মনিরুলের পাতিলে 'চাঁদপুরের ইলিশ'

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাতিলে বোঝাই করে মনিরুল ইসলাম ভিনদেশি মাছ বিক্রি করছেন। তবে তাঁর দাবি, এগুলো চাঁদপুরের ইলিশ। ছবি: প্রথম আলো
রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় পাতিলে বোঝাই করে মনিরুল ইসলাম ভিনদেশি মাছ বিক্রি করছেন। তবে তাঁর দাবি, এগুলো চাঁদপুরের ইলিশ। ছবি: প্রথম আলো

মনিরুল ইসলাম মাথায় পাতিলে করে ‘মাছ মাছ’ ডাক দিয়ে ক্রেতা খুঁজছেন। ‘কী মাছ’ জিজ্ঞেস করতেই জবাব এল, ‘চাঁদপুরের ইলিশ’। পাতিল নামিয়ে ‘ইলিশ’ দেখালেন। কিন্তু মাছের ঘ্রাণ ও আকার দেখে অভিজ্ঞ ব্যক্তিমাত্রই বুঝবেন, মাছগুলো ইলিশ নয়। দাম জিজ্ঞেস করতেই ব্যাপারটি আরও নিশ্চিত হওয়া গেল। এত কমে এখন আর ইলিশ বিকোয় না।

রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এমন মাছওয়ালাদের হাঁকডাক শোনা যায়। ঘুরে ঘুরে পাতিল বোঝাই করে তাঁরা বিক্রি করেন ‘ইলিশ মাছ’। চাঁদপুরের ইলিশ বলে বিক্রি হলেও মূলত এসব সামুদ্রিক ‘চন্দনি’ মাছ। অন্য অঞ্চল থেকে আসা ব্যক্তিরা মাথায় পাতিল ভর্তি করে ঘুরে ঘুরে তা বিক্রি করছেন। গ্রামের অনেক স্বল্প আয়ের মানুষ ‘অল্প টাকার ছোট ইলিশ’ ভেবে কিনেও নিচ্ছেন।

কুমিল্লা থেকে আসা মনিরুল ইসলাম দুই সঙ্গী নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে রাজবাড়ীতে অবস্থান করছেন। প্রতিদিন সকাল সকাল গোয়ালন্দ পৌরসভার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে মাছ বিক্রি করেন তিনি। গ্রামের নারী-পুরুষ দেদার সেসব মাছ কিনে ‘ইলিশের স্বাদ’ নিচ্ছেন। ইলিশের মতো ঘ্রাণ এলেও মূলত এসব সামুদ্রিক মাছ। ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম ওজনের এসব মাছের দামও তুলনামূলক অনেক কম। প্রকৃত ইলিশের দাম অনেক হওয়ায় এ মাছ অসচ্ছল মানুষ কিনে থাকেন বেশি। দৌলতদিয়া-পাটুরিয়া নৌপথে চলাচল করা অনেক নৌযানেও এই মাছ ভেজে ইলিশ বলে চালিয়ে দেন বিক্রেতারা।

আলাপকালে মাছ বিক্রেতা মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা একসঙ্গে ছয়জন মাছ বিক্রি করতে এসেছি। রাজবাড়ী ও গোয়ালন্দের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে মাছ বিক্রি করছি।’

মনিরুল পাতিলভর্তি মাছ নিয়ে একাই ঘুরছেন। পাতিলের ঢাকনার ওপর ছোট-বড় মিলে আট থেকে নয়টি করে মাছ সাজিয়ে রেখেছেন। কেজি কত করে জানতে চাইলে বলেন, ‘কেজি হিসেবে বিক্রি করছি না। আকছা, অর্থাৎ মোক্তা হিসেবে ১ হাজার ২০০ টাকা করে দাম চাইছি। তবে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি না হলেও ১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়।’

লাভ কেমন হয়? জবাব এল, ‘মোটামুটি ভালোই লাভ হয়।’

মনিরুলের সঙ্গে কিছু সময় থাকার পর একজন ক্রেতা দেখা গেল। মনিরুলের ‘ইলিশ’, মানে চন্দনি মাছ দেখে উপজেলার উজানচর ইউনিয়নের বাহাদুরপুর গ্রামের জহুরা খাতুন কেনার জন্য ছুটে এলেন। অনেক দিন হলো তাঁর দুই মেয়ে ইলিশের স্বাদ নিতে পারেনি। তিনি দরদাম করে পাঁচটি মাছ কিনে নেন মাত্র ৩০০ টাকায়। দর–কষাকষিতে জহুরা হয়তো নিজেকে জয়ীই ভেবেছেন। জহুরা খাতুনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল, তিনি মাছটির স্বাদ সম্পর্কে অবগত। স্বাদ তাঁর কাছে ইলিশের মতোই লাগে। দাম কম, এটাই তাঁর কাছে বড় ব্যাপার।

বিক্রেতা মনিরুল ইসলামের সঙ্গে আরও কিছুক্ষণ কথা হলো। জানালেন, তাঁর বাড়ি কুমিল্লা জেলায়। তিনি আগেও কুমিল্লা থেকে রাজবাড়ী এসে মাছ বিক্রি করেছেন। তবে করোনাকালে ব্যবসায় মন্দা যাচ্ছে। দীর্ঘদিন বাড়ি থেকে বের হতে পারেননি। বর্তমানে গণপরিবহন ও ট্রেন চলাচল করায় আবার তৎপর হয়েছেন। মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট থেকে ঝুড়িভর্তি মাছের প্যাকেট কিনে আনেন।

যা বিক্রি করছেন, তা তো চাঁদপুরের ইলিশ নয়—এমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলে মনিরুল থতমত খেয়ে যান। ইলিশ বলে বিক্রি না করে চন্দনি বললেই তো পারেন। জবাব না দিয়ে পাতিল নিয়ে দ্রুত সরে যান মনিরুল।

মাথায় পাতিলে করে মাছ বিক্রি করছেন মনিরুল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো
মাথায় পাতিলে করে মাছ বিক্রি করছেন মনিরুল ইসলাম। ছবি: প্রথম আলো

গোয়ালন্দের বড় ইলিশ আড়তদার বাদল বিশ্বাস জানান, ওমান থেকে জাহাজে আসা ‘চন্দনি’ নামক এসব সামুদ্রিক মাছ চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ব্যবসায়ীরা কিনে আনছেন। পাইকারি ১১০ থেকে ১২০ টাকা কেজি কিনে গ্রামাঞ্চলে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়। প্রতিদিন পরিবহনে বরফজাত করে এই মাছ পাটুরিয়া ঘাটে আসে। কিছু ব্যক্তি সেসব মাছ কিনে গ্রামাঞ্চলে ঘুরে চাঁদপুরের ইলিশ বলে বিক্রি করছেন।

বাদল বিশ্বাস জানান, ইলিশের দাম অনেক হওয়ায় কম দামে অনেকটা ইলিশের মতো স্বাদ নিতে স্বল্প আয়ের মানুষ তা কিনছেন। এতে সাধারণ মানুষের সঙ্গে একধরনের প্রতারণা করা হচ্ছে। এই মাছ গোলগাল আকৃতির ছোটখাটো, দেখতে ইলিশের মতো। একটির ওজন ২০০ থেকে ৩০০ গ্রাম পর্যন্ত হয়।

উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রেজাউল শরীফ বলেন, ‘এই মাছে তেমন কোনো ক্ষতি নেই। তবে ইলিশ বলে এই মাছ চালিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা হচ্ছে। এটা অন্যায়। এ ধরনের ব্যক্তিদের পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’