বাল্যবিবাহ যখন বড় চ্যালেঞ্জ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাল্যবিবাহ এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধিই নয়, বাল্যবিবাহের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে কিশোরী ও নারীর প্রজননস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু, নারীর শিক্ষা, উপার্জনসহ সামগ্রিক সামাজিক সক্ষমতা। এগুলো একটির সঙ্গে আরেকটি জড়িত বলে যেকোনো এক ধাপের গরমিলে অঙ্কের মতো শেষে এসে হিসাবে গোলমাল পাকিয়ে যাচ্ছে। হিসাবটি আরও জটিল করে তুলেছে কোভিডকাল। গবেষণা ও মাঠপর্যায়ের তথ্য বলছে, এ সময়ে বাল্যবিবাহ আরও বেড়েছে।

আজ ১১ জুলাই বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস। এবার দিবসের মূল প্রতিপাদ্য হচ্ছে, ‘মহামারি কোভিড–১৯ প্রতিরোধ করি, নারী ও কিশোরীদের সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করি’। সংশ্লিষ্টদের মতে, মহামারিতে নারী ও কিশোরীদের সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে হলে সবার আগে জোর দিতে হবে তাঁদের প্রজননস্বাস্থ্যের ওপর। কারণ, কম বয়সে বিয়ে, কম বয়সে সন্তান জন্ম দেওয়ার ঘটনায় তাঁদের প্রজননস্বাস্থ্য আজ সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে।

দেশে বাল্যবিবাহের একটি চিত্র পাওয়া যায় জাতীয় জনসংখ্যা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটের (নিপোর্ট) জরিপে। সংস্থার তথ্য অনুসারে, ২০ থেকে ২৪ বছর বয়সী নারী গ্রুপের মধ্যে ১৮ বছরের আগে বিয়ে হয় প্রায় ৫৯ শতাংশ মেয়ের। ১৯৯৩ সালে ১৮ বছরের আগে বিয়ে হতো ৭৩ শতাংশ মেয়ের। ১৯৯৯–২০০০ বছরে কমে দাঁড়ায় ৬৫ দশমিক ৩ শতাংশে। ২০১১ সালে ৬৫ শতাংশ এবং ২০১৪ সালে ৫৮ দশমিক ৬ শতাংশ ছিল। সবশেষ ২০১৭–১৮ সালের জরিপে দেখা গেছে, এ হার প্রায় একই জায়গায় আটকে রয়েছে, ৫৮ দশমিক ৯ শতাংশ।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, দেশে প্রায় প্রতি তিনজন কিশোরীর একজন এখনো গর্ভধারণ করেন ২০ বছরে পৌঁছানোর আগেই। এই বাস্তবতায় কোভিডকালীন ও পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হলো, বাল্যবিবাহ, অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভধারণ, কিশোরী মাতৃত্ব, উচ্চ মাতৃমৃত্যুহার এবং পরিবার পরিকল্পনার ক্ষেত্রে অপূর্ণ চাহিদার মতো বিষয়গুলো।

বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটছেই

স্বাভাবিক সময় বা দুর্যোগ—যেকোনো পরিস্থিতিতে দেশে বাল্যবিবাহের ঘটনা ঘটেই চলেছে। গত ৩০ জুন প্রথম আলোতে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাভাইরাস সংক্রমণ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে গুরুদাসপুর উপজেলার চাপিলা ইউনিয়নের একটি স্কুলের ১৩ জন শিক্ষার্থী বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে একজন অষ্টম শ্রেণির এবং বাকি ১২ জন নবম শ্রেণির। অভিভাবকেরা বিয়ের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে জানান, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে মেয়েরা পড়াশোনা করে না, মাথায় অপসংস্কৃতি ভর করেছে, পাড়ার উঠতি বয়সী ছেলেরা বেপরোয়া। পারিবারিক সম্মানের ভয়ে বিয়ে দিয়েছেন। এ ছাড়া অল্প বয়সে বিয়ে দিলে যৌতুক কম লাগে।

বেসরকারি সংগঠন ব্র্যাক এই সময়ে ১১টি জেলায় ৫৫৭ জন নারী–পুরুষের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে জানিয়েছে, বাল্যবিবাহ আগের চেয়ে ১৩ শতাংশ বেড়েছে। বেশির ভাগ বাবা–মা মনে করেন, করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকট দীর্ঘায়িত হতে পারে। তাই মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেওয়াই ভালো।

প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল কুড়িগ্রাম জেলার বাল্যবিবাহের পরিস্থিতি তুলে ধরে জানিয়েছে, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে জেলায় বাল্যবিবাহের হার ছিল ৮ শতাংশ। এপ্রিলে সেটি ৯ শতাংশ এবং মে মাসে ১১ শতাংশে পৌঁছায়।

>

বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস আজ
বাল্যবিবাহের দুষ্টচক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে প্রজননস্বাস্থ্য, মাতৃমৃত্যু, নারীর শিক্ষাসহ সামগ্রিক সক্ষমতা

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিল (ইউএনএফপিএ) কর্মসূচি বিশেষজ্ঞ আবু সাইদ খান বলেন, ‘কম বয়সে বিয়ে হওয়ার মানে হচ্ছে, একজন নারী সন্তান জন্মদানের জন্য দীর্ঘ সময় পান। আমাদের দেশে সামাজিক ট্যাবু রয়েছে, মেয়েটি কতখানি প্রজননক্ষম, সেটার প্রমাণ তাকে বিয়ের পরপরই দিতে হয়। ফলে মেয়েটি বিয়ের পরের বছরেই সন্তান জন্ম দেয়।

করোনাকালে ব্যাহত হবে জন্মনিয়ন্ত্রণ

গত ৭ মে ইউনিসেফ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড মহামারির সময়ে বাংলাদেশে আনুমানিক ২৪ লাখ শিশুর জন্ম হবে। বিশ্বজুড়ে এই সময়ে জন্ম নেবে আনুমানিক ১১ কোটি ৬০ লাখ শিশু। গত ১১ মার্চ বিশ্বে কোভিড–১৯ মহামারি ঘোষিত হওয়ার পর ৪০ সপ্তাহের মধ্যে এসব শিশুর জন্ম নেওয়ার কথা রয়েছে। এ ক্ষেত্রে বিশ্বে নবম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

গত ২৮ এপ্রিল প্রকাশিত ইউএনএফপিএর এক পরিসংখ্যানে ধারণা দেওয়া হয়, লকডাউন এবং কোভিড–১৯ সম্পর্কিত বিধিনিষেধ তিন মাস অব্যাহত থাকলে ১৪৪টি নিম্ন ও মধ্য আয়ের দেশের ৪ কোটি ৪০ লাখ পর্যন্ত নারী জন্মনিরোধক ব্যবস্থা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবেন। এর ফলে আনুমানিক ১০ লাখ অনিচ্ছাকৃত গর্ভধারণের ঘটনা ঘটতে পারে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, কোভিডের কারণে কারখানায় উৎপাদন কমে যাওয়া এবং কাঁচামাল আমদানি না থাকায় দেশে আগামী ছয় মাসের মধ্যে জন্মনিরোধক প্রাপ্তির ক্ষেত্রে সংকট দেখা দিতে পারে। তবে পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের পরিচালক (মা ও শিশু) মোহাম্মদ শরিফ বললেন, জন্মনিরোধক সামগ্রীর কোনো সংকট হবে না। ছয় মাসের মজুত রয়েছে।