সেই দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনি সারাক্ষণ

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

লেখাটা যখন লিখছি, তখন মধ্যরাত। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। জানালা খোলা। তাতে বৃষ্টির ছাট এসে লাগছে বাতাসে। কিছুক্ষণ আগেও আকাশটা পরিষ্কার ছিল। চাঁদ ছিল একটা ইয়া বড়। হঠাৎ-ই মেঘে আঁধার হয়ে বৃষ্টি নামল। ইচ্ছে করছে বাইরে গিয়ে ভিজতে। কিন্তু তা সম্ভব নয। হাজার হলেও মধ্যরাতের বৃষ্টি। ইচ্ছে করলেই ভেজা যায় না। যদিও সময়টা এখন ভিন্ন। অদ্ভুত এই করোনাকালে মধ্যরাত আর মধ্য-দুপুর বলে কিছু নেই। সবই এখন এক হয়ে গেছে। এখন দিনের বেলা ভিজতেও একশবার ভাবতে হয়।

মাস কয়েক আগের কথা। তখনো করোনা, কোয়ারেন্টিন, লকডাউন—শব্দগুলো আমাদের সাধারণের কাছে অপরিচিত। সবাই ভোগ করছি অবাধ স্বাধীনতার স্বাদ। হাসছি, খেলছি, ঘুমচ্ছি। সকাল–বিকেল কাঁধে ব্যাগ নিয়ে দৌড়াচ্ছি। গমগম করছে ক্লাস রুমগুলো।
কী বিচিত্রই না ছিল সেই দিনগুলো!
রুটিন মাফিক ঘুম, পড়া, খাওয়া। সকাল–সন্ধ্যা নিত্যকার পথে দৌড়ে চলা। দিনের শেষে একটু অবসরের জন্য হাঁসফাঁস আর বৃষ্টি অভিলাষী চাতক পাখির মতো চেয়ে থাকা—কবে আসবে শুক্রবার!
অথচ কি অদ্ভুত! আজ কয়েক মাসের ব্যবধানে এখন প্রতিটা দিনই শুক্রবার হয়ে গেছে!
এখনো দিন যাচ্ছে আগের মতো। সূর্য উঠছে। প্রতি ভোরে এখনো অভ্যাসমতো ঘুম থেকে জাগছি। শুধু নেই আগের সেই চাঞ্চল্যটা; আগের সেই দৌড়ঝাঁপের গৎবাঁধা গরজটা।
কেউ কি কস্মিনকালেও ভেবেছিল, কিছুদিন পর এমন এক সময় আসবে! সর্বশেষ কবে মানুষ সম্মুখীন হয়েছিল এমন পরিস্থিতির?
কদিন যাবৎ মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস পড়ছি। ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ পড়ে শেষ করলাম মাত্রই। বইয়ের একটা উক্তি বর্তমানের সঙ্গে খুব মেলে, ‘এখন এমন একটা সময়, যা আগে কখনো আসে নাই। কেউ জানে না, এ সময় কী করতে হয়।’
আসলেই। এ রকম পরিস্থিতিতে আমরা কেউই আগে পড়িনি। তাই জানি না, সমাধান কীভাবে আসবে। শুধু জানি, আমাদের লড়তে হবে। শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে হবে। হাল ছেড়ে দেয়া চলবে না।
দেখতে দেখতে বন্দিত্বের চার মাস হতে চলছে। দিন যত যাচ্ছে, শুধু অবনতিই চোখে পড়ছে। শুরুতে রোগীর সংখ্যা ছিল কম। মানুষের ভয় ছিল বেশি। এখন রোগী যত বাড়ছে, পুরো অস্বাভাবিকভাবে মানুষের সচেতনতা আরও কমছে।
সেদিন হঠাৎ করেই পড়ে গিয়ে চশমাটা ভেঙে গেল। নাকের ওপর মাইনাস টু (-2.0) পাওয়ারের চশমাটাকে আমার প্রেমিকাই বলা চলে। তাকে ছাড়া আমার পৃথিবী অন্ধকার। কী আর করা! গেলাম গাঙ্গিনার পাড়—চশমার দোকানে। অবাক হয়ে দেখলাম, মানুষ এখনো কতটা অসতর্ক! সবজির বাজার থেকে নিয়ে কসমেটিকসের দোকান—সবখানেই অবাধ ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষ মাস্ক ছাড়া। সেখানে বরং মাস্ক আর গ্লাভসওয়ালা মনুষ্যরাই সংখ্যালঘু!
তাতে ক্ষতিটা তো নিজেদেরই হচ্ছে! হু হু করে প্রতিনিয়তই বাড়ছে সংক্রমণ, আক্রান্তের সংখ্যা। যারা পরিণতির স্বীকার হচ্ছে, তারাই শুধু বুঝতে পারছে পরিস্থিতির ভয়াবহতা।
দেখতে দেখতে আমাদের ময়মনসিংহেও রোগীর সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়ে গেছে। পার্শ্ববর্তী ‘কাঁচিঝুলি’কে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে রেড জোন হিসেবে। কবে মুক্তি মিলবে এর থেকে, কেউ জানি না...
ইদানীং বৃষ্টি হচ্ছে খুব। বর্ষার ভরা মৌসুম চলছে। ওয়ার্ল্ডোমিটারের কোভিড-১৯ রোগের গ্রাফের মতোই হুহু করে বাড়ছে বন্যার পানি। সেই সঙ্গে প্রাণ ফিরে এসেছে আমাদের ব্রহ্মপুত্রেও। নদের পারে এখন একটু পরপরই চোখে পড়ছে ইয়া বড় বড় ছিপ জাল। জালগুলোর গোড়ায় জ্বলজ্বল করছে সদা চকচকে দুটি করে চোখ। বর্ষায় নদের পারের সে জগৎ বড় বিচিত্র, বড় আলাদা...
আজকাল বড় আলসে হয়ে গেছি। একই সঙ্গে ঘুমকাতুরে। দিনে ঘুমাই। রাতে ঘুমাই। সময়ে–অসময়ে যখন তখন ঘুমিয়ে পড়ি। তাতে খারাপ লাগে না অবশ্য। বনের সিংহ নাকি দিনের বিশ ঘণ্টাই ঘুমিয়ে কাটায়। যখন ঘুম আসে, নিজেকে সিংহের সঙ্গে তুলনা করি। ভালোই লাগে তখন!
সবমিলিয়ে ভালোই আছি। সুস্থ আছি এখনো। কৃতজ্ঞতা সৃষ্টিকর্তার প্রতি।
তবে জানি না, এই ভালোটা আর কত দিন টিকবে।
সেদিন তো ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। এক সপ্তাহের মধ্যে লাগাতার বাসার তিনজনের জ্বর, গলাব্যথা। ছোট বোনকে দিয়ে শুরু। দ্বিতীয়তে বাবা। শেষে আমি। ভয় হচ্ছিল, এবার বুঝি করোনা বাধিয়েই ফেললাম!
আসলে সময়টা এখন এমন, সাধারণ সর্দি–কাশিও বড় ভয় ধরিয়ে দেয়।
লিখতে লিখতে অনেক কিছুই লিখলাম। প্রয়োজনীয় অপ্রয়োজনীয় অনেক কিছু। ওদিকে রাতও শেষ হয়ে আসছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। ঘোলাটে চাঁদটাও দূরে ডোবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এখন শেষ করি।
তার আগে কামনা—সবাই ভালো থাকুক, সুন্দর থাকুক, সুস্থ হয়ে উঠুক আমাদের পৃথিবী। অতি তাড়াতাড়ি ফিরে আসুক আগের সেই দিনগুলো। করোনা–পরবর্তী পৃথিবীটা হোক সব দুঃখ-কষ্ট, হারানোর বেদনামুক্ত।
জানি, একদিন করোনা থাকবে না। এত সব নিয়মকানুনের বালাইও থাকবে না। হয়তো এমনই এক বর্ষার দিনে সারা শহর মেতে উঠবে উদ্দাম উন্মত্ততায়। বন্দিত্ব ঘুচিয়ে সবাই নেমে আসবে রাস্তায়—ভিজতে, ভেজাতে...
সেদিন এই করোনাকালীন অদ্ভুত সময়গুলো হবে শুধুই স্মৃতি। সেই দিনের অপেক্ষায় প্রহর গুনি সারাক্ষণ।

*তালতলা বাজার, সদর, ময়মনসিংহ।