স্বাস্থ্যে অব্যবস্থাপনা-অনিয়মের প্রভাব করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসায়

প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি। ছবি: রয়টার্স

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম যেন দৈনন্দিন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঘটনাগুলোর পরিষ্কার ব্যাখ্যা অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা দিচ্ছেন না। এর প্রভাব পড়ছে করোনা পরীক্ষা ও চিকিৎসার ওপর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নজরদারি ও মূল্যায়ন ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি এই পর্যায়ে এসেছে।

গত বৃহস্পতিবার নিয়মিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, দুটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। একটি কলেজে বিলম্বে যন্ত্র আসার কারণে পরীক্ষা শুরু করতে দেরি হচ্ছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই কলেজের করোনা পরীক্ষার উপযুক্ত আরটি–পিসিআর যন্ত্রই নেই। যাচাই না করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কলেজটিকে ল্যাবরেটরির অনুমতি দিয়েছে।

এর আগে জেকেজি নামের একটি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া নমুনা পরীক্ষার ঘটনা সামনে আনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সেই ঘটনা মানুষের মন থেকে মুছে যাওয়ার আগেই রিজেন্ট হাসপাতালের প্রতারণা সারা দেশে সাড়া ফেলে। রিজেন্টের সঙ্গে করা চুক্তিপত্রে সই আছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল শাখার একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেছেন, রিজেন্টের ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর একটি তদন্ত কমিটি করেছে। জেকেজির বিষয়ে তেমন কিছু হয়নি। অন্যদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, ল্যাবরেটরি সরেজমিনে না দেখে আরও কিছু প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, শুধু ল্যাবরেটরি বা হাসপাতালের অনুমতির বিষয় নয়, আরও কিছু ঘটনায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের জবাবদিহির ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। বেশ কয়েকটি হাসপাতালে ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে রাজধানীতে একাধিক মৃত্যুর ঘটনায় কোনো তদন্তের উদ্যোগ নেয়নি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। পাঁচ হাজারের বেশি চিকিৎসক, নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন, অনেকে মারা গেছেন। স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ ঝুঁকির কারণ অনুসন্ধান এবং করণীয় নির্ধারণের কথা ছিল। সেই কাজ কেন হয়নি, কেউ জানে না। গবেষণা, পরিকল্পনা, নীতিনির্ধারণের জন্য যে মানসম্পন্ন রোগতাত্ত্বিক তথ্য–উপাত্ত–পরিসংখ্যান দরকার, তা নেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্যরা সংশ্লিষ্ট দপ্তরে চিঠি লিখেও তথ্য পাননি।

অন্যদিকে চিকিৎসা সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নিম্নমানের মাস্কের বিষয়ে মুগদা ও খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের দুজন সরকারি কর্মকর্তা প্রতিবাদ করেছিলেন। পরে তাঁদের একজনকে বদলি এবং অন্যজনকে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা করা হয়। এসব বিষয়ে স্পষ্ট করে কেউ কিছু বলছেন না। তবে ২৬ জুন বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশে করোনা: ছয় মাসের পর্যালোচনা’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল সভায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক আবুল কালাম আজাদ বলেছিলেন, দুর্নীতির তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদের সহায়তা করছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিভিন্ন তলার দেয়ালে লেখা আছে, আমি ও আমার প্রতিষ্ঠান দুর্নীতিমুক্ত। গত এক মাসে অধিদপ্তরের বড় দুর্নীতি ও অনিয়মের ঘটনা জনসমক্ষে এনেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। দুদকও স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত ১৪টি প্রতিষ্ঠানের তালিকা প্রকাশ করছে। অনেকে মনে করেন, এসব প্রতিষ্ঠান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে নিয়েই দুর্নীতি করেছে।

মহামারির সময় অনেক সিদ্ধান্ত ত্বরিত নিতে হয়। তবে বৈশ্বিকভাবে বলা হচ্ছে, মৌলিক কিছু বিষয় মেনেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এর মধ্যে আছে, কাজের আইনগত ভিত্তি থাকতে হবে, যাকে কাজ দেওয়া হবে তার অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকতে হবে।

দুর্নীতি প্রতিরোধবিষয়ক প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘মহামারিকে অনেকে নিজেদের সম্পদ বিকাশের সুযোগ হিসেবে নিয়েছেন। রিজেন্ট বা জেকেজি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে এসব দুর্নীতি করেছে। রিজেন্টের সঙ্গে অধিদপ্তরের চুক্তি আইনগতভাবে ঠিক ছিল না।’

এসব ব্যাপারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানান।

ল্যাব নিয়ে নানা কথা

করোনা পরীক্ষা নিয়ে দুই রকম অবস্থান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের। শুরুতে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্বে ছিল সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর)। পরীক্ষায় সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি)সহ একাধিক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এসেছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তাদেরকে পরীক্ষার কাজে যুক্ত করেনি। আইইডিসিআরের পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা একাধিকবার বলেছিলেন, প্রতিটি ল্যাব হতে হবে মানসম্পন্ন। ল্যাবের জন্য যন্ত্র, প্রশিক্ষিত টেকনোলজিস্ট, উপযুক্ত নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকলে তাকে অনুমতি দেওয়া হবে না।

>

যন্ত্র নেই এমন প্রতিষ্ঠানকে নমুনা পরীক্ষার অনুমতি
প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে না জেনেই কাজ দেওয়া হচ্ছে
রোগতাত্ত্বিক তথ্য-উপাত্ত প্রকাশে অনীহা
স্বাস্থ্যকর্মীদের সংক্রমণ ঝুঁকির কারণ বিশ্লেষণে বিলম্ব

৪ মে পরীক্ষার দায়িত্ব থেকে আইইডিসিআরকে সরিয়ে দেওয়া হয়। করোনা পরীক্ষায় যুক্ত হতে থাকে নতুন নতুন সরকারি–বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। এখন ৭৭টি প্রতিষ্ঠান করোনা পরীক্ষায় যুক্ত হয়েছে। কিন্তু এদের সবার মান বা সক্ষমতা যাচাই করে দেখেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষার ফলাফল ও সনদ নিয়ে নানা অভিযোগ উঠতে থাকে। সাধারণ মানুষ ভুল সনদ পেয়েছে, প্রতারণার শিকার হয়েছে। একটি অভিযোগেরও সত্যতা যাচাই করেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

গত বৃহস্পতিবার সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা বলেন, অনুমতি দেওয়ার পরও কেন নমুনা পরীক্ষা করছে না, তা জানতে চেয়ে দুটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজকে চিঠি দেয় অধিদপ্তর। একটি প্রতিষ্ঠান উত্তর দেয়নি, অন্যটি বলেছে, তাদের যন্ত্র আসতে বিলম্ব হবে।

শেষের প্রতিষ্ঠানের প্রধানের সঙ্গে গতকাল শুক্রবার যোগাযোগ করে প্রথম আলো। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান বলেন, ১২ জুলাই দেশে পৌঁছাবে নমুনার পরীক্ষার আরটি–পিসিআর যন্ত্র।

যন্ত্রই নেই এমন প্রতিষ্ঠানকে পরীক্ষার অনুমতি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। কিসের ভিত্তিতে অনুমতি পেল প্রতিষ্ঠানটি, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কি সরেজমিনে ল্যাবরেটরি দেখতে গিয়েছিল? এর উত্তরে নাসিমা সুলতানা বলেন, ‘সরেজমিনে দেখা হয়নি।’ তিনি আরও বলেন, প্রতিষ্ঠানটি যে কাগজপত্র দিয়েছিল, তার ভিত্তিতে অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। সরেজমিনে দেখার জনবলেরও ঘাটতি আছে অধিদপ্তরের।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র বলছে, এ রকম আরও অন্তত পাঁচটি প্রতিষ্ঠান ল্যাবরেটরির অনুমোদন নেওয়ার পরও পরীক্ষা শুরু করেনি।

করোনাকালে প্রভাব

পরীক্ষার দুর্ভোগ, অনিয়ম, অসংগতি এবং হাসপাতালের সেবার মান নিয়ে গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এসব ঘটনা জনমনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। দুটি ক্ষেত্রে স্পষ্টভাবে তা দেখা যাচ্ছে। কোভিড হাসপাতালে রোগী কমেছে। সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, কোভিড হাসপাতালগুলোয় ৭২ শতাংশ শয্যা খালি। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, স্বাস্থ্য ব্যবস্থা ও হাসপাতালে আস্থা রাখতে পারছেন না বলে মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাচ্ছেন না।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ বলেন, নানা ঘটনা, অভিজ্ঞতার কারণে কিছু মানুষ পরীক্ষা করানো এবং হাসপাতালে যাওয়া থেকে বিরত থাকছেন। এতে সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে।

করণীয়

পরিস্থিতির উন্নতির জন্য করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘শীর্ষ পর্যায়ের রাজনৈতিক নির্দেশনা এবং সেই নির্দেশনার বাস্তবায়ন ছাড়া পরিস্থিতির উন্নতি হবে এমন আশা করা যায় না। নির্দেশনা এলে তা বাস্তবায়নে প্রয়োজনে টাস্কফোর্স করা যেতে পারে।’

তবে জবাবদিহি ও দায়বদ্ধতা বাড়াতে দুর্নীতি প্রতিরোধের পাশাপাশি আরও কিছু করা প্রয়োজন বলে মনে করেন জনস্বাস্থ্যবিদ অধ্যাপক বে–নজির আহমেদ। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পরিকল্পিত পর্যালোচনা ও নজরদারির ব্যবস্থা না থাকায় পরিস্থিতি এমন হয়েছে। তৃতীয় কোনো পক্ষকে দিয়ে নিয়মিত মূল্যায়নের ব্যবস্থা করলে অবস্থার উন্নতি সম্ভব।