আশ্রয়কেন্দ্রে যাচ্ছে না কেন বন্যার্ত মানুষ

উজানের পানিতে আবারও ভেসেছে সুনামগঞ্জ। সুরমা নদীর পানি সড়ক পেরিয়ে হাওরে ঢুকছে। গতকাল দুপুরে জামালগঞ্জ উপজেলা সড়কের জগাইরগাঁও এলাকায়।  ছবি: খলিল রহমান
উজানের পানিতে আবারও ভেসেছে সুনামগঞ্জ। সুরমা নদীর পানি সড়ক পেরিয়ে হাওরে ঢুকছে। গতকাল দুপুরে জামালগঞ্জ উপজেলা সড়কের জগাইরগাঁও এলাকায়। ছবি: খলিল রহমান

রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার লক্ষ্মীটারি ইউনিয়নের ১৫ হাজার মানুষ বন্যায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। এসব বন্যার্ত মানুষ সড়কে ও বাঁধের ওপরে আশ্রয় নিয়েছে। এখন পর্যন্ত ওই ইউনিয়নে কোনো আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে কি না, তা বন্যার্ত মানুষেরা জানে না। স্থানীয়দের অভিযোগ, এ ব্যাপারে কোনো প্রচারণাও সেখানে নেই। ফলে একই সঙ্গে বন্যার্ত মানুষের কষ্ট যেমন বাড়ছে, আবার সড়ক-বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

তবে তার উল্টো চিত্রও আছে। সুনামগঞ্জ সরকারি কলেজে এরই মধ্যে প্রায় দুই হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। সেখানে বিভিন্ন কক্ষ তো বটেই সিঁড়িতেও মানুষ অবস্থান করছে। দুই জেলার এই দুই চিত্র থাকলেও সামগ্রিকভাবে আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে এখন পর্যন্ত মানুষের আশ্রয় নেওয়ার পরিমাণ কম।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বন্যায় এ পর্যন্ত প্রায় ১৫ লাখ মানুষ পানিবন্দী ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য সারা দেশে ৭২৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হলেও সেখানে মাত্র ৯ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে।

দৈনিক দুর্যোগ পরিস্থিতি প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশের ১৫টি জেলায় বন্যায় ১২ লাখ ২৪ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও ২ লাখ ২২ হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে, যার অর্ধেকের বেশি সুনামগঞ্জ জেলায়। উত্তরাঞ্চলের বন্যাকবলিত জেলাগুলোতে আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষের আশ্রয় নেওয়ার পরিমাণ খুবই কম।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. আতিকুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে কম যাওয়ায় আমাদেরও ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে সমস্যা হচ্ছে। কারণ, বন্যার্ত মানুষেরা বিচ্ছিন্নভাবে সড়কে ও বাঁধে আশ্রয় নেওয়ায় তাদের কাছে ত্রাণ পৌঁছানো যাচ্ছে না।’

>আগামী দু-তিন দিন দেশের বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হবে। আগামীকাল দেশের বেশির ভাগ এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা আছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড ভালনারেবিলিটি স্টাডিজের শিক্ষক মো. খালিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্যার সময় মানুষ সাধারণত তাদের বাড়ির আশপাশে কোনো উঁচু স্থান বা বাড়ি পেলে সেখানে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কারণ, বাড়িতে থাকা সম্পদ ও গবাদিপশু রেখে তারা দূরে কোথাও যেতে চায় না। তাই আমাদের প্রথাগত আশ্রয়কেন্দ্রের ধারণা থেকে সরে এসে প্রতিটি এলাকায় যাতে কিছু বাড়ি উঁচু ও পাকা করা যায়, সেই ব্যবস্থা করা উচিত।’

এদিকে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী আগামী দুই-তিন দিন দেশের বন্যা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি হবে। বাংলাদেশের উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ৩০০ মিলিমিটারের ওপরে ও শিলংয়ে ২০০ মিলিমিটারের ওপরে বৃষ্টি হয়েছে। ওই পানি আগামী এক থেকে দুই দিনের মধ্যে বাংলাদেশের দিকে আসবে।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের হিসাবে দেশের ভেতরে পঞ্চগড়েও ১১৬ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। আগামীকাল দেশের বেশির ভাগ এলাকায় মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টির আশঙ্কা আছে। উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি হতে পারে।

এই ভারী বৃষ্টি ঢল হয়ে উজানের জেলাগুলোতে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটাবে। আগামী এক সপ্তাহে সিলেট, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও দেশের উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ জেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হবে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে কমপক্ষে ২৫টি জেলায় বন্যার পানি প্রবেশ করতে পারে। এতে বন্যায় আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়তে পারে। ১৫ থেকে ২০ লাখ মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে হতে পারে।

জাতিসংঘের হিসাবে ২০১৮ সালের বন্যায় প্রায় ৭৬ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত ও পানিবন্দী হয়ে পড়েছিল। মানুষ মারা গিয়েছিল ১০০ জনের ওপরে। বাড়িঘর, ফসল ও গবাদিপশুরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। তবে এবারের বন্যায় এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুসংবাদ পাওয়া যায়নি।

এ ব্যাপারে অস্ট্রেলিয়ার কার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্থ সায়েন্স ও প্লাটেটারি বিভাগের শিক্ষক আশরাফ দেওয়ান প্রথম আলোকে বলেন, উন্নত দেশগুলোতে বন্যা ও ঝড়ের মতো দুর্যোগের সময় কমিউনিটি সেন্টারগুলো মানুষের আশ্রয় নেওয়ার জন্য খুলে দেওয়া হয়। দেশের প্রতিটি এলাকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন স্থাপনাকে যাতে বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে কাজে লাগানো যায়, সেই পরিকল্পনা করতে হবে।