কেন 'ইন্না লিল্লাহি...' বলে বক্তব্য শুরু, ব্যাখ্যা দিলেন বিএনপির সাংসদ

বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ। ফাইল ছবি
বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ। ফাইল ছবি

বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ গত ২৩ জুন সংসদে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা শুরু করেছিলেন ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলে।

তখন স্পিকারের চেয়ারে বসা ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া হারুনকে থামিয়ে এভাবে শুরু করার কারণ জানতে চান। জবাবে হারুন বলেন, তিনি এটা বলেছেন, এর কারণ আছে। বক্তব্যের শেষের দিকে তিনি ব্যাখ্যা দেবেন।

এরপর ফজলে রাব্বী মিয়া বলেছিলেন, আমার ৭ বারের সংসদ সদস্য জীবনে এমনভাবে শুরু দেখিনি। আপনাকে অবশ্যই এর ব্যাখ্যা দিতে হবে।

সেদিন বক্তৃতার শেষের দিকে আর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি হারুনুর রশীদ। কারণ, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অনিয়ম, নিজ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ও তাঁর ছেলে তারেক রহমানের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারের দাবি তুললে সংসদে হই চই সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে স্পিকারের সঙ্গে বাদানুবাদ করে ওয়াকআউট করেন। এবারের বাজেট অধিবেশনে সেটাই একমাত্র ওয়াকআউটের ঘটনা।

বর্তমান সংসদে জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হলেও দলটির সংসদ সদস্যদের সরকারের কঠোর সমালোচনা করতে দেখা যায়নি। বরং তাঁরা সুযোগ পেলে বিএনপির সাংসদদের সমালোচনায় বেশি মুখর থাকেন। বিশেষ করে সংসদে বিরোধী দলীয় উপনেতা মশিউর রহমান সুযোগ পেলেই বিএনপির সমালোচনা করেন। গত ২৩ জুন হারুনুর রশীদের ওয়াক আউটের পরে তিনি স্পিকারকে বলেছিলেন, ‘তাঁরা (বিএনপি) তো থাকার দল না। বের হয়ে যাওয়ার দল। আমরা আপনাদের সহযোগিতা করতে চাই।’

বাজেট অধিবেশনে দেখা গেছে, হারুনুর রশীদের বক্তৃতার সময় সরকারি দল, এমনকি জাতীয় পার্টির সাংসদেরাও প্রতিবাদ করেছেন, হইচই সৃষ্টি করেছেন।

এই বিষয়ে আওয়ামী লীগের দুজন সাংসদ নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, হারুনুর রশীদ আলোচনায় থাকার জন্যেই সব সময় সংসদে ব্যতিক্রমী কিছু করতে চান। জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দল হলেও তারা কদাচিৎ সরকারের সমালোচনা করে। বিএনপির হারুনুর রশীদ ও রুমিন ফারহানাই সরকার বিরোধিতা অব্যাহত রেখেছেন। এবারের বাজেট অধিবেশনে রুমিন ফারহানা একদিনও আসেননি। ফলে সাংসদ হারুনই কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি করতে পেরেছেন।

২৯ জুন পুনরায় অনির্ধারিত আলোচনায় দাঁড়িয়ে হারুন ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ প্রসঙ্গে তোলেন। একাধিকবার মাইক পেলেও ওই দিন হারুনুর রশীদ ব্যাখ্যা দেননি। তিনি সেদিন বলেছিলেন সময় পেলে পরে ব্যাখ্যা দেবেন।

৩০ জুন বাজেট পাশের দিন দেশের বিচার বিভাগ স্বাধীন নয় এমন বক্তৃতা করে আরেক দফা প্রতিরোধের মুখে পড়েন হারুন। ৮ জুলাই সংসদের অধিবেশনে অংশ নিয়ে তিনি কুয়েতে আটক সাংসদ শহিদ ইসলাম (পাপুল) ও রিজেন্ট হাসপাতালের মালিকের কড়া সমালোচনা করে বক্তৃতা করেন। পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাঁড়িয়ে এর জবাব দেন।

আজ বৃহস্পতিবার সংসদের সমাপনী দিন ছিল। অনির্ধারিত আলোচনায় দাঁড়িয়ে বক্তব্যের শুরুতে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ বলার ব্যাখ্যা দেওয়ার আগ্রহের কথা জানান। তিনি এর বাংলা অর্থ পড়ে শোনান এবং বলেন, ‘মানুষ মনে করেন, শুধু কেউ মারা গেলে ইন্না লিল্লাহি... পড়তে হয়। কিন্তু তা নয়, এর বাইরে যেকোনো বিপদে ইন্না লিল্লাহি... পাঠ করার বিধান রয়েছে। আর এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, আমরা মুসিবতের মধ্যে আছি। আমরা মহাসংকটের মধ্যে আছি, এটা কী অস্বীকার করতে পারি? নিঃসন্দেহে বলতে পারি, সারা পৃথিবী মহাবিপর্যয়ের মধ্যে আছে। আমি অন্য সময়ও সংসদে প্রবেশের সময় ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন’ পড়ি।’

তবে এই ব্যাখ্যা দেওয়ার পর আজও স্পিকারের সঙ্গে তাঁর সামান্য বাদানুবাদ হয়। হইচই করেন সাংসদেরা।
হারুনু বলেন, ‘বিগত সংসদগুলোতে শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলেও দশম ও একাদশ সংসদের বিরোধী দলের চরিত্র নিয়ে বিস্তারিত বলতে চাই না।’ এ সময় জাতীয় পার্টির ও সরকার দলীয় সাংসদেরা প্রতিবাদ করতে থাকলে হইচই শুরু হয়।

হারুন আরও বলেন, ‘গত ২৩ জুন বাজেটের ওপর আলোচনায় আমি ইন্না লিল্লাহি... বলে শুরু করেছিলাম। তখন আমাকে বাধা দেওয়া হয়েছিল। পরবর্তী পর্যায়ে বলেছিলাম, এর ব্যাখ্যা আমি পরে দেব।'

অতীতের হুমায়ূন রশিদ চৌধুরী, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার ও বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদসহ সাবেক কয়েকজন স্পিকারের নাম উল্লেখ করে বর্তমান ডেপুটি স্পিকার সম্পর্কে নালিশ দেওয়ার চেষ্টা করেন হারুনুর রশীদ। তিনি বলেন, ‘আপনি আমাদের অভিভাবক। অতীতে অনেকে স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন। আপনিও এখন চালাচ্ছেন। আমি এ ধরনের নজির দেখিনি—ওই খান থেকে (স্পিকারের চেয়ার) কখনো কোনো স্পিকার বলেছেন ‘আমি ওনার জবাব দেওয়ার জন্য একাই যথেষ্ট।’

স্পিকারের উদ্দেশে বিএনপি সাংসদ হারুন আরও বলেন, ‘আমরা সংসদে মাননীয় স্পিকারের মাধ্যম দিয়েই কথা বলি। আমি বক্তব্যের উত্তর মাননীয় সংসদ নেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলাম। কিন্তু ওই জায়গা থেকে যে উক্তি করা হয়েছে, তা আমার সংসদের অভিজ্ঞতায় শুনিনি। কার্যপ্রণালী বিধির কোথাও এটা খুঁজে পাইনি।’

হারুন আরও বলেন, ‘আমি খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে নিয়ে বক্তব্য দিলে উনি ওই খান থেকে কথা বললেন, এটি বলা যাবে না।’

এ সময় স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী হারুনকে থামিয়ে দিয়ে বলেন, ‘মাননীয় স্পিকার এই চেয়ারে বসে কী বলেছেন সেটার ব্যাপারে আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে কোনো মন্তব্য করতে পারবেন না। আপনি ফ্লোর নিয়েছেন। আপনি আপনার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিতে পারেন। আমি আপনাকে সেটার ভেতরে সীমাবদ্ধ থাকার অনুরোধ জানাব। স্পিকারের বিষয় নিয়ে কোনো ধরনের উক্তি এখানে করা যাবে না।'

এরপরই হারুনুর রশীদের নির্ধারিত সময় ফুরিয়ে যায় এবং মাইক বন্ধ হয়ে যায়।

পরে যোগাযোগ করা হলে হারুনুর রশীদ প্রথম আলোকে বলেন, সরকারি দলের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকলেও তারা দুর্বল ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে। জাতীয় পার্টি বিরোধী দল দাবি করলেও তারা সরকারের শরিক। বিএনপির সাংসদেরাই জবাবদিহির চেষ্টা করছেন। প্রতিনিয়ত বৈরী পরিবেশে তারা সত্য কথা বলার চেষ্টা করেন।

ইন্না লিল্লাহি... বলে বক্তব্য দেওয়ার ব্যাখ্যা ঝুলিয়ে রাখা বা সংসদে হইচই হয় এমন বক্তৃতা দেওয়ার লক্ষ্য মনোযোগ আকর্ষণের কৌশল কি না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরেই সাংসদ। উপস্থাপনার কৌশল জানেন, এই বিষয়ে পড়াশোনা করেন।