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. আবদুল করিম বলেন, আইনগত বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার এখতিয়ার। তিনিই ভালো বলতে পারবেন। তবে অভিযুক্ত পুকুরমালিকদের নিজ দায়িত্বে পানি নিষ্কাশনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে।

উপজেলা চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, কৃষি ও কৃষকদের স্বার্থে প্রয়োজনে তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসককে পাঠিয়ে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

পুকুরের মালিক ইল্টু সরদার, আবদুল মজিদ মণ্ডল ও শাহজাহান আলী মাস্টার মুঠোফোনে দাবি করেন, উপজেলা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই পুকুরগুলো খনন করা হয়েছিল। এখন শ্রমিক সংকটের কারণে পানি নিষ্কাশনের উদ্যোগ গ্রহণে দেরি হচ্ছে।