ফির কারণে করোনা পরীক্ষা থেকে দূরে, বাড়ছে সংক্রমণ ঝুঁকি

প্রতীকী ছবি: রয়টার্স
প্রতীকী ছবি: রয়টার্স

করোনার নমুনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণের কারণে অনেকে পরীক্ষা থেকে দূরে থাকছেন। এর মধ্যে দিনে আনুমানিক ২১০ জন করোনায় আক্রান্ত মানুষ রোগ শনাক্তকরণ পরীক্ষা থেকে বাদ পড়ছেন। মাস শেষে বাদ পড়াদের সংখ্যা ৬ হাজার ছাড়াতে পারে। এর ফলে সংক্রমণ ও মৃত্যুর পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির ঝুঁকি বাড়ছে।

করোনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণের লাভ–ক্ষতির প্রাথমিক পর্যালোচনায় এ রকম তথ্য পাওয়া গেছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ, জনস্বাস্থ্যবিদ ও ডেটা বিশ্লেষকদের একটি দল এই পর্যালোচনা করেছেন।এরা গত এপ্রিল থেকে করোনা সংক্রমণ ও পূর্বাভাস নিয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তথ্য ও বিশ্লেষণ দিয়ে সহায়তা করে আসছে।

বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, পরীক্ষার ফি নির্ধারণ, দেশের কিছু এলাকায় বন্যার প্রকোপ এবং মানুষের মধ্যে পরীক্ষা করানোর তাগিদের ঘাটতির কারণে গত দুই সপ্তাহে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা কমেছে। তবে এ নিয়ে কাঠামোগত কোনো জরিপ বা গবেষণা হয়নি।

করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে তথ্য দিয়ে সহায়তাকারী দলের সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক শাফিউন শিমুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘একাধিক জরিপে দেখা গেছে করোনার কারণে দেশে দারিদ্র্য বেড়েছে। দরিদ্র মানুষ ২০০ বা ৩০০ টাকা ফি দিয়ে করোনার নমুনা পরীক্ষা করাবে না। আমাদের অনুমান ৩০ শতাংশ পরীক্ষা কমেছে ফি নির্ধারণের কারণে।’

এ মাসের শুরু থেকে করোনা পরীক্ষার ফি নেওয়ার সিদ্ধান্ত কার্যকর করে সরকার। ২ জুলাই ১৮ হাজার ৩৬২টি নমুনা পরীক্ষা হয়েছিল। পরদিন তা কমে হয় ১৪ হাজার ৬৫০টি। ১২ জুলাই এই সংখ্যা আরও কমে হয় ১১ হাজার ৫৯টি।

এর আগে ২৮ জুন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ করোনা পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করে পরিপত্র জারি করে। তাতে বলা হয়, পরীক্ষার জন্য বুথ ও হাসপাতাল থেকে নমুনা সংগ্রহ করলে ২০০ টাকা এবং বাসা থেকে সংগ্রহ করলে ৫০০ টাকা ফি দিতে হবে। এরপর ১ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা সংশ্লিষ্ট সব দপ্তরে চিঠি দিয়ে অবিলম্বে ফি আদায়ের সিদ্ধান্ত কার্যকর করতে বলেন।

>ফি নির্ধারণের কারণে দিনে আনুমানিক ২১০ জন শনাক্তের বাইরে থাকছে
এতে সংক্রমণ বাড়ছে
এর আর্থিক ক্ষতিও বড়

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যখন বারবার পরীক্ষার ওপর জোর দিয়েছে, বাংলাদেশ ঠিক তখনই পরীক্ষা কমিয়ে দিয়েছে। জনস্বাস্থ্যবিদেরা দৈনিক ২০ হাজার নমুনা পরীক্ষার পরামর্শ দিয়েছিলেন। ল্যাবরেটরির সংখ্যা বাড়িয়েও এক দিনের জন্য সেই সংখ্যা ছুঁতে পারেনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। ৭৭টি ল্যাবরেটরিতে গতকাল ১২ হাজার ৪২৩টি পরীক্ষা হয়।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মুজেহারুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ফি নির্ধারণের ফলে উচ্চবিত্ত বা উচ্চমধ্যবিত্তরা পরীক্ষা করানো থেকে বিরত থাকেনি। পরীক্ষা করানো থেকে দূরে সরে গেছে সমাজের সবচেয়ে দরিদ্র শ্রেণির মানুষ। ২০০ টাকা তাদের কাছে অনেক টাকা।’

পরীক্ষা কমার কারণ

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড–১৯ সমন্বয় কমিটির সদস্যসচিব মো. রিজওয়ানুল করিম বলেন, ‘পরীক্ষা কমে যাওয়ার একটি কারণ ফি নির্ধারণ। অন্য কারণগুলো হচ্ছে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্রের জন্য প্রত্যেক রোগীকে দুবার পরীক্ষা না করানো, বন্যার কারণে কিছু জেলায় নমুনা সংগ্রহ ব্যাহত হওয়া, সচেতনতা বৃদ্ধির কারণে অহেতুক পরীক্ষা করানো থেকে বিরত থাকা এবং নানা অভিযোগ ওঠার কারণে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষা করাতে অনীহা।’

তবে এসব বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে নেই। ফি নেওয়া শুরুর দিন থেকে পরীক্ষার সংখ্যা কমে যাওয়ায় অনেকেই মনে করছেন, মূল কারণ এই ফি। ২০০ ও ৫০০ টাকা খরচ না করে দরিদ্র মানুষই নমুনা পরীক্ষা থেকে দূরে থাকছে।

অনেকের ধারণা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্র্যাকের বুথগুলোতে নমুনা পরীক্ষার জন্য অনলাইনে নিবন্ধন করতে হয়। অনলাইন ব্যবহারের ক্ষেত্রেও দরিদ্র মানুষের সুযোগ কম।

কী প্রভাব পড়ছে

স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ শাফিউন শিমুল বলেন, ফির কারণে পরীক্ষা কমেছে ৩০ শতাংশ। তাতে দেখা যাচ্ছে আনুমানিক দৈনিক ২১০ জন সংক্রমিত ব্যক্তি পরীক্ষা করাচ্ছেন না। মাসে এই সংখ্যা হবে ৬ হাজারের বেশি। সংক্রমণের হার (১০ জুলাইয়ের হিসেবে সংক্রমণ হার ১ দশমিক ৪৭) বিবেচনা করলে এঁদের মাধ্যমে আরও ৯ হাজার মানুষ সংক্রমিত হওয়ার আশঙ্কা আছে।

পাশাপাশি পরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে সংক্রমণও কমে। আগে পরীক্ষা করালে আগে সুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে ও মৃত্যুঝুঁকি কমে। সংক্রমণ ও মৃত্যুর তথ্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, ফি নির্ধারণের ফলে পরীক্ষা না করানোর কারণে মাসে ১১৮টি বাড়তি মৃত্যুর আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলেন, সেবার ক্ষেত্রে মূল্য বা ফি নেওয়া হয় মূলত দুটি কারণে। ফি আদায়ের মাধ্যমে সরকারি রাজস্ব বাড়ে। দ্বিতীয়ত, মূল্য নির্ধারণের মাধ্যমে কিছু মানুষকে সেবা থেকে দূরে রাখা হয় ব্যবস্থাপনার সুবিধার জন্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর দ্বিতীয় কারণকে গুরুত্ব দিয়েছিল।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক নাসিমা সুলতানা তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন, সরকার বিনা মূল্যে পরীক্ষা করছে। এ সুযোগে অধিকাংশ মানুষ উপসর্গ ছাড়াই পরীক্ষা করাচ্ছেন। যদিও কত মানুষ উপসর্গ ছাড়া পরীক্ষা করাচ্ছেন, তার কোনো হিসাব স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে ছিল না।

ফি নেওয়ার আলোচনার শুরুতেই জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি অংশ এর বিরোধিতা করেছিলেন। তাঁরা বলেছিলেন, অনেকেই ২০০, ৫০০ বা তারও অনেক বেশি টাকা দিয়ে পরীক্ষা করাতে পারবে। কিন্তু ২০০ টাকা দিয়ে একটি শ্রেণি পরীক্ষা করাতে পারবে না। প্রয়োজন না হলে মানুষ পরীক্ষার জন্য রাত জেগে লাইনে দাঁড়াত না।

এখন ৭৭টি ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা হচ্ছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কোভিড-১৯ সমন্বয় কমিটির সদস্যসচিব মো. রিজওয়ানুল করিম বলেছেন, কিট, সরঞ্জাম সব মিলে একটি পরীক্ষায় খরচ হয় ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ২০০ টাকা।

এই টাকা খরচ করে পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানো উচিত বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য অর্থনীতিবিদ শাফিউন শিমুল। তিনি বলেন, পরীক্ষা না করার ফলে একজন আক্রান্ত মানুষ অন্যকে আক্রান্ত করছেন। এঁদের চিকিৎসার খরচ, এঁদের উৎপাদনশীলতা হ্রাস—এসবের আর্থিক মূল্য পরীক্ষার খরচের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি।

একজন মানুষ পরীক্ষা না করার অর্থ সমাজে সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যাওয়া। মহামারি নিয়ন্ত্রণের মূলনীতি হচ্ছে সংক্রমিত ব্যক্তিকে পরীক্ষার আওতায় নিয়ে আসে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার সাবেক উপদেষ্টা মুজেহারুল হক বলেন, ‘রাষ্ট্রের উচিত সংক্রমিত ব্যক্তিকে পরীক্ষায় উৎসাহিত ও উদ্বুদ্ধ করা। প্রয়োজনে পরীক্ষা করতে বাধ্য করতে হবে। কিন্তু কাউকে পরীক্ষার বাইরে রাখা যাবে না।’