করোনা বলে 'করো'

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমি রান্না শিখে গেছি!! দারুচিনি বান, চকলেট মকা, আলফ্রেডোর মতো জমকালো কিছু না। কিন্তু এখন আমি রাঁধতে পারি মাছের মাথা দিয়ে মুড়িঘণ্ট, পাবদা মাছের ঝোল, কচুর শাক কিংবা চিংড়ি মাছ দিয়ে নারকেল ভুনা। দীর্ঘ সংসার জীবনে রেঁধেছি কদাচিৎ। অফিস থেকে ফিরলেই শাহানার ভাত, ডাল, মাছ, সবজি। অতিথি এলে তার পোলাও, কোর্মা, গরুর মাংস। কখনো নাহার, কখনো ফরিদা। কখনো বেনু থালা মেজেছে, বাথরুম ধুয়েছে, ঘর মুছেছে, কাপড় কেচেছে। কখনো চলেনি, কখনো চলেছে কিন্তু আমার ফিরে তাকাতে হয়নি। কিন্তু করোনাকালে হাত ধুতে ধুতে ভাগ্যরেখাটাই মনে হয় বদলে গেল আমাদের।

হঠাৎ আমরা দশাভূজা। সামলে নিচ্ছি হোম অফিস, বাড়ির প্রতিটি কাজ, স্বামী-সন্তানের চুল কাটা, বাগান করা, আবার এর ফাঁকে ছবি আঁকছি যে ছবি এক যুগেও আঁকা হয়নি। আমি একজনকে ১৫ বছর ধরে চিনি, মাত্র কালকে জানলাম সে ভীষণ সুন্দর ভাস্কর্য বানায়। এত দিন অফিস, বাসা, বাচ্চা, অনলাইন শপিং, চ্যাট আর রেস্তোরাঁতে ছিল যার জীবন।

আশপাশে হুটহাট চলে যাচ্ছে আত্মীয়স্বজন, পাড়া প্রতিবেশী। মুরুব্বিরা মাথার ওপর নেই। ১১৩ দিন ধরে বাড়িতে। তার পরও এই দুঃসময়ে বেঁচে থাকাটা শিখে গেছি। একই শহরে থেকে কোন মেয়ে কবে এত দিন মা-বাবার মুখ না দেখে কাটিয়েছে?

আমাদের হকারটা হঠাৎ মারা গেলেন লকডাউনে। জানি না সংসারের চিন্তায় কি না। পত্রিকা রাখা বন্ধ। অফিসের মিটিংয়ে বসেই ঠিক করলাম তাঁর পরিবারকে কিছু টাকা পাঠাব, মেয়ের কোচিংয়ের টাকাটা তো বেঁচে গেছে এপ্রিল-মে-তে।

আমাদের সঙ্গে বাড়ির ছেলেরাও শিখছে। বাঙালি পুরুষ স্বামী-বাবা আলু ছিলে দিচ্ছে, পরোটা ভেজে নিচ্ছে নিজেরটা, উইকেন্ডে খিচুড়িও পাকাচ্ছে। কেউ কেউ বাচ্চাকে গোসলে সাহায্য করছে, কেউ নিজের প্লেটটা ধুয়ে রাখছে। আশা করি তারা শিখে যাবে। রাষ্ট্র-সমাজ-ধর্মীয় কোটার বাইরে বেরিয়ে আসবে এই দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে।

শিখছে বাচ্চাটাও। আমি প্লেট ধুলে সে মুছে দেয়। নিজের ঘরটা দুদিন পরপর হলেও গোছায়, মপ করে। কথায় কথায় ‘বেনু আপু, ফরিদা‘পু’-নির্ভর বাচ্চাটা এখন ইউটিউব দেখে ফ্রেঞ্জফ্রাই বানায়। মা-বাবা জুম মিটিং করে, সে করে অনলাইন ক্লাস। মাকে নিয়ে টিকটক প্ল্যান করে। ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স নিয়ে তারাও যুক্ত হচ্ছে একটু একটু করে।

আমাদের এই শেখাটা অনেক দামে কিনতে হচ্ছে। করোনা আরও কাছে আসছে প্রতিদিন। কাল আছি কি না, জানি না। তবু যতক্ষণ বেঁচে আছি চুলা জ্বলবে, ইয়াসিন সুরা খতম, বাচ্চার স্কুল, অফিসের রেভেন্যু টার্গেট চলবে। আর কোনো দিন বন্ধু স্বজনকে দেখা হলে জড়িয়ে ধরতে পারব কি না, নতুন শিশুটিকে কোলে তুলে নেওয়া হবে কি না, কে জানে। তবু যতক্ষণ আছি, ভালো কিছু সঙ্গে থাক। কিছু শিক্ষা স্থায়ী হোক, কিছু আত্মশুদ্ধি পৃথিবীর ভুল ভাঙিয়ে দিক। শুভ কামনা সবার জন্য।

*পোর্টফলিও ম্যানেজার, জিপি এক্সেলেরেটর, গ্রামীণফোন লিমিটেড। [email protected]