ভরা হাতে গ্রামে ফিরবেন সিরাজুল

মো. সিরাজুল ইসলাম। ছবি: লেখক
মো. সিরাজুল ইসলাম। ছবি: লেখক

আমার হাতে হাঁড়িভাঙা আমের ১০ কেজি ওজনের ব্যাগ। দিতে যাব এক বড় ভাইকে। রিকশা ডাকতেই হলো। একহারা গড়নের এক রিকশাওয়ালা এসে দাঁড়ালেন সামনে। গন্তব্য বলে উঠে বসলাম। হাতে আমের ব্যাগ দেখেই হয়তো রিকশাওয়ালা আলাপ জুড়ে দিলেন, ‘স্যার, হামারো একখান আমের বাগান আছে।’ কণ্ঠে রংপুরের টোন। তারওপর আমবাগান আছে শুনে চমকে উঠতে হলো। কারণ, যে মানুষের আমের বাগান আছে, তিনি ঢাকা শহরে রিকশা চালাচ্ছেন কেন!

নাম সিরাজুল ইসলাম। সাকিন বালুয়াভাটা, বদরগঞ্জ, রংপুর। একটু সংশোধন আছে বটে। জন্মেছিলেন সেখানেই। কিন্তু সরকারি জমিতে থাকতে মন চায়নি বলে যখন কিছুটা স্বাবলম্বী হয়েছেন, তখন চলে এসেছিলেন মিঠাপুকুরের জারুল্লাপুর গ্রামে। সেখানেই ভিটার মাটি কিনে বাড়ি করেছেন। বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। একটি পুত্রসন্তানও আছে। আর আছে লিজ নেওয়া আমের বাগান, ৫৫০ হাঁসের একটি খামার, ৩০টি ভেড়া এবং কয়েকটি গরু। প্রতিবছর নির্দিষ্ট সময়ে এই সবকিছু থেকেই তাঁর হাতে টাকা আসে। তিনি আবারও লগ্নি করেন পছন্দের খাতে। আবারও সেটা বাড়তে থাকে বছরান্তে।

মূলত হাঁড়িভাঙা আম আর জারুল্লাপুর গ্রামের সূত্র ধরেই সিরাজুলের সঙ্গে কথোপকথনের সূত্রপাত। জারুল্লাপুর গ্রামটি রংপুরের বিখ্যাত হাঁড়িভাঙা আমের জন্মস্থানখ্যাত পদাগঞ্জের পাশে, সেটা মিঠাপুকুর থানা। আমার হাতে সেই পদাগঞ্জ থেকে পাঠানো হাঁড়িভাঙা আমের ব্যাগ বলেই তিনি আগ্রহী হয়ে কথা শুরু করেছিলেন। বলছিলেন, তাঁর আমের বাগান আছে। আসলে বাগানটি তাঁর নিজের নয়। লিজ নিয়েছেন মালিকের কাছ থেকে। বাগানটি দেখাশোনা করেন সিরাজুলের ছেলে এবং শ্যালিকার স্বামী মিলে। আমের মৌসুম শেষে হিসাবের টাকা আসে তাঁর হাতে। তিনি চিন্তা করেন, সে টাকা কোথায় বিনিয়োগ করবেন। হয় নতুন আমবাগানের খোঁজ করেন, নয়তো ভেড়ার পাল বড় করেন অথবা হাঁসের খামারে নতুন ব্যাচের হাঁস তোলেন। সেসব দেখাশোনা করেন তাঁর স্ত্রী।

হঠাৎ কী হয় যেন, সিরাজুল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকেন। আমি উসখুস করি। সিরাজুল হঠাৎ ঢাকা ও রংপুরের মিশ্রিত ভাষায় কথা বলতে শুরু করেন। বলেন, ‘স্যার, ক্যান মাইনষে ঢাকা থাকি বাড়ি যাওয়া সময় মনে কষ্ট রাখে?’

আমি বললাম, কেন? আপনার কী মনে হয়?

সিরাজুল বললেন, ‘মানুষ বোকা, তাই!’

বলি, কী রকম?

সিরাজুল যা বলেন তার সারাংশ হলো, ঢাকা আসে মানুষ গতর খাটাতে। এখানে মানুষ থাকবে যত দিন তাঁর শরীর চলবে, তত দিন। তারপর ফিরে যাবে বাড়ি। এই মধ্যবর্তী সময়ে মানুষ গ্রামের বাড়িতে জমি কিনবে, পুকুর করবে। গরু-ছাগল না পাললেও অন্য কিছু করবে যাতে ফিরে যাওয়ার সময় শহরের জন্য তার মায়া না হয়। শহর ছেড়ে যেতে যেন কষ্ট না হয়। এই শহর মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে মাত্র। ভালো রাখে না। কাজেই যেকোনো সময় একে ছেড়ে যেতে হতেই পারে। তার জন্য মানুষের এত কান্নাকাটি কেন সিরাজুল সেটা ভেবে পান না।

আমি বলি, আপনার ছেলে যদি কোনো দিন শহরে এসে ফিরতে না চায়? পারবেন তাকে ফেরাতে?

সিরাজুল দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। বলেন, হয়তো তাঁর ছেলে শহরে আসবে চাকরি করতে। কিছুদিন থাকবেও হয়তো। কিন্তু গ্রাম ছেড়ে সে কোনো দিন শহরে বসতি করবে না। কাজেই তারও এ শহরে কোনো শিকড় থাকবে না। যা থাকবে, সেটা জারুল্লাপুর গ্রামে। ফলে, শহর ছেড়ে যাওয়ার সময় তারও কোনো কষ্ট হবে না।

কথায় কথা বাড়ে। সিরাজুল জানান, তাঁর সঙ্গে মেসে থাকা একটি ছেলে গতকাল চলে গেছেন বাড়ি, ব্যাগ গুটিয়ে। আর কোনো দিন তিনি ফিরবেন না। সেই কষ্টে গত রাতে সিরাজুল ঘুমাতে পারেননি। রিকশা চালানোতেও তাঁর আজ তেমন মন নেই। নেহাত জমার টাকাটা তুলতে হবে বলেই রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন। কিন্তু একটি ব্যাটারি ফ্যাক্টরিতে চাকরি করা মোস্তাক নামের সেই ছেলের কথা তিনি ভুলতে পারছেন না। এ শহরকে ঘিরেই মোস্তাক বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বাকি জীবন এখানে থেকে যাওয়ার চিন্তা করেছিলেন কষ্টেসৃষ্টে। কিন্তু হলো না। করোনা আর লকডাউন শুরু হওয়ার সময় তাঁর চাকরি চলে গিয়েছিল। মেসের ভাড়া বাকি পড়েছিল তিন মাসের। খাওয়ার টাকায় সমস্যা হয়নি। কারণ, সিরাজুল মেসের অন্য রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে কথা বলে মোস্তাকের খাওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু আর পারা যাচ্ছে না। মোস্তাক কবে চাকরি ফিরে পাবেন, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। কাজেই মোস্তাক ফিরে গেছেন গৌরনদী, তাঁর নিজের গ্রামে।

এ ঘটনায় সিরাজুল সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, গ্রামের বাড়িতে আরও কিছু করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে নিজে এবং পরিবারের অন্যরা তাঁর অবর্তমানে অনিশ্চয়তায় না পড়ে।

গলিঘুপচি পেরিয়ে, উন্নয়নের স্মারক হিসেবে কাটা রাস্তায় ঝাঁকি খেতে খেতে আমরা গন্তব্যে পৌঁছাই। সিরাজুল রিকশা থামিয়ে বলেন, ‘যুদ্ধ তো করাই নাগব, স্যার। এত চিন্তা কইরা লাভ কী? এই এলাকায় রিকশা চালাই নয় বচ্চরের ওপর। এত মানুষ যায় নাই আগে, এবার যত মানুষ গেল বাড়ি। হ্যারা আর ফিরব মনে করছেন? পারব না। আমি পারুম স্যার। সব ঠিকঠাক কইরা আবার ফিরুম। তারপর আবার যামু। আবার আমু।’

আমি হাসি আর ভাবি, এতখানি মানসিক শক্তি কি আমাদের আছে?