৪ বছরে ডিএসসিসির প্ল্যান্টটি একবারও ব্যবহৃত হয়নি

চার বছর আগে প্রস্তুত করলেও এখনো চালু হয়নি অ্যাসফল্ট ও রেডিমিক্স প্ল্যান্ট। গতকাল ধলপুরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যান্ত্রিক বিভাগে।  ছবি: আশরাফুল আলম
চার বছর আগে প্রস্তুত করলেও এখনো চালু হয়নি অ্যাসফল্ট ও রেডিমিক্স প্ল্যান্ট। গতকাল ধলপুরে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের যান্ত্রিক বিভাগে। ছবি: আশরাফুল আলম

সড়ক ও অবকাঠামো নির্মাণ এবং সংস্কারকাজে নির্মাণসামগ্রীর গুণগত মান যাতে ঠিক থাকে, সে জন্য প্রায় ১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে অ্যাসফল্ট ও রেডিমিক্স কনক্রিট প্ল্যান্ট বসিয়েছিল ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। কিন্তু গত চার বছরে প্ল্যান্টটি একবারও ব্যবহার করা হয়নি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঠিকাদারেরা যাতে ওই প্ল্যান্ট ব্যবহার করেন, তা নিশ্চিত করতে ২০১৭ সালের নভেম্বরে ডিএসসিসি একটি অফিস আদেশ জারি করে। কিন্তু সেটি নিশ্চিত করা হয়নি। এতে রাজস্ববঞ্চিত হয়েছে ডিএসসিসি। পাশাপাশি সড়ক ও অবকাঠামোর গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন তোলার সুযোগও রয়ে গেছে।

২০১৬ সালের মার্চে ধলপুরে অ্যাসফল্ট ও রেডিমিক্স কনক্রিট প্ল্যান্টটি বসায় ডিএসসিসি, যা আনা হয় দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। প্ল্যান্ট থেকে নির্মাণসামগ্রী বিভিন্ন এলাকায় পৌঁছানোর জন্য পাঁচটি রেডিমিক্স ক্যারিয়ারও কেনা হয়। প্রতিটি গাড়ির দাম পড়ে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ টাকা।

রাস্তার কার্পেটিংয়ের জন্য বালু, পাথর ও পিচের মিশ্রণ তৈরি করা হয় অ্যাসফল্ট প্ল্যান্টে। আর রেডিমিক্স কনক্রিট প্ল্যান্টে অবকাঠামো নির্মাণে ঢালাইকাজের জন্য পাথরকণা, বালু, সিমেন্টের উপযোগী মিশ্রণ তৈরি করা হয়।

প্ল্যান্ট দুটি ব্যবহার না হওয়া প্রসঙ্গে স্থপতি ও নগর পরিকল্পনাবিদ ইকবাল হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্ল্যান্ট দুটি বসানোর আগে বলা হয়েছিল, সামান্য বৃষ্টিপাতে রাস্তাঘাটের যে দুরবস্থা হয়, উৎপাদনের জায়গা থেকে এটি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে রাস্তার পরিণতি খারাপ হবে না। এসব প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাঁরা প্ল্যান্ট বসিয়েছিলেন, তাঁরা সরকারের সঙ্গে প্রহসন করেছেন।’

কোন ‘কারসাজিতে’ এগুলো ব্যবহার করা হয়নি, এটার একটা ‘সুরাহা’ হওয়া উচিত বলে মনে করেন ইকবাল হাবিব। করপোরেশনের প্ল্যান্ট ব্যবহার না করায় ‘শুভংকরের ফাঁকি’ থাকার সুযোগ ছিল বলেও মন্তব্য করেন এই স্থপতি।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, করপোরেশনের প্ল্যান্ট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা থাকলে ঠিকাদারদের ইট, বালু, সিমেন্ট ও পাথর যান্ত্রিক বিভাগের আনতে হবে। এতে সেখানে এসব মালামালের গুণগত মান যাচাইয়ের সুযোগ থাকে। কিন্তু বাইরের প্রতিষ্ঠানের এসব কাজ করলে এই সুযোগ থাকে না।

>অ্যাসফল্ট ও রেডিমিক্স প্ল্যান্ট বসাতে ব্যয় ১৯ কোটি টাকা। ৫টি গাড়ি কিনতে খরচ সোয়া ৬ কোটি টাকা।

ডিএসসিসি সূত্র জানায়, ২০১৭ সালের নভেম্বরের এক অফিস আদেশে বলা হয়, রাস্তা কার্পেটিং, লেভেলিং, মেরামত ও নির্মাণকাজের গুণগত মান সুষ্ঠু ও যথাযথ রাখার লক্ষ্যে ডিএসসিসির পাঁচটি অঞ্চল ও বিভিন্ন প্রকল্পের আওতাধীন সব কাজে করপোরেশনের অ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট ও রেডিমিক্স প্ল্যান্ট বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহার করতে হবে। এতে আরও বলা হয়, ‘বিভাগীয় জরুরি কাজে অ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট, রেডিমিক্স কনক্রিট প্ল্যান্ট ও যান যন্ত্রপাতি নিয়োজিত থাকলে অথবা অ্যাসফল্ট প্ল্যান্ট, রেডিমিক্স প্ল্যান্ট ও যান যন্ত্রপাতির কাজের ভলিউম অত্যধিক হলে জনদুর্ভোগ লাঘবকল্পে শুধু সে ক্ষেত্রে তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীর (যান্ত্রিক) অনুমোদনক্রমে নির্বাহী প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) কর্তৃক সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে অনাপত্তিপত্রের মাধ্যমে বাহিরের প্রাইভেট প্ল্যান্ট/যান-যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা যাবে মর্মে অবহিত করবে।’

যান্ত্রিক বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আনিছুর রহমান বলেন, ওই অফিস আদেশ জারির পর করপোরেশনের নিজস্ব প্ল্যান্ট যাতে ব্যবহার করা হয়, সে জন্য একাধিকবার সংশ্লিষ্ট বিভাগে চিঠি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনো কাজ হয়নি।

ডিএসসিসি সূত্র জানায়, বিভিন্ন কাজের দরপত্র আহ্বানের সময় সংস্থার প্ল্যান্ট ব্যবহারের বাধ্যবাধকতার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়নি। এই সুযোগে ঠিকাদারেরা যে যাঁর পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মাণসামগ্রী এনেছেন। বাইরের প্ল্যান্ট থেকে এসব সামগ্রী আনার কারণে গুণগত মানের ব্যাপারে ‘ফাঁকিবাজির’ সুযোগ তৈরি হয়।

ডিএসসিসি সূত্র বলছে, নিজস্ব প্ল্যান্ট ব্যবহারের বিষয়টি প্রধান প্রকৌশলীকে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু তিনি এমন উদ্যোগ নেননি। উল্টো প্রধান প্রকৌশলী তাঁর পছন্দের প্রতিষ্ঠান থেকে নির্মাণসামগ্রী নেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ দিয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সংস্থার প্রধান প্রকৌশলী রেজাউর রহমান যান্ত্রিক বিভাগের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তাঁর বক্তব্য, ‘আমার কোনো পছন্দের প্রতিষ্ঠান নেই।’ তবে যান্ত্রিক বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, সংস্থার প্ল্যান্ট ব্যবহার নিশ্চিত করতে হলে তা দরপত্রে উল্লেখ করতে হবে। আর দরপত্র আহ্বানের ক্ষেত্রে তাঁদের কোনো ভূমিকা নেই। বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, প্ল্যান্ট ঠিক রাখার জন্য মাঝেমধ্যে এটি চালানো হয়। এখন পর্যন্ত প্ল্যান্টটি সচল আছে।

জানতে চাইলে ডিএসসিসির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস প্রথম আলোকে বলেন, ইতিমধ্যে বিষয়টি তাঁর নজরে এসেছে। ৫ জুলাই দাপ্তরিক এক বৈঠকে এ বিষয়ে তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, এখন থেকে ডিএসসিসির সব কাজে ঠিকাদারদের বাধ্যতামূলকভাবে ওই অ্যাসফল্ট ও রেডিমিক্স কংক্রিট প্ল্যান্ট ব্যবহার করতে হবে। এ বিষয়ে তিনি প্রধান প্রকৌশলীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নির্দেশনা দিয়েছেন। তিনি আরও বলেন, এখন থেকে করপোরেশনের কোনো কাজে কোনো ঠিকাদার তাঁদের মনমতো অথবা নিজস্ব অ্যাসফল্ট ও রেডিমিক্স কংক্রিট প্ল্যান্ট ব্যবহার করতে পারবেন না। কেউ এই আদেশ অমান্য করলে কার্যাদেশ বাতিলসহ প্রয়োজনীয় দাপ্তরিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।