পূর্ণিমাবিলাসের বাসনা

করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]
পূর্ণিমাটা আবার একসঙ্গে কাটাতে চাই। ছবি: লেখক
পূর্ণিমাটা আবার একসঙ্গে কাটাতে চাই। ছবি: লেখক

আমার চন্দ্রসৌন্দর্যের উপলব্ধি আসে গত বছর, যখন অ্যাডমিশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। এর আগে বিশেষ করে শহরে আসার পর চাঁদ দেখার তেমন একটা সুযোগই হয়নি।

ক্লাস সিক্স থেকে একাদশের প্রায় শেষ পর্যন্ত যে বাসাটায় থাকতাম, সেখানে আমরা ছিলাম নিচতলায়, জানালা ছিল শুধু উত্তর দিকে, আর সে পাশটাও গাছগাছালিতে ঘেরা, তাই দিনের বেলায়ও ঠিকঠাক আকাশই দেখা যেত না, রাতের বেলা চাঁদ দেখা তো দূরের কথা।

এরপরে পুরোনো সেই বাসাটা ভেঙে আবার নতুন করে বানানো শুরু হলো। আমরা প্রায় তিন মাসের জন্য নতুন একটি বাসায় উঠলাম। সেখানে পরিবেশ একদম খাঁটি শহুরে আবাসনের মতো। চারপাশে ঘিঞ্জি পরিবেশে বিল্ডিং দিয়ে ঘেরা, সূর্যের আলোও ঘরে ঢুকতে পারে না, ভাড়াটেদের ছাদে যাওয়া নিষেধ। তাই দ্বাদশের আগ পর্যন্ত রাতের আকাশ দেখার তেমন কোনো সুযোগই ছিল না।

কিন্তু এর মধ্যে হয়তো, সন্ধ্যাবেলা শুরু হওয়া কোনো প্রাইভেট যখন রাত আটটা সাড়ে আটটায় শেষ হতো, তখন বাসায় ফেরার পথে একটু ক্ষণেক আকাশের দিকে তাকাতাম। অধিকাংশ সময়ই দেখতাম, তিনটা কাছাকাছি থাকা তারা মিলে প্রায় একটা সরলেখা তৈরি করে ফেলেছে। ‘প্রায়’ বলছি, কারণ, মাঝের তারাটা একটু বাঁয়ে সরানো আছে বলে মনে হতো। পরে জেনেছিলাম যে ওই সরলরেখাটাকে ওরিয়ন বেল্ট বলে।

পুরোনো বাসা ভেঙে নতুন বাসা বানানোর পর আমরা সেখানে ফিরে এলাম। তখন আকাশ দেখার সুযোগ একটু বেড়েছিল। কিন্তু তখনো আমার রুমের জানালা আর বেলকোনি থেকে ভিজিবল এরিয়ার মধ্যে চাঁদ আসত গভীর রাতে, একটা বা দুইটার পরে। আর সে সময় কিছুটা রাত জাগার অভ্যাস থাকলেও সেটা শুধুই মোবাইল গুঁতাগুঁতিতে সীমাবদ্ধ।

বিশেষভাবে চাঁদের প্রতি মুগ্ধতা তৈরি হয় তখন, যখন রাত তিনটার সময় বালিশে মাথা রাখলে বিছানার পাশের জানালা, আর জানালা থেকে দুই ফুটের কম দূরত্বে থাকা পাশের বাসার দেয়াল মিলে তৈরি হওয়া সরু একটু ফাঁকা জায়গার মধ্যে দিয়ে রুপালি আলো এসে পড়ত বিছানার ওপর। কখনো কখনো যে রাতে দৈবাৎ এ ঘটনা ঘটতে দেখতাম, পরের রাতে ইচ্ছে করে জেগে থাকতাম, আবার সেই সুইট মোমেন্টটা পাওয়ার জন্য।

দিন গড়াল, এইচএসসি শেষ হলো, অ্যাডমিশন এল। তখন ফোন টিপাটিপির উদ্দেশ্যে রাত জাগার সুখের দিন শেষ হলো। বাধ্য হয়ে পড়াশোনার জন্য রাত জাগার দিনের আগমন ঘটল। সারা দিন প্রতিটি সময়ই শুধুই পড়াশোনা আর পড়াশোনা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকত। ফিজিকস প্রাইভেটে পরীক্ষা শেষে বাসায় ফিরতে যখন হাঁটতাম, তখনো মনে মনে না–পারা অঙ্কগুলো কোন সূত্রে হবে, সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা করতাম। কখনো কখনো সেটা পেয়েও যেতাম, আর তখন লাগত আফসোস। ‘ইশ্‌! পরীক্ষার টাইমে আরেকটু ভাবলেই হয়তো এই অঙ্কটা করতে পারতাম।’ কিন্তু প্রতিটা অঙ্কের জন্য যেখানে মাত্র তিন মিনিট বরাদ্দ, সেখানে আর কতই বা ভাবা যায়। অবশ্য আমার ক্ষেত্রে খুব কম সময়ই এ রকম হয়েছে, কোনো অঙ্ক আমি পারতাম, কিন্তু সময়ের অভাবে সেটা করতে পারিনি। কারণ হয়তো এই, একটা অঙ্ক দেখার পর সেটা সমাধান করা সম্ভব কি না, এ ব্যাপারটি আমি দ্রুত বুঝতে পারতাম। তাই পারব কি পারব না, সেই ডিসিশন নিতে আমার খুব কম সময় নষ্ট হতো। যেটা পারব না বলে মনে হতো, সেটা সঙ্গে সঙ্গে স্কিপ করতাম। তবুও প্রাইভেট শেষে বাসায় ফেরার আগেই যখন মনে মনে আরও দুটি অঙ্কের সমাধান খুঁজে পেতাম কিংবা করে আসা একটা অঙ্কে ভুল বুঝতে পারতাম, তখন নিজের ওপর একটু একটু রাগ লাগত।

বাসায় ফিরে কোনোমতে ড্রেস চেঞ্জ করেই পরের দিনের হোমওয়ার্ক রেডি করতে আবার টুল নিয়ে অঙ্ক করতে বসে যাওয়া। বসে থেকে থেকে পিঠব্যথা হয়ে গেলে খাটে উঠে বালিশ হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে থাকতাম, তখনো হাতে বই নিয়ে কোনো না কোনো অঙ্কের সমাধান দেখছি। মাঝেমধ্যে এমনও হয়েছে যে ঘুমের মধ্যেও স্বপ্নে দেখছি যে মাসনাদ ভাই বোর্ডে একটা পুলির স্ট্রাকচার এঁকে ত্বরণ বের করার সূত্র বোঝাচ্ছেন।

রাতগুলো খুব কষ্টে গেছে। দুপুর থেকে টুলে বসা, বিকেলে হয়তো আধা ঘণ্টার রেস্ট বা কোনো কোনো দিন সেটাও নেই। গভীর রাতে মাঝেমধ্যে এমন একটা সময় আসে, যখন ব্রেন এতটা টায়ার্ড হয়ে যায় যে একটা অঙ্ক তিনবার পড়েও বুঝতে পারি না কী কী ডেটা দেওয়া আছে আর কী কী ডেটা বের করতে বলেছে। কিংবা হয়তো একটা খুব কঠিন অঙ্ক অনেক মনোযোগ দিয়ে বোঝার পর ব্রেইন নিজে থেকেই বিদ্রোহী হয়ে উঠত। আর একটা সেকেন্ডও এতটা অ্যাটেনশন কন্টিনিউ করা যাবে না।

তখন একটু ব্রেক নিতাম। বেলকোনিতে যেতাম। আর তখন চাঁদটা ঠিক চোখের সামনেই থাকতো। চাঁদ দেখতাম আর ভাবতাম, কতই না দূরে আছে সে, কতই না সুন্দর দেখতে! প্রাচীন যুগে মানুষেরা যে চাঁদকে ডিভাইন কিছু ভাবত, সেই ব্যাপারটা তখন আর অবাক করা মনে হতো না। অথচ এই চাঁদেও মানুষ পৌঁছাতে পেরেছে। তাহলে মনুষ্য টেকনোলজির উন্নতি কত উঁচুতে পৌঁছে গেছে! কী দুর্দান্ত গতিতে তা আগাচ্ছে! আমাকে এই গতির অংশ হতে হবে। সারা জীবন শুধু সিভিলাইজেশনের সুবিধাগুলো ভোগ করে গেলেই চলবে না। বরং অবদানও রাখতে হবে অন্তত কিছু। পারলে অনেক বেশিই। আমাকে ভালো একজন ইঞ্জিনিয়ার হতেই হবে। আর সে জন্যই আমাকে বুয়েট/চুয়েট/কুয়েট/রুয়েটের যেকোনোটাতে কোনো একটা টপ সাবজেক্টে চান্স পেতেই হবে।

হয়তো এতে অবসাদ কেটে গিয়ে নতুন উদ্যম আসত না। কিন্তু মানসিক শক্তিটুকু রিনিউ হতো। তাতে পরের দিনের যুদ্ধের আগেই ক্লান্ত হয়ে যেতাম না।

আমাদের অ্যাডমিশন টেস্টগুলো হয়েছিল মূলত দুটি ফেজে। প্রথম ফেজ ২০ সেপ্টেম্বর থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর। এরপর প্রায় দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে একটা ব্রেক। এরপরে আবার দ্বিতীয় ফেজ শুরু হয় ১১ অক্টোবর থেকে। দ্বিতীয় ফেজের সব এক্সামগুলো আমি একা একা গিয়ে দিয়েছিলাম, উদ্ভাসের বাসে। ১৪ তারিখ বুয়েটের এক্সাম দিয়ে ফেরার পথে জানালার পাশে সিট পেয়েছিলাম। সন্ধ্যার পরে যখন বাইরে তাকালাম, তখন দেখি সেই পূর্ণিমার চাঁদ। ভোর পাঁচটায় না খেয়েই বের হয়ে বুয়েটে গিয়ে বসে থাকা, এক্সাম শেষে গরমের মধ্যে ভিড় ঠেলে বাইরে আসা, বাসে সিট না পাওয়ার অনিশ্চয়তা, বাস ছাড়ার পরে ঢাকার জ্যামে বসে একটু পরপর ঝাঁকি খাওয়া—সবকিছু মিলিয়ে যে ক্লান্তি জেঁকে বসেছিল, তা কেমন যেন আস্তে আস্তে ধূসর হয়ে গেল, যখন ডান পাশে ফিরে বাসের সিটে মাথা রেখে জানালার বাইরে চাঁদের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। সিরাজগঞ্জ-নাটোরের গ্রাম্য এলাকা দিয়ে যখন বাস চলছিল, কখনো কখনো ফলের গাছের ওপর চাঁদের আলোর কুয়াশার স্তর পড়েছে বলে মনে হচ্ছিল কিংবা ফসলের খেতে জমে থাকা পানিতে চাঁদের প্রতিফলন হচ্ছিল, আবার কখনো খোলা মাঠে চাঁদের আলোয় স্বপ্নের দুনিয়া বলে ভ্রম হচ্ছিল।

এরপরে কুয়েটের পরীক্ষা দিয়েও ফেরার পথে জানালার ধারে সিট পেয়েছিলাম। তখন পূর্ণিমা থেকে চাঁদ কমতে শুরু করেছে। কিন্তু সেই আধচাঁদা আলোও কম উপভোগ্য ছিল না। তখন থেকেই মনে একটা ইচ্ছা তীব্র তৈরি হতে থাকে যে অ্যাডমিশন শেষে কোনো এক পূর্ণিমার রাতে আমার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে রাজশাহীর কোনো লাইটপল্যুশন মুক্ত জায়গাতে যাব, পূর্ণিমা দেখব, একসঙ্গে গল্প করতে করতে হাঁটব।

অক্টোবর শেষে নভেম্বরেও সবার পরীক্ষা শেষ হয়েছিল না, তাই নভেম্বরের পূর্ণিমায় একসঙ্গে বের হওয়া হয়নি। কিন্তু ডিসেম্বরে যখন সবাই মোটামুটি এক্সাম শেষ করে ফেলেছে, তখন এলে সেই সুবর্ণ সুযোগ।

রাজশাহী আসলে খুব বড় শহর নয়। এখানে একজনের বাসা থেকে আরেকজনের বাসায় যেতে সিএনজি বা লোকাল বাসে চড়তে হয় না। হেঁটে হেঁটেই যাওয়া যায়। সে রাতে হেঁটে হেঁটে এসেই আমরা কয়েকজন বন্ধু একত্র হয়েছিলাম। আগপিছ না ভেবেই সিটি বাইপাসের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করেছিলাম, যতক্ষণ না পা টলতে শুরু করে ক্লান্তিতে। কিলোমিটারের পর কিলোমিটার পিচঢালা পথ, দুপাশে কখনো জঙ্গল, কখনো বাগান, কখনো ফসলের খেত। শহরের ধাতব যান্ত্রিক কোলাহল থেকে দূরে ঝিঁঝিপোকার নিরন্তর সংগীত। হালকা একটু বাতাস বইছিল, তাতে হাঁটার ঘাম শুকাচ্ছে আর জ্যোৎস্নার আলোতে নেশা ধরানো স্বপ্নে বিচরণরত ছিলাম কয়েকজন কিশোর। শীতের রাতে রাজশাহী শহরের গাছপালার তোরণ দেওয়া পথে কুয়াশার সঙ্গে চাঁদের আলোর মিশ্রণে হেঁটে যাচ্ছে পরিবার-বিধিনিষেধ থেকে সদ্য স্বাধীন হওয়া কয়েকজন কিশোর।

কিশোর নাকি যুবক? কী জানি এখন আমরা কী...।

এরপরের পূর্ণিমাটা আমাদের আর একসঙ্গে কাটানো হয়নি। ৬ জানুয়ারি থেকে আমার ক্লাস শুরু হয়। আর কখনো হয়তো বন্ধুদের সঙ্গে পূর্ণিমার আলোয় নিস্তব্ধ পথে হাঁটতে পারব না, এই আফসোস মনের মধ্যে রয়েই গিয়েছিল।

১৫ মার্চ লকডাউন শুরু হলো, সেই থেকে একে একে খুব সম্ভব তিনটা পূর্ণিমার চাঁদ, বাধ্য হয়ে ঘরে বসেই দেখলাম। এখন হিসাব রাখতেই ভুলে গেছি। আজকে পূর্ণিমা নিয়ে লিখতে বসলাম, কারণ, আজ রাতে আবার পূর্ণিমা চলছে। আষাঢ়ে মেঘের সঙ্গে চাঁদের লুকোচুরি দেখতে ভালোই লাগছে। মাঝেমধ্যে মেঘে পুরো চাঁদ এমনভাবে ঢেকে যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন আজ পূর্ণিমা তো নয়ই, বরং অমাবস্যা চলে। হয়তো এটা লকডাউনের চতুর্থ পূর্ণিমা। পূর্ণিমা চলছে, বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি, আমরা সব বন্ধুই রাজশাহীতে যার যার বাসায় বসে, অথচ এই পূর্ণিমা একসঙ্গে উপভোগ করতে পারছি না। ঠিক যেমন চাঁদের আলোও রুপালি কুয়াশার মতো মনে হলেও সেই আলো হাত দিয়ে স্পর্শ করতে পারি না। আচ্ছা, চাঁদ কি পৃথিবীর মানুষদের এই দুর্দশা দেখে মনে মনে হাসছে। কেন তাকে আজকে একটু বেশিই উজ্জ্বল অনুভব করছি?

*শিক্ষার্থী, ডিপার্টমেন্ট অব কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং, ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি। [email protected]