জুনে শিশু নির্যাতন বেড়েছে

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বেসরকারি সংস্থা মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের (এমজেএফ) কর্ম এলাকায় জুন মাসে ৪৬২ জন কন্যাশিশু বাল্যবিবাহের শিকার হয়েছে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করা গেছে ২০৭টি। বাল্যবিবাহের সংখ্যা মে মাসে ছিল ১৭০ এবং বন্ধ করা হয়েছিল ২৩৩টি।

করোনাভাইরাসের বিস্তারের পর মে মাসের পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিচারে নারী নির্যাতন কিছুটা কমলেও জুন মাসে শিশু নির্যাতন বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে।

আজ রোববার সকালে এমজেএফ আয়োজিত এক ভার্চ্যুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। আলোচকেরা বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। কেননা, সরকার ২০৩০ সালের মধ্যে বাল্যবিবাহ এবং জোর করে বিয়ে বন্ধ করার ব্যাপারে অঙ্গীকারবদ্ধ।

এমজেএফ কর্ম এলাকায় করোনাকালে নারী ও শিশু নির্যাতন বিষয়ে গত এপ্রিল মাস থেকে ধারাবাহিকভাবে টেলিফোন জরিপ করছে। আজ জুন মাসের টেলিফোন জরিপের তথ্য এবং আগের মাসের সঙ্গে তুলনামূলক তথ্য তুলে ধরেন এমজেএফের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম। এমজেএফের সঙ্গে বিভিন্ন দাতা সংস্থার সহায়তায় পরিচালিত বিভিন্ন প্রকল্পের ১০৬টি সহযোগী সংগঠন এ জরিপে সহায়তা করেছে।

এমজেএফের দেওয়া তথ্য বলছে, জুন মাসে ৫৩টি জেলার মোট ৫৭ হাজার ৭০৪ জন নারী ও শিশুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলা হয়েছে। এর মধ্যে ১২ হাজার ৭৪০ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছেন। নারীর সংখ্যা ৯ হাজার ৮৪৪ জন আর শিশুর সংখ্যা ২ হাজার ৮৯৬ জন। শিশুদের মধ্যে মেয়েদের সংখ্যা ১ হাজার ৬৭৭, অর্থাৎ শতকরা ৫৮ ভাগ, আর ছেলেদের সংখ্যা ১ হাজার ২১৯, অর্থাৎ শতকরা ৪২ ভাগ।

মে মাসে ২ হাজার ১৭১ জন শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। জুন মাসে ৪৮ শতাংশ শিশু অর্থাৎ ১ হাজার ৩৭৬টি শিশু নতুনভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে। পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে শতকরা ৬১ ভাগ শিশু।

ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, জুন মাসে মোট ১২ হাজার ৭৪০ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। এদের মধ্যে ৩ হাজার ৩৩২ জন নারী ও শিশু এর আগে কখনোই সহিংসতার শিকার হয়নি।

আলোচনায় শাহীন আনাম বলেন, জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার পাশাপাশি ফাউন্ডেশনের ধারাবাহিক টেলিফোন জরিপেও নারী ও শিশু নির্যাতন বাড়ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে। ফাউন্ডেশন প্রতি মাসেই নির্যাতনের তথ্য-উপাত্ত প্রকাশ করে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কাছে নির্যাতন প্রতিরোধে বিভিন্ন সুপারিশ দিচ্ছে। তবে নারী ও শিশু নির্যাতন, বিশেষ করে বাল্যবিবাহ ঠেকানোর কাজটি মাঠপর্যায়ে ঢিমে তালে চলছে। বিচারহীনতার পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন ব্যবস্থা বা প্রতিরোধ কার্যক্রমগুলো কাজ না করায় পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করছে।

শাহীন আনাম বলেন, ঘরে-বাইরে নারী বিভিন্ন অসমতা বা বৈষম্যের শিকার হন। নারীকে সম্মান করা হয় না। নারীর কাজের যে অবদান, তার স্বীকৃতি নেই। এই বিষয়গুলো নারী নির্যাতনকে সব সময় উসকে দেয়। করোনার সময়ে এসব পরিস্থিতির সঙ্গে মানুষের কাজ না থাকা, অভাব প্রকটতর হওয়াসহ অন্য চ্যালেঞ্জগুলো যোগ হচ্ছে। আর এর ফলে নারী ও শিশুরা বেশি নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। আর করোনাকাল যত দীর্ঘ হচ্ছে, তত শিশুদের ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ছে।

বাল্যবিবাহ বাড়া প্রসঙ্গে শাহীন আনাম বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় মেয়েশিশুরা ঘরে বন্দী হয়ে আছে। বেশির ভাগের কোনো কাজও নেই। অভিভাবকেরা মেয়েকে ঘরে বসিয়ে বসিয়ে খাওয়াতে চাইছেন না। ঘরে-বাইরের যৌন নির্যাতন থেকে রক্ষা করতেও মেয়ের বিয়ে দিয়ে দিতে চাইছেন।

ক্ষোভ প্রকাশ করে শাহীন আনাম বলেন, ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে ধর্ম মন্ত্রণালয় এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনকে প্রেস রিলিজ দিয়ে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ, বাল্যবিবাহ বন্ধ করাসহ বিভিন্ন তথ্য প্রচার করার জন্য আহ্বান করা হয়েছিল। কিন্তু সরকারের এ সংস্থাগুলো বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে প্রচার করেছে বলে কোনো তথ্য জানা নেই। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা আছেন উপজেলা পর্যায় পর্যন্ত। আর বর্তমানে লকডাউন শিথিল হয়েছে, সাধারণ ছুটি শেষ হয়েছে। তাই নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারের বিভিন্ন ম্যাকানিজমকে আবার কার্যকর করতে হবে। ভার্চ্যুয়াল কোর্টে ধর্ষণ, খুন না হলে অন্য মামলাগুলো, বিশেষ করে পারিবারিক মামলাগুলো নেওয়া হচ্ছে না।

এমজেএফ আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে ফাউন্ডেশনের সহযোগী বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা নিজ নিজ এলাকার নারী ও শিশু নির্যাতনের তথ্য তুলে ধরেন।

ফাউন্ডেশনের তথ্য বলছে, জুন মাসে ১ হাজার ৭৬৪টি শিশু পারিবারিক সহিংসতার শিকার হয়েছে। এ ছাড়া কর্মক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২৯২ শিশু। ধর্ষণ করা হয়েছে ৯ জনকে এবং ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৯৯ জন শিশুকে যাদের মধ্যে ৮৬ জন মেয়ে। হত্যা করা হয়েছে ৪১ জনকে, অপহৃত হয়েছে ১০ জন, যৌন হয়রানির শিকার হয়েছে আরও ১২ জন। অন্যদিকে, মাসটিতে মোট আক্রান্ত নারীদের মধ্যে নতুন করে আক্রান্ত নারীর সংখ্যা ১ হাজার ৯৫৬ জন বা ২০ শতাংশ। নারীদের শতকরা ৯৮ ভাগ অর্থাৎ ৯ হাজার ৬৯৩ জন পারিবারিক সহিংসতার শিকার। পারিবারিক সহিংসতার মধ্যে মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৪ হাজার ৬২২ জন। অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার ৩ হাজার ৯ জন, শারীরিক নির্যাতনের শিকার ১ হাজার ৮৩৯ জন, ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ৩৫ জনকে, হত্যা করা হয়েছে ১৪ জনকে এবং ত্রাণ আনতে গিয়ে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন পাঁচজন।