করোনার রোগীর বাসায় মৃত্যু ২৪ শতাংশের বেশি

ছবিটি প্রতীকী
ছবিটি প্রতীকী

বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করতেন ৫৩ বছরের আরিফুল ইসলাম। জ্বর আসার পর নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় তাঁর। এরপর বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু ধীরে ধীরে তাঁর অবস্থার অবনতি হয়। শ্বাসকষ্ট শুরু হয়, রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা কমতে থাকে। সিলিন্ডার এনে তাঁকে অক্সিজেন দেওয়া হয়। টানা দুদিন শ্বাসকষ্টের পর ৩ জুলাই হাসপাতালে নিতে অ্যাম্বুলেন্সে ওঠানোর সময় মারা যান তিনি।

শ্বাসকষ্টের পরও কেন হাসপাতালে নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে তাঁর স্ত্রী সাবিনা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, ফোনে বড় একটি বেসরকারি হাসপাতালের একজন চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে বাসায় চিকিৎসা চলছিল তাঁর স্বামীর। নানা কারণে হাসপাতালে যেতে রাজি ছিলেন না তাঁর স্বামী।

আরিফুলের মতো করোনাভাইরাসে আক্রান্ত আরও অনেক রোগী বাসায় মারা যাচ্ছেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ১ থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৪৯ জন। তাঁদের মধ্যে হাসপাতালে মারা গেছেন ২৬৫ জন, বাসায় ৮১ জন। আর ৩ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। অর্থাৎ, ২৪ শতাংশের বেশি রোগী বাসায় মারা গেছেন।

অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংকার ৬৪ বছরের হারাধন চন্দ্র অধিকারী জ্বরে ভুগছিলেন। পরিবারের সদস্যদের ধারণা ছিল, জ্বর থাকায় কোনো হাসপাতাল ভর্তি নেবে না। নমুনা পরীক্ষায় করোনা শনাক্ত হওয়ার পর গত ১১ মে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তৈরির সময় স্ট্রোক করেন তিনি। তাঁকে নেওয়ার জন্য পরপর দুটি অ্যাম্বুলেন্স আসে। কিন্তু অ্যাম্বুলেন্সের লোকজন ভবন থেকে রোগী ধরে নামাতে রাজি হননি। শেষ পর্যন্ত অনেক অনুরোধের পর একজন রাজি হন। তবে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার আগেই মারা যান হারাধন চন্দ্র।

ঘটনাটি জানিয়ে হারাধন চন্দ্রের ছেলে সৌরভ অধিকারী প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বাবা তিন ঘণ্টা বাসায় পড়ে ছিলেন। হাসপাতাল নিতে পারলে হয়তো তাঁকে বাঁচানো যেত।

৯৫ শতাংশ রোগী বাসায়

মালয়েশিয়ার ব্যবসা করতেন এ এস এম ফয়সাল। দেশে ফেরার এক মাস পর জ্বরে পড়েন। কয়েক দিন পর শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। চিকিৎসক দ্রুত হাসপাতালে ভর্তির পরামর্শ দিলেও রাজি হননি রোগী। তিনি বাসাতেই চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। বাসাতেই অক্সিজেনের ব্যবস্থা করা হয়।

ফয়সালের শ্যালক মো. নিজাম উদ্দিন বলেন, পরিস্থিতির অবনতি হলে হাসপাতালে ভর্তি করানোর চেষ্টা করেন তাঁরা। কিন্তু করোনা পরীক্ষা করানো না থাকায় গত ১৫ জুন সরকারি-বেরসকারি একাধিক হাসপাতাল ঘুরেও ভর্তি হতে পারেননি। অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে অক্সিজেন সরবরাহ শেষ হয়ে যায় এবং একপর্যায়ে তিনি মারা যান।

>

হাসপাতালের ৭২% শয্যা ও আইসিইউর ৬৫% ফাঁকা
৯৫% রোগী বাসায়
১ থেকে ৮ জুলাই পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৪৯ জন
তাঁদের মধ্যে হাসপাতালে মারা যান ২৬৫ জন, বাসায় ৮১ জন
৩ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়

এভাবে বেশির ভাগ রোগীই বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছেন। অথচ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ৮ জুলাইয়ের তথ্য বলছে, সারা দেশে করোনার চিকিৎসার জন্য নির্ধারিত হাসপাতালের ৭২ শতাংশ শয্যা খালি পড়ে আছে। ৬৫ শতাংশ নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ) ফাঁকা। কিন্তু ৯৫ শতাংশ রোগী বাসাতেই চিকিৎসা নিচ্ছেন।

এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে করোনায় মৃত ও করোনার উপসর্গ নিয়ে মৃত ২৬ জনের পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। এর মধ্যে ১৬ জন করোনা পজিটিভ, ২ জনের নেগেটিভ, বাকি ৮ জনের নমুনা পরীক্ষা করা হয়নি। করোনা শনাক্ত হয়ে মৃত ১৬ জনের মধ্যে ৬ জন হাসপাতালে ও ১০ জন বাসায় মারা যান। বাসায় মারা যাওয়া ১০ জনের মধ্যে ৬ জনের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, ভরসা না থাকায় তাঁরা হাসপাতালে রোগী নেননি। দুজনের পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, রোগীর অবস্থা হাসপাতালে নেওয়ার মতো বলে মনে হয়নি তাঁদের কাছে। আর বাকি দুজনের পরিবারের সদস্যরা বলছেন, হাসপাতালের নেওয়ার মতো লোকজন ছিল না তাঁদের।

অনেকের হাসপাতালে ভরসা না থাকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘দুর্নীতি-অনিয়মের অভিযোগ অনেক পুরোনো। যে হাসপাতালে যা দরকার, তা করা হয়নি। কমিউনিটিভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তুললে আজ এ পরিস্থিতি তৈরি হতো না।’

নানা অভিযোগ

বয়সজনিত নানা জটিলতা নিয়ে গত জুনে ৭৬ বছর বয়সী সাবেক এক সরকারি কর্মকর্তা বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। প্রথমে করোনা নেগেটিভ এলেও ১০ দিন পর করোনা শনাক্ত হয় তাঁর। সে সময় তাঁকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়। পরে স্বজনেরা রোগীকে বাসায় নিয়ে যান। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই রোগীর ছেলে বলেন, হাসপাতালে কয়েক লাখ টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। পরে বাসায় এনে নিজেই বাবার সেবা করেছেন। কিন্তু ১৮ জুন তিনি মারা যান।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যাওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ, স্বাস্থ্যকর্মীরা দূর থেকে ওষুধ ও অন্যান্য জিনিস দেন। অক্সিজেন সরবরাহের ঘাটতি আছে। হাসপাতালে ভর্তি থাকা অবস্থায়ও নমুনা পরীক্ষা করাতে লম্বা সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে চট্টগ্রামে।

এ প্রসঙ্গে করোনা প্রতিরোধে সরকার গঠিত কারিগরি কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, শ্বাসকষ্ট শুরু হলেই মূলত চিকিৎসা শুরু হয়। এর আগে শুধু শুয়ে থাকা। আর করোনা রোগীর হাসপাতালে যাওয়া মানে দ্বীপান্তরে যাওয়া। এমন পরিস্থিতিতে হাসপাতালের অমানবিক অবস্থার জন্যই রোগী যেতে চায় না।

করোনার পরীক্ষা নেই তো ভর্তি নেই

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অবসর নিয়ে বাসায় থাকতেন ৭২ বছরের রফিকুল ইসলাম। তিনি কিডনির জটিলতায় ভুগছেন। দেড় বছর ধরে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করাতেন। সম্প্রতি হঠাৎ করে জ্বর আসে তাঁর। জ্বরের কথা শুনে আর ডায়ালাইসিস করাতে রাজি হয়নি ওই হাসপাতাল। অবস্থা খারাপ হলে একটি সরকারি ও দুটি বেরসকারি হাসপাতালে নিয়ে গেলেও করোনা পরীক্ষা করানো না থাকায় চিকিৎসা পাননি রোগী। বরং সারা দিন অ্যাম্বুলেন্সে ঘুরে আরও খারাপ হয়ে যায় অবস্থা। ৩১ মে তিনি মারা যান।

তাঁর স্ত্রী ফেরদৌসী সুলতানা প্রথম আলোকে বলেন, মৃত্যুর দুদিন পর করোনা শনাক্তের তথ্য আসে। ডায়ালাইসিস করাতে গিয়েই তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। অথচ সেই হাসপাতালও তাঁর চিকিৎসা দিতে রাজি হয়নি।

এমন অভিযোগ করেছেন আরও কয়েকজন। তাঁরা বলছেন, নমুনা পরীক্ষা করাতে লম্বা লাইন। তারপর ফল আসতে কয়েক দিন লেগে যায়। এতে রোগীর অবস্থা খারাপ হতে থাকে।

এ বিষয়ে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শুধু করোনা রোগী নয়, নমুনা পরীক্ষার জন্য অন্য রোগীরাও চিকিৎসা পাচ্ছেন না। পরীক্ষার আওতা বাড়ানো এবং ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফল জানানোর ব্যবস্থা করা জরুরি।

অপেক্ষা করতে করতে মৃত্যু

জ্বর নিয়ে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন ৭০ বছরের চিত্তরঞ্জন দাস। চিকিৎসক জানান, তাঁর নিউমোনিয়া জটিল আকার ধারণ করেছে। করোনার নমুনা পরীক্ষা করাতে দিয়ে বাসায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। কিন্তু ফল আসার আগেই মারা যান তিনি। তাঁর ছেলে (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) জানান, হাসপাতালে নেওয়ার মতো অবস্থা মনে হয়নি। কিন্তু হঠাৎ স্ট্রোক করে ৯ জুন মারা যান তিনি।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্যবিদ মুশতাক হোসেন বলেন, বাসায় থাকলেও সব রোগীর দায়িত্ব সরকারের। তার নিয়মিত খোঁজ রাখতে হবে। এপ্রিল পর্যন্ত এটি করেছে আইইডিসিআর। এরপর রোগী বেড়ে যাওয়ায় এ ক্ষেত্রে গাফিলতি হয়ে গেছে। নিয়মিত খোঁজ
রাখলে যথাসময়ে হাসপাতালে আনা যেত। মৃত্যুহার আরও কমত।