খাবার ও আশ্রয়ের খোঁজে কাউনিয়ার মানুষ

হু হু করে বাড়ছে পানি তাই কোলের সন্তানকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন গৃহবধূ কামরুন্নাহার। কাউকে দেখলেই এগিয়ে আসছেন। স্বামী গেছেন খাবারের খোঁজে। ঢুষমারা, কাউনিয়া, রংপুর। ছবি: প্রথম আলো
হু হু করে বাড়ছে পানি তাই কোলের সন্তানকে নিয়ে অসহায় হয়ে পড়েছেন গৃহবধূ কামরুন্নাহার। কাউকে দেখলেই এগিয়ে আসছেন। স্বামী গেছেন খাবারের খোঁজে। ঢুষমারা, কাউনিয়া, রংপুর। ছবি: প্রথম আলো

ঘরে কোথাও এক হাঁটু পানি, আবার কোথাও কোমর সমান। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানির নলকূপও তলিয়ে গেছে। চারদিকে পানি আর পানি। ঘরে খাবার নেই। শুকনা খাবার সংগ্রহে যা ছিল, তা-ও শেষের দিকে। এরই মধ্যে কেউ কেউ ত্রাণের জন্য ছুটে যাচ্ছেন উপজেলা সদরে।

নদীর পানি বাড়বে, এমন আশঙ্কা নিয়ে নিরাপদে থাকার জন্য মাইকযোগে প্রচারণাও চালানো হচ্ছে। এমনই শঙ্কা নিয়ে দুর্বিষহ জীবন কাটছে রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সদর বালাপাড়া ইউনিয়নের ঢুষমারা চরের বন্যাকবলিত মানুষদের।

ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় সূত্র জানায়, কাউনিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে এই ঢুষমারা চরে সাড়ে ৩০০ পরিবারের প্রায় দেড় হাজার মানুষের বাস। এটি কাউনিয়া উপজেলার সদর বালাপাড়া ইউনিয়নে।

সোমবার সকালে সরেজমিনে দেখা যায়, কৃষক আবদুল হকের বাড়িতে কোমর সমান পানি। এরই মধ্যে তাঁরা ঝুঁকি নিয়ে বসবাস করছেন। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে কোমরপানিতে ভিজে কাজ করছেন। ওই বাড়িতে বিশুদ্ধ পানি পানের একমাত্র নলকূপটিও পানিতে তলিয়ে গেছে। দেখা গেল, আবদুল হক নিজেই পাতিল নিয়ে খাওয়ার পানি সংগ্রহ করতে ছুটে যাচ্ছেন অন্য উঁচু স্থানে। তিনি বলেন, ‘গেল শনিবার রাত থাকি পানি বাড়া শুরু করছে। এই পানি আইজ আরও বাইড়ে ঘরবাড়ি তলে এক কোমর হয়া গেল। রান্না করারও কোনো জায়গা নাই। শুকনা খাবার চিড়া আছল, সেইগলা খায়া আছি।’

ঢুষমারা চরের চারদিকে পানি আর পানি। চার দিন আগেও সেখানে বন্যার পানি ওঠেনি। এখানকার লোকজন বেশ ভালোই ছিলেন। কিন্তু গত শনিবার রাত থেকে একটু একটু করে পানি বাড়তে থাকে। আবার কমেও যায়।

চরবাসী লোকজন ভাবছিলেন, উজানে বন্যার পানি এই ভাটি অঞ্চলে আসতে আরও সময় নেবে। কিন্তু এরই মধ্যে গত রোববার থেকে পানি বাড়া শুরু করে গতকাল সোমবার তা অনেক বেড়ে যায়। লোকজনকে সাবধান ও নিরাপদে থাকতে ঢুষমারা নদীঘাটের ইজারাদার নজরুল ইসলাম নিজস্ব উদ্যোগে মাইকযোগে প্রচারণা চালিয়েছেন।

আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে কৃষক আরিফুল ইসলাম তাঁর পোষা দুটি গরু নিয়ে পানি ডিঙিয়ে শুকনা স্থানে ছুটে চলেছেন। তিনি বলেন, ‘বাড়িত খাওয়াইয়া পাঁচজন। চাউল যা আছল, তা শেষ হয়া গেইছে। এলা ত্রাণের জন্য উপজেলা সদরে যাওয়া লাগবে।’

সেখানকার রোপণ করা আমন চারা পানিতে তলিয়ে গেছে। সেই সঙ্গে আমন বীজতলাও পানির নিচে। সবজিখেতও পানিতে তলিয়ে গেছে।

কৃষক গোলজার হোসেনের এক একর জমির আমন ধানের চারা পানির নিচে। তিনি বলেন, ‘এই পানি যদি দু-এক দিনের মধ্যে না নামি যায়, তাহলে চারা পচি যাইবে। বীজতলা যে থাকবে, সেটাও পানির নিচে। এবার হামারগুলার বিপদ আছে।’ আবদুর রহিমের পাঁচ শতাংশের আমন বীজতলা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় বড় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তিনি।

মোকসেদুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তিকে একটি নৌকায় করে তাঁর দুই সন্তান ও একটি গরু নিয়ে শুকনা জায়গায় ছুটে যেতে দেখা যায়। যেতে যেতে তিনি বলেন, ‘হামার কষ্টের শেষ নাই। এই কষ্টের মাঝোত বন্যা আসলে সেই কষ্ট অনেক বাড়ি যায়।’

দেখা গেল, নৌকায় করে অধিকাংশ নারীরা ত্রাণের জন্য ছুটে যাচ্ছেন উপজেলা সদর এলাকায়। কারও কোলে শিশু সন্তান। আর পুরুষেরা পানির মধ্যেই চৌকির ওপর বসে থাকছেন। কেউ কেউ বাড়িঘর ফেলেও অন্যত্র ছুটে যাচ্ছেন।

বালাপাড়া ইউনিয়নের ওই এলাকার ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার আমিনুল ইসলাম বলেন, বন্যাকবলিত মানুষের খোঁজখবর সব সময় নেওয়া হচ্ছে। এর আগে শুকনা খাবার দেওয়া হয়েছে। ত্রাণ হিসেবে চালও দেওয়া হবে।
বালাপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আনছার আলী বলেন, বন্যাকবলিত এলাকার লোকজনদের জন্য ত্রাণ হিসেবে চাল দেওয়া হচ্ছে। এ ছাড়া তাঁদের চলাচলে সাবধান থাকতে প্রচারণা চালানো হচ্ছে।