তাঁর বাসাটাই এখন 'মিনি হাসপাতাল'

চিকিৎসক দম্পতি খাদিজাতুল কুবরা, রাজু আহমেদ ও তাঁদের সন্তান আরাফ। ছবি: সংগৃহীত
চিকিৎসক দম্পতি খাদিজাতুল কুবরা, রাজু আহমেদ ও তাঁদের সন্তান আরাফ। ছবি: সংগৃহীত

আহমেদ আল আরাফের বয়স মাত্র সাড়ে চার বছর। তার করোনা পজিটিভ। শুধু সে নয়, তার চিকিৎসক মা রাজশাহীর চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল কর্মকর্তা খাদিজাতুল কুবরা, আরাফের নানি এবং আরাফের মায়ের নানিও (৭২ বছর) করোনা পজিটিভ। রাজশাহীতে আরাফ এই তিনজনের সঙ্গে এক ঘরেই থাকছে ১৪ দিন ধরে।

আরাফের বাবা ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজি, এমডি কোর্স) চিকিৎসক রাজু আহমেদ করোনা নেগেটিভ। তিনি স্ত্রী, সন্তান ও অন্যদের অসুস্থতার জন্য বর্তমানে রাজশাহীতে আছেন। তবে তিনিও নিজেকে বাড়ির আলাদা এক ঘরে প্রায় বন্দী করে রেখেছেন। মুখে মাস্ক, গগলস পরা অবস্থায় আরাফের কাছে তার বাবাকেও প্রায় অচেনাই মনে হয়। ফলে শারীরিক কষ্টের পাশাপাশি এই বিষয়গুলো তাকে কষ্ট দিচ্ছে। তাই খাওয়া বা অন্য কোনো কারণে বাবার কাছাকাছি গেলেই আরাফের গত ১৪ দিনে ঘুরেফিরে একটাই প্রশ্ন—বাবা, আমরা কবে আবার একসঙ্গে হব?

চিকিৎসক রাজু আহমেদ জানান, ৩৯তম বিসিএসে তাঁর স্ত্রী নিয়োগ পান চারঘাট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। তাই তিনি সন্তান নিয়ে তাঁর বাবার বাড়িতে থেকেই চাকরি করছেন। প্রথমে স্ত্রীর জ্বর হয়। তারপর পরিবারের অন্যরাও কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হন।

বর্তমানে রাজু আহমেদের শ্বশুর ও এক শ্যালিকার করোনা পজিটিভ না হলেও বিভিন্ন উপসর্গ আছে। তাই এই দুজনকেও আলাদা দুই ঘরে রাখা হয়েছে। গত ২৯ জুন থেকে চারজন করোনা পজিটিভ রোগী এবং দুজন উপসর্গ থাকা রোগী নিয়ে সংগ্রাম করছেন রাজু আহমেদ।

রাজু আহমেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিট চালুর শুরু থেকেই সেখানে দায়িত্ব পালন করছেন। বললেন, ‘স্ত্রীর শারীরিক অবস্থা বেশি খারাপ। তাঁকে ইনজেকশন দিতে হচ্ছে। নিজেই বাসার করোনা রোগীদের চিকিৎসা করছি। রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাপা, ইনজেকশন দেওয়া, ছেলেকে খাইয়ে দেওয়া—সব নিজেই করছি। বলা যায়, বাসাটাই এখন একটা মিনি হাসপাতাল। আমি যেহেতু বেশ কয়েক মাস ধরে করোনা ইউনিটে দায়িত্ব পালন করছি, ফলে করোনা রোগীদের কোন অবস্থায় কোনটা প্রয়োজন, তা বুঝতে পারি। আর সমস্যা মনে হলে হাসপাতালের স্যার, ম্যাডামদের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে নিচ্ছি।’

করোনা রোগীদের কাছাকাছি যাওয়ার সময় চিকিৎসকেরা পিপিই পরছেন। তবে বাসায় সে সুযোগ পাচ্ছেন না রাজু আহমেদ। বললেন, ‘দিনে কয়েকবার করে চারজন যে ঘরে আছেন, সেখানে আমাকে যেতে হচ্ছে। ফলে পিপিই পরা আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। এতবার পিপিই পরা, পাল্টানো এবং ডিসপোজ করা সম্ভব নয়। আমি মাস্ক, গগলস, গ্লাভসসহ অন্যান্য সুরক্ষা পোশাকে যতটুকু সম্ভব নিজে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করছি। এই চারজনের কাছ থেকে ফিরেই আমি আমার নির্দিষ্ট ঘরের ওয়াশরুমে ঢুকে যাই। গোসল এবং নিজের পরনের সব কাপড় ধুয়ে দিচ্ছি।’

করোনা আক্রান্ত ছেলেকে খাবার খাওয়াচ্ছেন বাবা রাজু আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত
করোনা আক্রান্ত ছেলেকে খাবার খাওয়াচ্ছেন বাবা রাজু আহমেদ। ছবি: সংগৃহীত

রাজু আহমেদ জানান, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে করোনা ইউনিটে সাত দিন দায়িত্ব পালনের পর ১৪ দিন হোটেলে কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়। করোনা পরীক্ষায় নেগেটিভ হলে আবার কাজে যোগ দেন। রাজশাহীতে আসার আগে তাঁর করোনা নেগেটিভ এসেছে। বললেন, ‘স্ত্রীকে যাতে হাসপাতালে ভর্তি করতে না হয়, সে দোয়া করছি সারাক্ষণ। আর কোনোভাবেই যাতে অন্ততপক্ষে এই সময় নিজে অসুস্থ না হই, সে চেষ্টা করছি। আমি নিজে অসুস্থ হলে কে কাকে দেখবে? শ্বশুরবাড়ির আশপাশে আত্মীয়স্বজনেরা বেশির ভাগ সময় রান্না করে খাবারটা দিয়ে যাচ্ছেন বলে কিছুটা রক্ষা।’

রাজু আহমেদ বললেন, ‘আমরা বড়রা অবস্থাটা বুঝতে পারি। ছেলেটার জন্য বেশি কষ্ট হচ্ছে। চোখের সামনে মা, নানিসহ অন্যরা অসুস্থ। ছেলের শারীরিক জটিলতা কিছুটা কম। সে এক ঘরের মধ্যে থাকতে চায় না, সারা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমি বাসায়, কিন্তু ছেলের কাছে যাচ্ছি না। সব মিলে ছেলেটা খুব কষ্টে আছে। কবে আমরা একসঙ্গে হব—ছেলের এ প্রশ্নের উত্তর নেই, তারপরও বলি আর কটা দিন।’

রাজু আহমেদ মুখে ফেসশিল্ড ও মাস্ক লাগিয়ে করোনা পজিটিভ ছেলেকে খাওয়াচ্ছেন, এ ধরনের একটি ছবি ফেসবুকে দেওয়া আছে। এ প্রসঙ্গে রাজু আহমেদ বললেন, ‘করোনার ভয়াবহ স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ছবিটা তুলেছিলাম। ছবিটা থাক স্মৃতি হিসেবেই। করোনায় আক্রান্ত পরিবারগুলোর যে কষ্ট, তা আসলে ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না।’