করোনা মোকাবিলায় চল্লিশের বেশি কমিটি, কাজ নিয়ে প্রশ্ন

করোনা মোকাবিলায় একের পর এক কমিটি তৈরি করছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। অনেক কমিটির কোনো সভা এখনো হয়নি। সর্বশেষ ১০টি কমিটি করেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ নিয়ে কমিটির সংখ্যা দাঁড়িয়েছে চল্লিশের বেশি। এত কমিটির কাজ কী, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

দেশের একাধিক বিশিষ্টজনকে কিছু কমিটিতে রাখা হয়েছে তাঁদের সম্মতি ছাড়াই। আবার কোনো কমিটি বিলুপ্ত হলেও সদস্যদের তা জানানো হয়নি। কোনো কোনো ব্যক্তির নাম চার-পাঁচটি কমিটিতেও দেখা যাচ্ছে। একটি কমিটি নিয়মিতভাবে সন্ধ্যার পর সভা করছে।

গত দুই দিন এই প্রতিবেদক স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একজন পরিচালককে সকাল, দুপুর ও সন্ধ্যায় ফোন করেছেন। প্রতিবারই ওই কর্মকর্তা বলেছেন, তিনি গুরুত্বপূর্ণ সভায় ব্যস্ত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কমপক্ষে ৪৩টি কমিটি করেছে। কেউ কেউ এতে ব্যস্ত থাকেন।

করোনা পরিস্থিতি জানা-বোঝা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার জন্য যে তথ্য-উপাত্ত দরকার, তা জনস্বাস্থ্যবিদ ও গবেষকেরা পাচ্ছেন না। নমুনা সংগ্রহ ও রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা সন্তোষজনক না। দেশে সংক্রমণের হার কত, তা-ও জানা নেই। আস্থা না থাকায় মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নেওয়া থেকে বিরত থাকছেন, কোভিড ও নন-কোভিড হাসপাতালে শয্যা খালি পড়ে আছে। রাজধানীসহ দেশের বহু এলাকায় আক্রান্ত ব্যক্তির সংস্পর্শে আসা ব্যক্তি খোঁজা বা কন্ট্যাক্ট ট্রেসিং কার্যত বন্ধ। লকডাউন (অবরুদ্ধ) নিয়ে কর্তৃপক্ষ কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না। গত চার মাসে জমা হওয়া এসব সমস্যা দূর না করে নতুন কমিটি তৈরির কাজে ব্যস্ত উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘কমিটি গঠনের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে করোনা মোকাবিলায় জাতীয় পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। কিন্তু শুরু থেকে যেভাবে ও যে ধরনের কমিটি হয়েছে ও এখনো হচ্ছে, তাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন পুরোপুরি সম্ভব হয়নি, হবে না।’

করোনা মোকাবিলার জাতীয় পরিকল্পনা দলিলটি (ন্যাশনাল প্রিপেয়ার্ডনেস অ্যান্ড রেসপন্স প্ল্যান ফর কোভিড-১৯) তৈরি হয়েছিল গত মার্চে। ৩ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সভাকক্ষে পরিকল্পনা নিয়ে প্রথম আন্তমন্ত্রণালয় সভা ডেকেছিল কোভিড মোকাবিলায় গঠিত ন্যাশনাল অ্যাডভাইজারি কমিটি। কমিটির সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। ওই দিন জাতীয় পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা শুরুর আগেই সভা শেষ হয়ে যায়। জাতীয় পরিকল্পনা ব্যাপকভিত্তিক আলোচনা ছাড়াই তা অনুমোদন পায়। এ পর্যন্ত পরিকল্পনা দলিলের সাতটি সংস্করণ হয়েছে।

কমিটি থাকে, থাকে না

জাতীয় পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল মূলত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নানা পরামর্শ ও দলিল অনুসরণ করে। ৩ মার্চের সভায় এর তৃতীয় সংস্করণ বিলি করা হয়েছিল। এই পরিকল্পনা দলিলে ১১টি কমিটি গঠনের কথা বলা হয়েছিল। তালিকার শুরুতে ছিল ন্যাশনাল অ্যাডভাইজারি কমিটি। এর সভাপতি স্বাস্থ্যমন্ত্রী।

এই কমিটি করোনা মোকাবিলায় যথাযথ ভূমিকা রাখতে পারেনি। এমনকি অনেক সিদ্ধান্ত হয়েছে এই কমিটিকে পাশ কাটিয়ে। গত এপ্রিলে বাংলাদেশ কলেজ অব ফিজিশিয়ান্স অ্যান্ড সার্জনস (বিসিপিএস) মিলনায়তনে আয়োজিত বৈঠকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছিলেন, ‘ন্যাশনাল কমিটির চেয়ারম্যান আমাকে করা হয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে। যেসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো আমাদের নলেজে নেই।’

স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এই কথা নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছিল। প্রশ্ন উঠেছিল সিদ্ধান্ত কোথা থেকে আসছে। অন্য জায়গা থেকে সিদ্ধান্ত এলে জাতীয় কমিটির দরকার কী। এই কমিটির কথাও এখন আর শোনা যায় না।

পরিকল্পনা দলিল অনুযায়ী দেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি গঠিত হয়েছিল এবং এখনো তা কার্যকর আছে।

পরিকল্পনা দলিলের তৃতীয় সংস্করণে কমিটি ছিল ১১টি। পঞ্চম সংস্করণে কমিটি কমে হয় ৬টা। আবার সপ্তম সংস্করণে এসে দেখা যাচ্ছে কমিটির সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৩টি। কমিটি কেন কমল বা বাড়ল, তার ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

কেন কমিটি তৈরি হয়

জুনের শুরুতে লকডাউন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। রাজধানীর পূর্ব রাজাবাজারে পরীক্ষামূলক লকডাউন শুরু হয় ৯ জুন রাত থেকে। তখন জানা যায়, তথ্য না থাকার কারণে বিশেষজ্ঞরা লাল, হলুদ ও সবুজ এলাকা চিহ্নিত করতে পারছেন না। হঠাৎ ১০ জুন ১৩ সদস্যের কেন্দ্রীয় কারিগরি গ্রুপ গঠন করা হয়। এর প্রধান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ। তখন আরও দুটি কারিগরি কমিটি বহাল ছিল।

এর আগে ৮ জন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তৈরি করেছিল পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটি। গত মার্চ মাস থেকে এই কমিটি নানা সুপারিশ করে আসছে। কমিটির একজন সদস্য গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, ‘আমাদের কোনো পরামর্শে কাজ হচ্ছে না। মানসম্মান রেখে কীভাবে বিদায় হব, সেই রাস্তা খুঁজছি।’

অন্যদিকে বাংলাদেশ অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের সভাপতি মোহাম্মদ সহিদুল্লাকে আহ্বায়ক করে এপ্রিল মাসে ১৯ সদস্যের জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি গঠন করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এই কমিটিরও পাঁচটি উপকমিটি আছে। এরা অনেক সুপারিশ করেছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে না।

জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটি ছাড়াও আরও বেশ কিছু কমিটি করেছিল স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের প্রায় সব জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা কোনো না কোনো কমিটিতে ছিলেন। মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মাঈদুল ইসলাম প্রধান প্রথম আলোকে বলেন, ৩০ মে পর্যন্ত করোনা বিষয়ে ১৯টি কমিটি ছিল মন্ত্রণালয়ে। তিনি নিজে ছিলেন গণমাধ্যমবিষয়ক কমিটিতে। তবে সব কমিটি এখন আর সক্রিয় নেই।

আরও ১০ কমিটি

মন্ত্রণালয়ের কমিটিগুলো বাতিল হয়নি, বিশেষজ্ঞদের দুটো কমিটি কাজ করছে, জাতীয় পরিকল্পনার ১৩টি কমিটি এখনো বর্তমান। এরই মধ্যে ২৭ জুন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর আরও নতুন ১০টি কমিটি করেছে। এর মধ্যে আছে: কোভিড-১৯ কোর কমিটিগুলোর সমন্বয় কমিটি; জোনিং সিস্টেমবিষয়ক গ্রুপ; সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে কোভিড-১৯ ল্যাবরেটরি পরীক্ষা সম্প্রসারণ, মান ও মূল্য নির্ধারণ ও তদারকি কমিটি; তথ্য ব্যবস্থাপনা, গণসংযোগ ও কমিউনিটি মবিলাইজেশন কমিটি; মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্যসেবা কমিটি; অত্যাবশ্যকীয় ও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা কমিটি; কোভিড-১৯ ও মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক কমিটি; সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সক্ষমতা বৃদ্ধিবিষয়ক কমিটি; হাসপাতাল, ল্যাবরেটরি ও পরিবেশ সংক্রমণ ও নিয়ন্ত্রণ কমিটি এবং ক্লিনিক্যাল গাইডলাইন ও চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা কমিটি।

কমিটির বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ প্রথম আলোকে বলেন, সব কমিটি পুনর্গঠন করা হয়েছে দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে। অত্যাবশ্যকীয় ও নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবার জন্য নতুন দুটি কমিটি করা হয়েছে। তিনি বলেন, মন্ত্রণালয়ের কমিটিগুলো আগের মতোই থাকবে।

ন্যাশনাল অ্যাডভাইজারি কমিটির সভা নিয়মিত হয় না। জাতীয় কারিগরি কমিটি এ পর্যন্ত বিশেষ কী পরামর্শ দিয়েছে, তা জানা যায়নি। পাশাপাশি জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির অনেক সুপারিশ বাস্তবায়িত হয়নি।

জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ বলেন, করোনা মোকাবিলায় কী কাজ করতে হবে, তার সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে জাতীয় পরিকল্পনা দলিলে। সেই দলিল অনুসরণ না করে অন্ধের মতো কমিটি তৈরি করছে। অধিক কমিটি পরিস্থিতি পাল্টাতে পারবে বলে মনে হয় না।