সুদিন আসুক মেছো বাঘের

মেছো বাঘ।  ছবি: সায়েম ইউ চৌধুরী
মেছো বাঘ। ছবি: সায়েম ইউ চৌধুরী

মৌলভীবাজারের এক ধানখেতে মে মাসের শেষ দিকে মেছো বাঘের তিনটি বাচ্চা পাওয়া গেল। চোখ না ফোটা সেই বাচ্চাগুলো ধরতে গ্রামবাসী হইহই রইরই করে এসে হাজির হলো। বাচ্চাগুলো উদ্ধার করে পুলিশ নিয়ে গেল থানায়। ওদের স্থান হলো ছোট্ট এক চিড়িয়াখানায়। গ্রামে–গঞ্জে মেছো বাঘের ওপরে মানুষের আচরণ খুবই নির্মম। মেছো বাঘ প্রায়ই মানুষের হাতে মারা পড়ে।

করোনাকালে মেছো বাঘের ওপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে প্রায় ১৯টি। আমরা এ ব্যাপারে একদমই সচেতন নই। মেছো বাঘদের আসলে উদ্ধার করার কোনো প্রয়োজনই নেই। মানুষ অকারণে প্রাণীটি ধরছে, আর বন অধিদপ্তর এদের উদ্ধার করে সেবা আর পরিচর্যা দিচ্ছে। কোনো দপ্তরের পক্ষে একা মেছো বাঘকে রক্ষা করা সম্ভব নয়। এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০১০ থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত দেশে মোট ৮২টি মেছো বাঘ আটক হয়েছে। এর মধ্যে ৩০টি বাঘ মেরে চামড়া ছাড়ানো হয়েছে। বাংলাদেশে আট প্রজাতির বিড়াল বা বাঘ দেখা যায়। এগুলোর মধ্যে মেছো বাঘ বা মেছো বিড়াল খুবই নিরীহ একটি প্রাণী।

সারা বিশ্বেই মেছো বাঘ এখন একটি সংকটাপন্ন প্রাণী। ২০০৮ সালে এটি সংকটাপন্ন থেকে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় স্থান পেয়েছিল। সে সময় বিশ্বজুড়ে মূলত ৫০টি জলাশয়ে অতিরিক্ত মেছো বাঘ হত্যার ঘটনা বিচারে নিয়ে এ বিপন্ন তালিকা তৈরি করা হয়। প্রাণীটি বাংলাদেশেও বিপন্ন। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার ৪৫ শতাংশ অভয়ারণ্য এবং বিশ্বের ৯৪ শতাংশ জলাশয় ধীরে ধীরে মানুষের দখলে চলে যাওয়ায় বন্য প্রাণীর আবাসস্থল মুছে গেছে।

সারা দুনিয়ায় ১০ হাজারের মতো মেছো বাঘ টিকে আছে। বাংলাদেশে কত মেছো বাঘ আছে তার কোনো পরিসংখ্যান নেই। এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে, বিশেষ করে পাকিস্তান থেকে তারা হারিয়ে গেছে। বাংলাদেশে বিভিন্ন গ্রামেও এ বাঘ আর নেই। মূল কারণ আবাস হারিয়ে যাওয়া।

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেছো বাঘ দেখা গেলেও হাওরাঞ্চলে এদের দেখা যায় বেশি। সেখানে এদের মৃত্যুহারও বেশি। বৃহত্তর সিলেটে এ বাঘ সবচেয়ে বেশি মারা পড়ে। মেছো বিড়ালের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব এ দেশে প্রবল। বেশির ভাগ মানুষ মনে করে, প্রাণীটি তাদের পুকুরের মাছ আর ঘরের মুরগি খেয়ে ফেলে। অনেকে ভাবেন, এটি বনের বাঘ। শীতকালে মেছো বাঘ বেশি মারা পড়ে। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে মৃত্যুহার কম।

মেছো বাঘ সত্যিই একটি পুকুরের কয়টি মাছ খেতে পারে? ২০১৬ সালে ক্যামেরা ট্যাপিং গবেষণার মাধ্যমে আমরা বাইক্কার বিলে মেছো বিড়ালের সংখ্যা বের করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। ধারণা পাওয়া গেল, সেখানে মেছো বিড়াল মাত্র ছয়টি। বাইক্কার বিলের মতো এত বড় একটা বিলে ছয়টি মেছো বাঘ কী পরিমাণ মাছ খেতে পারে?

দেখা গেছে, কোনো জলাভূমির আশপাশে মেছো বিড়াল থাকলে সেখানকার মাছের পরিমাণ বরং বাড়ে। এমনকি জলাভূমির পাশে কৃষিজমির ফসল উৎপাদনেও এর ভালো প্রভাব পড়ে। মেছো বাঘ বেশির ভাগ সময়ই খায় মরা বা রোগাক্রান্ত মাছ। ফলে মেছো বাঘ জলাশয়ে মাছের রোগনিয়ন্ত্রণে ভালো ভূমিকা রাখে।

করোনাকালে অনেক তরুণকে দেখেছি, মেছো বাঘ মেরে ঘাড়ে নিয়ে উল্লাস প্রকাশ করছেন। অনেকে তা ফেসবুক লাইভও করেছেন। আমাদের এই প্রকৃতিবিরোধী মনোভাব পাল্টাতে হবে। ভালো খবর হলো মেছো বাঘ আটকের খবর এখন আমরা মোটামুটি পেয়ে যাচ্ছি। বন বিভাগও খুব দ্রুত সাড়া দিচ্ছে।

মেছো বাঘ রক্ষার জন্য হাওরগুলোর সামান্য কিছু অংশ ছেড়ে দেওয়া দরকার। বাইক্কার বিল এবং হাকালুকি আর টাঙ্গুয়ার হাওরের কয়েকটি বিল আর জঙ্গল ছেড়ে দিলে প্রাণীটির সুরক্ষা একলাফে এগিয়ে যায়। তাতে জলাভূমিগুলোও তার প্রাকৃতিক চেহারা ফিরে পায়।