করোনা চিকিৎসাসেবাসহ সাহেদের নানা প্রতারণা

মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম
মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিম

রিজেন্ট গ্রুপের ওয়েবসাইটে মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের বেশ বড়সড় বাণী আছে। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি ওই বাণী দিয়েছেন, যার মোদ্দাকথা বিশ্বায়নের এই তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ সময়েও তাঁর মূল লক্ষ্য হলো মানবসেবা, ভোক্তাদের সর্বোচ্চ সন্তুষ্টি অর্জন, দেশ ও দশের উন্নয়ন।

গত সোমবার র‌্যাব রিজেন্ট গ্রুপের মালিকানাধীন দুটি হাসপাতালের ‘মহতী’ কর্মকাণ্ডের কিছু প্রমাণ জাতির কাছে হাজির করে। হাসপাতাল দুটিতে করোনার নমুনা নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া হতো। বিনা মূল্যে চিকিৎসার কথা বলে মোটা অঙ্কের টাকা আদায় করত। ২০১৪ সালের পর লাইসেন্স নবায়ন না করেই হাসপাতাল দুটি চালানো হচ্ছিল। আর করোনা সংক্রমণের পর থেকে সাহেদ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার লাগানো নম্বরবিহীন গাড়ি ব্যবহার করছিলেন।

গতকাল মঙ্গলবার উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালটি সিলগালা করে দেয় র‌্যাব। তবে সাহেদ করিমকে গ্রেপ্তারের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। ফোন বন্ধ থাকায় তাঁর সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।

বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসতে থাকে, এই সাহেদ করিম আদতে একজন প্রতারক। যদিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি নিজের যে পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তাঁকে প্রভাবশালী বলেই মনে হয়। ফেসবুকে নিজের পরিচয় দিয়েছেন আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক কমিটির সদস্য; ন্যাশনাল প্যারা অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট; রিজেন্ট ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, রিজেন্ট কেসিএস লিমিটেড, কর্মমুখী কর্মসংস্থান সোসাইটি, রিজেন্ট হসপিটাল লিমিটেড ও রিজেন্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান। সেন্টার ফর পলিটিক্যাল রিসার্চ নামে একটি প্রতিষ্ঠানেরও চেয়ারম্যান তিনি। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপকমিটির সাধারণ সম্পাদক শাম্মী আহমেদ বলেছেন, সাহেদ করিম কমিটির সদস্য নন। তিনি মাঝে মাঝে বৈঠকে আসতেন। আগে কোনো একসময় সদস্য ছিলেন।

ছবি আছে সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে ক্ষমতাসীন দলের মন্ত্রী ও সাংসদদের সঙ্গে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর শীর্ষস্থানে থাকা লোকজনের সঙ্গেও ছবি আছে। র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক সারওয়ার বিন কাশেম বলেছেন, দুষ্টু লোকেরা নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে প্রভাবশালী লোকজনের সঙ্গে ছবি তোলেন।

পুলিশ সদর দপ্তরের দায়িত্বশীল সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, বছর তিন-চারেক আগে তিনি নিয়মিত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কক্ষে ঘোরাঘুরি করতেন। তবে ঘন ঘন টকশোতে আলোচক হিসেবে উপস্থিত থেকে তিনি নিজের প্রভাব বাড়িয়েছেন। নতুন কাগজ নামের একটি পত্রিকার সম্পাদক হয়েছেন সম্প্রতি। নিজেকে উত্তরা মিডিয়া ক্লাবের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও পরিচয় দিয়ে থাকেন।

সাহেদ করিমের গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায়। ওখানে তাঁদের করিম সুপার মার্কেট নামের একটি বিপণিবিতান ছিল। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় সাতক্ষীরা থেকে ঢাকায় চলে আসেন। তবে মাঝে মাঝে সাতক্ষীরায় যেতেন। তাঁর মা সাফিয়া করিম ২০০৬-০৭ সালের দিকে স্থানীয় মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। স্থানীয় লোকজন জানান, নানা পরিচয়ে তিনি লোকজনের টাকা মেরেছেন।

২০০৯ সালে প্রতারণার অভিযোগে পুলিশ ও র‌্যাব তাঁকে গ্রেপ্তার করেছিল। ওই মামলার কাগজপত্রে দেখা যায়, খুলনার একটি টেক্সটাইল মিলের জন্য দুই টনের ১০টি ও দেড় টনের ১৫টি এসি সরবরাহের কার্যাদেশ পেয়েছিল সাহেদ করিমের প্রতিষ্ঠান। জিনিসপত্র নিয়ে ১৯ লাখ টাকার চেক দিয়েছিলেন রাইজিং শিপিং অ্যান্ড ট্রেডিং কোম্পানি এবং রাইজিং রিয়েল এস্টেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান সাহেদ করিম। অ্যাকাউন্টে টাকা না থাকায় চেকটি প্রত্যাখ্যাত হয়। এ ঘটনায় মামলা করে বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানটি। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওমর আলী ওই সময় প্রথম আলোকে বলেছিলেন, সাহেদ একজন পেশাদার প্রতারক। শাহবাগ, লালবাগ, আদাবর, তেজগাঁওসহ বিভিন্ন থানায় তাঁর নামে প্রতারণার মামলা আছে।

সূত্রগুলো জানায়, ২০১১ সালে তিনি ধানমন্ডিতে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে বহুধাপ বিপণন (এমএলএম) ব্যবসা শুরু করেছিলেন। পরে টাকা নিয়ে চম্পট দেন। ওই সময় প্রতারণার শিকার লোকজন তাঁকে খুঁজতে শুরু করলে তিনি ভারতে পালিয়ে যান। তাঁর প্রতিবেশীরা জানান, কয়েক বছর তিনি বারাসাতে ছিলেন সপরিবার। পরে মামলাগুলোয় জামিন পেলে দেশে ফিরে এসে ব্যবসা শুরু করেন।

একে একে এই সাহেদ করিম রিজেন্ট হসপিটাল লিমিটেড (মিরপুর), রিজেন্ট হসপিটাল লিমিটেড (উত্তরা), ঢাকা সেন্ট্রাল কলেজ, রিজেন্ট ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, হোটেল মিলিনা গড়ে তোলেন। তবে স্বভাব বদলাতে পারেননি বলে অভিযোগ ফেনীর জুলফিকার আলী ভুট্টোর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাহেদ করিমের মালিকানাধীন রিজেন্ট কেসিএস পূর্বাচল প্রজেক্টে বালু সরবরাহের কাজ পেয়েছিল তাঁর প্রতিষ্ঠান রুসাফা কনস্ট্রাকশন। সিলেট থেকে বালু সরবরাহের পর সাহেদ করিম তাঁর পাওনা ৪২ লাখ ৫৭ হাজার ৫৫৯ টাকা দেননি। উল্টো একদিন অফিসে ডেকে নিয়ে সন্ত্রাসীদের দিয়ে পেটানো হয়। তারপর ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পে সই নিয়ে মেরে গুম করে ফেলার হুমকি দেন। গত বছরের ৩১ অক্টোবর এ ঘটনায় উত্তরা পশ্চিম থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন ভুট্টো।

>নমুনা নিয়ে ভুয়া রিপোর্ট। এমন হাসপাতালকে কোভিড চিকিৎসার দায়িত্ব দেওয়া নিয়ে প্রশ্ন।

বেশ কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে যে সাহেদ করিম কখনো মেজর, কখনো সচিব, আবার ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রীর এপিএস হিসেবেও নিজের পরিচয় দিয়েছেন। মার্কেন্টাইল কো-অপারেটিভ থেকে ছয় কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার নথিতে নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল হিসেবে জাহির করেন। এ বিষয়ে আদালতে দুটি মামলা চলছে। সাহেদের বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় দুটি, বরিশালে একটি, উত্তরা থানায় আটটি মামলাসহ রাজধানীতে ৩২টি মামলা রয়েছে। তবে মামলাগুলোর বিষয়ে পুলিশ সদর দপ্তর নিশ্চিত তথ্য দিতে পারেনি। অপরাধের পরিসংখ্যান লিপিবদ্ধ থাকে যে বিভাগে, সেটির একজন কর্মকর্তা বলেছেন, সাহেদের নামে কোনো মামলার রেকর্ড নেই। অন্য নামে থাকতে পারে। খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে।

এদিকে রিজেন্ট গ্রুপের ওয়েবসাইটে নিজেদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহযোগী হিসেবে জানান দিয়েছিল রিজেন্ট হাসপাতাল। কেউ অসুস্থ হলেই হটলাইনে ফোন করার কথা সেখানে বলা আছে। কিন্তু সোমবার রাতে সাহেদ করিম প্রথম আলোকে বলেন, বিনা মূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার কোনো প্রতিশ্রুতি তিনি দেননি।

গতকাল ভুক্তভোগী এক ব্যক্তি প্রথম আলোকে জানান, তিনি সাত দিন রিজেন্ট হাসপাতালে ছিলেন। দুই দিন অক্সিজেন লেগেছিল। পরিশোধ করতে হয়েছে ৮০ হাজার টাকা। এ ছাড়া তাঁর ও পরিবারের সদস্যদের নমুনা পরীক্ষার নামে খরচ পড়েছে ৩০ হাজার টাকা। অধিদপ্তরের ঘোষণা শুনে তিনি ওই হাসপাতালে গিয়েছিলেন। কিন্তু এত টাকা দিতে হবে তিনি কল্পনাও করেননি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সবই জানত
জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের (নিপসম) পরিচালক বায়েজীদ খুরশিদ রিয়াজ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে গত ৭ জুন চিঠি দিয়েছিলেন রিজেন্টের অপকর্ম নিয়ে। এতে বলা হয়, রিজেন্ট হাসপাতাল নমুনা পরীক্ষার জন্য সাড়ে তিন হাজার টাকা করে আদায় করছে। অথচ সরকার বিনা মূল্যে আরটি-পিসিআর পরীক্ষা করে দিচ্ছে। নিপসম থেকে পরীক্ষার ফলাফল জানানোর জন্য যে এসএমএস প্রত্যেক নমুনা প্রদানকারীকে পাঠানো হচ্ছে, তাতেও বিনা মূল্যে এই সেবা দেওয়ার বার্তা থাকছে।

ওই চিঠির পরও অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা রিজেন্ট থেকে দিনে ৫০টি নমুনা সংগ্রহের নির্দেশ দেন। এ বিষয়ে জানতে নাসিমা সুলতানার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর্মকর্তাদের দাবি, শুরুতে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল কোভিড রোগীর চিকিৎসা দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছিল না। তাই তাঁরা সরল বিশ্বাসে রিজেন্টকে দায়িত্ব দেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো খোঁজখবর না নিয়ে, এই হাসপাতালের দক্ষতা যাচাই না করে কীভাবে কোভিড চিকিৎসাসেবা দেওয়ার সুযোগ দিল, তা জানতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তাঁরা আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য দেননি। তবে সন্ধ্যায় সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছেন যে ওই হাসপাতালের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমএ) সাবেক সভাপতি অধ্যাপক রশিদ-ই-মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, এমন একটি হাসপাতালকে চিকিৎসার দায়িত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয় নিয়েছে বলে তিনি মনে করেন না। ক্ষমতাবানেরা এর পেছনে থাকতে পারেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেস (বিআইএইচএস) সরকারকে সহযোগিতা করতে চেয়েছিল। চিঠিও দিয়েছিল। টাকাপয়সাও চাওয়া হয়নি। তারপরও বিআইএইচএসকে অনুমতি দেওয়া হয়নি। রশিদ-ই-মাহবুবের ধারণা, এমন পর্যায় থেকে এই সিদ্ধান্ত এসেছে, যেটা প্রতিরোধ করার ক্ষমতা অধিদপ্তর বা মন্ত্রণালয়ের নেই।