মৌলভীবাজারের আম যাচ্ছে ক্রেতার বাড়ি বাড়ি

বছর চারেক আগে বাড়ির পাশে খালি জায়গায় বিভিন্ন জাতের আমের গাছ লাগিয়েছিলেন তিনি। লাগানোর বছর থেকেই ছোট আকারের গাছগুলোতে মুকুল আসতে শুরু করে। কিন্তু দুবছর সেই মুকুল ভেঙে ফেলা হয়েছে। গেল বছর কিছু গাছে আম এসেছিল। তাতে নিজের ও আত্মীয়স্বজনের চাহিদা পূরণ করা হয়েছে।

এবার ভিন্ন অবস্থা। সেই সব গাছে প্রচুর আম ধরেছে। অনলাইনে আমের বাগান ও পাড়া আম প্রদর্শন করা হচ্ছে। দেশ-বিদেশের অনেকেই সেসব আম দেখছেন। অনলাইনে অর্ডার করছেন। টাকা পরিশোধ করছেন বিকাশের মাধ্যমে। পরে চাহিদামতো আম পাঠানো হচ্ছে ক্রেতাদের বাড়ি বাড়ি।

যিনি এসব কাজ করছেন, তিনি হলেন মো. আবদুল কাইয়ূম (৪৫)। তিনি মৌলভীবাজার সদর উপজেলার কামালপুর ইউনিয়নের ত্রৈলক্ষ্যবিজয় এলাকার একজন কৃষি উদ্যোক্তা। এই কাজে আর্থিক সাফল্য এসেছে তাঁর।

কৃষি উদ্যোক্তা আব্দুল কাইয়ূম জানান, প্রায় চার বছর আগে তাঁর বাড়ির খালি জায়গায় হিমসাগর, আম্রপালি, বারি-৪ ও হাঁড়িভাঙা জাতের ১৩০টি আমগাছ লাগিয়েছিলেন। গাছগুলোকে যথাযথভাবে পরিচর্যা করেছেন। ছোট আকারের এসব গাছ রোপণের পর থেকেই মুকুল আসতে শুরু করে। দুবছর যাতে আম না ধরে, এ জন্য মুকুল ভেঙে ফেলেছেন। গত বছর কিছু আম এসেছিল। এবার আম এসেছে যথেষ্ট পরিমাণে। এসব আম বাজারজাত করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে প্রচার চালিয়েছেন তিনি। ফেসবুক লাইভে এসে আমগাছ, আম পাড়া ও আমের প্রক্রিয়াজাত কার্যক্রম তুলে ধরেছেন তিনি। এতে দেশ–বিদেশের ক্রেতার সন্ধান পেয়ে যান তিনি।

যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসীরা তাঁদের নিজের ও স্বজনদের বাড়িতে আম পাঠানোর ফরমাশ (অর্ডার) দিচ্ছেন। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকেও আমের অর্ডার আসছে। কিন্তু প্রথমবারের মতো হওয়ায় কাইয়ূম শুধু মৌলভীবাজার জেলার মধ্যেই সরবরাহ সীমিত রেখেছেন। আগামী বছর সরবরাহ কার্যক্রম সম্প্রসারণ করার ইচ্ছে আছে তাঁর।

আবদুল কাইয়ূম বলেন, ‘আমি লাইভে সব দেখাচ্ছি। বিদেশ থেকে সবাই দেখছেন। এরপর একেকজন ১০ থেকে ৩০ কেজি আম অর্ডার দিচ্ছেন। কারও মা-বাবা বাড়িতে আছেন। তাঁদের জন্য আম কিনছেন। কেউ বোনের বাড়িতে দিচ্ছেন। কেউ অন্য আত্মীয়স্বজনকেও আম খেতে দিচ্ছেন। ক্রেতারা বিকাশে টাকা পাঠিয়ে দেন। তারপর বাড়ি বাড়ি গিয়ে আম পৌঁছে দিচ্ছি। এতে ঘরে বসেই টাটকা ও ভালো জাতের আম পেয়ে প্রবাসীর পরিবারের লোকজনও বেশ খুশি। বাইরের জেলা থেকে তাঁদের আর আম কিনতে হচ্ছে না। আমবাগান শখে করছি, এখন বাণিজ্যিক রূপ নিচ্ছে।’

ওই উদ্যোক্তা জানান, আম পৌঁছানোর জন্য টুকরি, বাঁধাই, গাড়িভাড়াসহ এক কেজি আমের দাম নিচ্ছেন ১০০ টাকা। তিনি এটাকে এখনো সেবা হিসেবেই দেখছেন। পরেরবার থেকে হিসাব-নিকাশ করে দাম বিবেচনা করবেন। প্রায় এক মাস ধরে তিনি আম বিক্রি করছেন। এখন পর্যন্ত তাঁর বাগান থেকে প্রায় ৯০০ কেজি আম বিক্রি করেছেন। এখন হিমসাগর জাতের আম বিক্রি করছেন। এরপর আম্রপালি বেচবেন। আম চাষে কৃষি বিভাগও তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছে। তারা চারা দিয়েছে, সার দিয়েছে, করেছে তদারকি।

আবদুল কাইয়ূম বলেন, কৃষির প্রতি তাঁর আকর্ষণ সেই তারুণ্যের সূচনা থেকেই। ২০০২ সালে যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ নেন। এরপর পোলট্রি ও ডেইরি ফার্ম করেন। তাঁর বাড়িতে ১১ বিঘার মতো জমি আছে। বাড়ি ঘিরেই কৃষি খামার গড়েছেন। বাড়ির খালি জায়গায় বড় গাছ না লাগিয়ে নানা জাতের সবজি ও ফল চাষ করেছেন। আছে পেঁপে, বেগুন, নাগা মরিচ, ঢ্যাঁড়সসহ বিভিন্ন জাতের সবজি। সাগর কলা, লেবু, মাল্টা, আম, কাঁঠাল, কামরাঙা, জলপাই, তেজপাতা, বিলম্বি, জাম্বুরা, আমড়া ইত্যাদি চাষও হয় তাঁর বাড়ির আঙিনায়। ডেইরি ফার্ম এখন বাড়ি থেকে সরিয়ে অন্য স্থানে নিয়েছেন। উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় হাটবাজারে বিক্রি করেন। এই কৃষিকাজে তাঁর যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বড় ভাই আবুল কাসেম ও আবুল কালাম দুজনই আর্থিক এবং মানসিক সমর্থন জুগিয়েছেন। আরও একজন অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তিনি ফুপাতো ভাই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী আবদুল আহাদ আনছারি।

‘আমি কৃষিকাজ ভালো পারি। এ জন্য আর কিছু করতে যাইনি। বাড়িতেই থাকি। বাজার থেকে শাক–সবজি, ফল কিছু কিনে খাই না। ব্যবসায়ী হওয়া বড় কথা নয়। আমি উদ্যোক্তা হতে চাই। অন্যদের উৎসাহ-অনুপ্রেরণা জোগাতে চাই। অনেকের খালি বাড়ি পড়ে আছে। কিছু করে না। এ রকম চাষবাস করলে বছরে সেখান থেকে লাখ টাকা বের করা সম্ভব।’ বলেন আবদুল কাইয়ূম।

মৌলভীবাজার সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সুব্রত কান্তি দত্ত প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবদুল কাইয়ূম একজন প্রগতিশীল মানুষ। বছর চারেক আগে তাঁকে একটা আমের বাগান করে দিয়েছিলাম। গত বছর আমের ব্যাগিং করিয়েছিলাম। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করছি। তাঁর বাগানে এবার আমের ভালো ফলন হয়েছে। এই এলাকায় আমের ভালো সম্ভাবনা আছে। তবে আম্রপালি জাতের সম্ভাবনাই বেশি।’

মৌলভীবাজারের কৃষি অধিদপ্তরের উপপরিচালক কাজী লুৎফুল বারী বলেন, জেলায় অনেকগুলো আমবাগানে সহযোগিতা করা হয়েছে। তবে এখনো রাজশাহীর মতো পর্যায়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি। জেলায় ২ হাজার ৫৮ হেক্টর জমিতে আম আছে। এর মধ্যে প্রায় ১ বিঘা আয়তনের সাড়ে ৩০০ আম বাগান আছে। এ বছর ২৪ হাজার ৬৯৬ মেট্রিক টন আম উৎপাদন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।