দক্ষিণ সিটিতে টাকা দিয়ে মশা মারা অযৌক্তিক মনে করছেন নগরবাসী

মশা। প্রতীকী ছবি
মশা। প্রতীকী ছবি

মশকনিধন সিটি করপোরেশনের প্রধান কাজের একটি। অথচ ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) টাকার বিনিময়ে বাসাবাড়ির মশা মারার একটি উদ্যোগ নিয়েছে। অনলাইনে আবেদনের মাধ্যমে নাগরিকেরা নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা জমা দিলে এই সেবা পাবেন। তবে করপোরেশনের এমন উদ্যোগকে অযৌক্তিক বলছেন নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞরা।

বাসাবাড়িতে গিয়ে ডেঙ্গু মশার প্রজননস্থল এডিসের লার্ভা ধ্বংস করতে ১ জুলাই থেকে অনলাইনে আবেদন কার্যক্রম শুরু করেছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। তবে গত পাঁচ দিনে কোনো বাসিন্দা এই সেবা নিতে আবেদন করেননি।

স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘যেহেতু আমরা গৃহকর দিচ্ছি, সেহেতু করপোরেশনকে এই সেবা বিনা মূল্যে দিতে হবে। পয়সা না দিলে জনগণকে সেবা দেবেন না, এটা করলে জনস্বাস্থ্যের হুমকি যাবে না। এটা কোনো সমাধান না। জনগণের ওপর দায়িত্বের অংশ হিসেবেই শহরব্যাপী তাদের এই কাজটি বিনা পয়সায় করতে হবে।’

আর নগরবাসী বলছেন, এটা তাঁদের জন্য নতুন করে উটকো ঝামেলা। তাঁরা সেবা পেতে কর দিচ্ছেন। বছরে তাঁরা বাসাবাড়ির যে কর দিচ্ছেন, এর মধ্যে পরিচ্ছন্নতা করও রয়েছে। করোনা মহামারির এই সময়ে এমন উদ্যোগ নেওয়া ঠিক হয়নি।

অবশ্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন (ডিএনসিসি) বলছে, দক্ষিণের মতো তারা টাকার বিনিময়ে বাসাবাড়িতে এডিসের লার্ভা ধ্বংস করার উদ্যোগ নেবে না। এ প্রসঙ্গে উত্তরের মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা প্রতিনিয়ত সচেতনতামূলক কাযর্ক্রম চালাবেন। এরপরও বাসিন্দারা সচেতন না হলেও পরবর্তী সময়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে।

এদিকে ডিএসসিসি পাঁচটি ক্যাটাগরিতে নগরবাসীর জন্য এই সেবা চালু করেছে। সেবাগ্রহীতাকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ সেবামূল্য হিসেবে দিতে হবে। আবেদনের পর তিন কার্যদিবসের মধ্যে এই সেবা প্রদান কার্যক্রম সম্পন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে সংস্থাটি।

>টাকার বিনিময়ে বাসাবাড়ির মশা মারার উদ্যোগের সমালোচনা করছেন নগরবাসী। গত পাঁচ দিনে কোনো বাসিন্দা এই সেবা নেননি।

করপোরেশনের ঘোষণা অনুযায়ী, জমে থাকা মশার লার্ভা বিনষ্ট করতে মশার প্রজননস্থলে কীটনাশক ছিটানোর সেবা নিতে হলে তিন কাঠা পর্যন্ত এক ইউনিট বাড়ির ক্ষেত্রে (৫ তলা পর্যন্ত) ২ হাজার টাকা দিতে হবে। ৩ থেকে ৫ কাঠা পর্যন্ত ফ্ল্যাট বাড়ির (প্রতি ফ্লোর) ২৫০০ টাকা। ৫ থেকে ১০ কাঠা পর্যন্ত অ্যাপার্টমেন্ট ১০ তলা পর্যন্ত (প্রতি ফ্লোর) ৩৫০০ টাকা। অ্যাপার্টমেন্ট ১০ তলার ওপরে বেজমেন্টসহ ৫০০০ টাকা এবং বাণিজ্যিক ভবনের জন্য ৮০০০ টাকা ফি ধার্য করা হয়েছে।

মশা মারার জন্য নির্ধারিত ফি বাস্তবসম্মত নয় বলে মনে করছেন নগরবাসী ও বিশেষজ্ঞরা। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ডিএসসিসির স্বাস্থ্য কর্মকর্তা মীর মোস্তাফিজুর রহমান এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

অনলাইনের মাধ্যমে এই সেবা উদ্বোধনকালে ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস বলেছিলেন, ‘কারও বাসাবাড়িতে বা বেজমেন্টে মশার লার্ভা বা লার্ভার বিস্তারক্ষেত্র রয়েছে কি না, সেটা আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব নয়৷ এ ধরনের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্যই বছরব্যাপী মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমের অংশ হিসেবে এখন থেকে ঢাকাবাসীর জন্য অনলাইনে আবেদনের ভিত্তিতে মশার প্রজননস্থলে কীটনাশক ছিটানোর উদ্যোগ নিয়েছি। আশা করি, এর মাধ্যমে ঢাকাবাসীকে ডেঙ্গুর প্রকোপ থেকে মুক্তি দিতে পারব।’

এ প্রসঙ্গে আরমানিটোলা সমাজ কল্যাণ সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এটা ইতিবাচক। কিন্তু যে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে, তা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত নয়। এটা আলোর মুখ দেখবে না। নতুন করে কোনো সেবা দিলে ফি নির্ধারণ করা যেতে পারে। তা নামমাত্র মূল্যে হওয়া উচিত ছিল।

অবশ্য সিটি করপোরেশন আইন, ২০০৯–এর চতুর্থ তফসিলের ২৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, করপোরেশন কোনো বিশেষ কাজ করলে এ জন্য ফি নির্ধারণ করতে পারে। সেই আলোকে চাইলে মশকনিধনের জন্য ফি নিতে পারে।

অনলাইন আবেদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত এক কর্মকর্তা বলেছেন, তাঁরা পরীক্ষামূলক আবেদন পেয়েছেন ২০টি। তবে কেউ টাকা জমা দেননি। টাকা জমা না দিলে এই আবেদন গ্রহণযোগ্য হবে না। যাঁরা আবেদন করেছেন, তাঁরা হয়তো দেখার চেষ্টা করেছেন পদ্ধতিটা কী, এতটুকুই।

রাজধানীর খিলগাঁওয়ের সামাজিক সংগঠন আলোকিত সবুজবাগের সভাপতি মনির হোসেন বলেন, ‘নগরবাসী গৃহকর দেবে। নগর কর্তৃপক্ষ নাগরিক সেবা দেবে। গৃহকর তো আমরা দিয়ে আসছি। আমি মনে করি, এমন উদ্যোগ নগরবাসীর জন্য কষ্টকর হবে। করোনাকালে এ ধরনের উদ্যোগ যথাযথ হয়নি। এটা নিয়ে আরও চিন্তাভাবনা করা দরকার ছিল।’

জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, টাকার বিনিময়ে এই সেবা চালু করলে অনেকেই এটি করবে না। ফলে জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি থেকে যাবে। এটা সিটি করপোরেশনের মূল পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের অংশ। জনস্বাস্থ্য রক্ষারজন্য সিটি করপোরেশনের যে দায়িত্ব রয়েছে, এটি তারই একটি অংশ। সেই হিসেবে তাদের বিনা টাকায় পরিচ্ছন্নতা কাজের অংশ হিসেবে এটি করতে হবে।