টেলিওয়ার্ক

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

চীনের উহানের খবর দেখি আর ভাবি, এ আবার কী ভাইরাস রে বাবা। যাহোক, অফিস করি, বাচ্চারা ক্লাস করে। ওদের জন্যই বেশি চিন্তা। ছেলেটা মাস্ক পরতে চায় না। তারপরও জোরাজুরিতে রুমালটা মুখে বেঁধে রাখে। তারপর এল প্রথম করোনা রোগী শনাক্তের খবর। ভীষণ টেনশনে পড়লাম। সবাই বলাবলি করছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন বন্ধ করছে না। বাচ্চাদের ও নিজের জন্য ছোট বোতলে হেক্সিসল ও স্যানিটাইজার কিনলাম। একটা গাড়িতে রাখি আর ছেলেমেয়েকে একটা করে দিলাম ওদের ব্যবহারের জন্য।

আমাদের অফিসে টেলিওয়ার্ক বলে একটা কথা শুনেছিলাম, কিন্তু কখনোই সেটা আমরা পালন করিনি বা চিন্তাও করিনি। অফিসে টাস্কফোর্স গঠন করা হলো। তারা সভা করে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা ও করণীয় ঠিক করবেন। এর মধ্যে আমাদের বড়কর্তা একদিন হঠাৎ সবাইকে ডেকে দুইটা দলে ভাগ করলেন, এবং বললেন আগামীকাল থেকে একদল অফিসে আসবে, অন্যদল বাসায় থেকে কাজ করবে, মানে টেলিওয়ার্ক বা ওয়ার্ক ফ্রম হোম। ইতিমধ্যে আমাদের সবাইকে নিজ নিজ ল্যাপটপ বাসায় নিতে বলা হয়েছে এবং টেলিওয়ার্কবিষয়ক প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

আমার কন্যাও একটা আন্তর্জাতিক সংস্থায় ইন্টার্ন হিসেবে কাজ করে। সেদিন বাসায় ফেরার সময় সেও দেখি আমার মতো একটা ল্যাপটপ নিয়ে গাড়িতে উঠল। ও প্রতিদিন আমার সঙ্গেই অফিসে যাওয়া–আসা করে, যেহেতু আমাদের অফিস কাছাকাছি। সাপ্তাহিক ছুটির মধ্যেই অফিস থেকে খবর এল, বিশেষ প্রয়োজন যাঁদের তাঁরা ছাড়া বাকি সবাই বাসা থেকেই অফিস করবেন। ভাবলাম, যাক বেঁচে গেলাম, আর অফিস যেতে হবে না এই অসহ্য জ্যাম ঠেলে ঠেলে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও বন্ধ হলো। প্রতিদিন সকালে উঠে ল্যাপটপ খুলে কাজ করি আর টিভি চ্যানেলে চোখ রাখি। আক্রান্তের সংখ্যা এক-দুই করে বাড়তে থাকল, কিছু মৃত্যুর খবরও পেলাম। শেষ অফিস করে আসার দিন স্থানীয় ফার্মেসিতে হেক্সিসল কিনব বলে গিয়ে দেখি ছোট্ট দু-তিনটা বোতল আছে, আর কিছু নেই। তা–ই কিনে বাসায় এলাম।

শুরু হলো বন্দিজীবন। তার আগে অবশ্য এক দিন অফিস করে বাসায় আসার পথে সিএসডিতে গেলাম নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু বাজার করতে। গিয়ে দেখি এলাহি কাণ্ড, সবাই মনে হচ্ছে পারলে পুরো সিএসডি উঠিয়ে নিয়ে যায়। আমি কিছু শুকনা খাবার কিনে চলে এলাম। অনেক প্রয়োজনীয় আইটেম পেলাম না মানুষের অতিরিক্ত কেনার কারণে। যাহোক, বাসায় বসে কাজ করি, খবর দেখি, রাতে একটা করে মুভি দেখে, সন্ধ্যায় বাপ-বেটি মিলে কিছু নতুন নাশতা বানাই। এভাবেই চলছিল। প্রথম কয়েক দিন বাসায় চারজনে কার্ড খেলার চেষ্টা করলাম। কয়েক দিন পর যে যার মতো কম্পিউটার, ল্যাপটপ বা মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত। ছেলে-মেয়ে সারা রাত মুভি বা গেমস খেলে সারা দিন ঘুম। আমি বেচারা সকালে উঠে অফিস, গিন্নি তার দৈনন্দিন কাজ। আর যেহেতু কাজের লোকজনকে সবেতনে ছুটি দিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাই সব কাজ নিজেদেরই করে নিতে হয়।

ছেলে-মেয়ে তাদের নিজেদের কাপড় ধোয়া, কিছু বাসন মাজায় সাহায্য করে। বাকিটা সব আমাদের দুজনকেই করতে হয়। বেশ অন্য রকম একটা জীবন শুরু হলো সবার। আমাদের একই ভবনে আমার গিন্নির দুই আপন বোন থাকেন। তাঁদের বাসায় আসা–যাওয়াও বন্ধ হয়ে গেল। খুব জরুরি প্রয়োজন, যেমন ওষুধ শেষ হয়ে গেলে বাজারে যাই, ওষুধের সঙ্গে কিছু ফল বা অন্য কিছু কিনে আনি। বাকি সব অনলাইনে অর্ডার করি। সবজিওয়ালারা ভ্যান নিয়ে আসে, ওদের কাছ থেকেই কিনে নেওয়া হয়।

এভাবেই দিন যায়। অবসর সময়ে দেশ–বিদেশে থাকা বিভিন্ন আত্মীয়, বন্ধুদের সঙ্গে হোয়াটসঅ্যাপে বা ম্যাসেঞ্জারে কথা হয়। বিভিন্ন গ্রুপও খোলা হলো। গিন্নিরা তাদের ভাইবোনদের গ্রুপে, কখনো স্কুলের বন্ধুদের গ্রুপে, কখনো ভার্সিটি গ্রুপে বেশ আড্ডা দেয়। আমার কাজের সময় অফিসের কলিগদের কয়েকটা গ্রুপে কাজ, দৈনন্দিন বিষয় বা নিছক আড্ডা হয়। প্রতি সপ্তাহে অফিস থেকে রাষ্ট্রদূতের টাউনহল মিটিং হয়। আমাদের নিজেদের সাপ্তাহিক ও অন্যান্য মিটিং–সিটিং লেগেই আছে। স্টাফ মিটিং, টিমলিডার্স মিটিং—আরও কত মিটিং...মিটিংয়ের শেষ নেই। সব হচ্ছে গুগল মিটে।

এভাবে কত দিন চলতে হবে জানি না। মনে হয় সবাই অধৈর্য হয়ে উঠছে। আমার কিন্তু ভালোই লাগছে, বাসার সবার সঙ্গে একত্রে লাঞ্চ, ডিনার করছি। মিলেমিশে কাজ করছি। বিশেষ করে আমার বেলকনির বাগানের পরিচর্যা করতে পারছি। অনলাইনে অর্ডার করে বাগান করার কিছু যন্ত্রপাতি, বীজ, সার, মাটি কিনেছি। সেগুলো দিয়ে কাজ করছি।

আসলে আমার মনে হয়, আমরা প্রকৃতির ওপর অনেক অত্যাচার করেছি, তাই প্রকৃতি একপ্রকার প্রতিশোধই নিচ্ছে আমাদের ঘরে বন্দী করে। আর বাইরে প্রকৃতি নিজেকে আবার সাজিয়ে–গুছিয়ে নিচ্ছে। হয়তো এটাই আমাদের জন্য মঙ্গলজনক।

* দূতাবাস কর্মকর্তা: আমেরিকান দূতাবাস, বারিধারা, ঢাকা।