'দুইবেরের বানোত হামারঘরে সগ শ্যাষ'

বন্যায় ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। নষ্ট হয়েছে জ্বালানি (ধানের খড়)। তাই জ্বালানির জন্য গাছের ডাল সংগ্রহ করে আনছেন বেলাল হোসেন। ভাষারপাড়া গ্রাম, ফুলছড়ি, গাইবান্ধা, ১৪ জুলাই। ছবি: শাহাবুল শাহীন।
বন্যায় ঘরবাড়ি ডুবে গেছে। নষ্ট হয়েছে জ্বালানি (ধানের খড়)। তাই জ্বালানির জন্য গাছের ডাল সংগ্রহ করে আনছেন বেলাল হোসেন। ভাষারপাড়া গ্রাম, ফুলছড়ি, গাইবান্ধা, ১৪ জুলাই। ছবি: শাহাবুল শাহীন।

গাইবান্ধার ভাষারপাড়া গ্রামের প্রান্তিক কৃষক বেলাল হোসেন (৫০)। গ্রামটি ফুলছড়ি উপজেলার কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের অন্তর্গত। পৈতৃকসূত্রে পাওয়া তিন বিঘা জমি ও পাঁচ শতক বসতভিটা। এ ছাড়া কোনো সহায়-সম্পদ নেই। এর মধ্যে দুই বিঘা ব্রহ্মপুত্র নদে বিলীন হয়েছে। অবশিষ্ট এক বিঘা জমিতে ভুট্টা চাষ করেন। প্রতিবছর ভুট্টা বিক্রি করে দায়-দেনা মেটান। আমন ও বোরো ধান রোপণ ও কর্তন মৌসুমে দিনমজুরের কাজ করেন। দুই মেয়ের বিয়ে হয়েছে। এক ছেলে দশম শ্রেণিতে পড়ে। কোনোমতে তিন সদস্যের সংসার চলত। কিন্তু সেই ভুট্টার জমি বন্যায় তলিয়ে গেছে। পানিতে ডুবে থেকে ঘরের বেড়া, আসবাবপত্র নষ্ট হয়েছে। প্রথম দফা বন্যায় ১১টি মুরগি তিন হাজার টাকায় বিক্রি করে সংসার চালান। সেই টাকা শেষ হলে সুদের ওপর দুই হাজার টাকা নেন। সেই টাকাও শেষ।

বেলাল হোসেন বললেন, ‘পোত্তোম বারের বানোত হামারঘরে ম্যালা খতি হচে। সেই খতি পূরণ করব্যার পাই নাই। তার উপর আবার বান আচ্চে। দুই বেরের বানোত হামারঘরে সগ কিচু শ্যাষ হয়া গেচে।’ তিনি আরও বলেন, ‘তিন দিন থাকি পানিত আচি। ঘরোত খাবার নাই। চেরমেনের কাচে গেচিনো। ইলিপ পাই নাই।’ বেলাল হোসেনের মতো কঞ্চিবাড়ি ইউনিয়নের অসংখ্য মানুষ এভাবে তাঁদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

গাইবান্ধা জেলা শহর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার দূরে ইউনিয়নটি অবস্থিত। গাইবান্ধা-বালাসি সড়ক ধরে ইউনিয়নে যাওয়া যায়। ব্রহ্মপুত্র নদ ইউনিয়নের তিনটি গ্রাম গিলে খেয়েছে। গ্রাম তিনটি হচ্ছে রসুলপুর, কাইয়ারহাট ও সাতারকান্দি। এগুলো নদের ওপারে। ইউনিয়নের অন্য চারটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। গ্রামগুলো হচ্ছে সৈয়দপুর, হাড়োডাঙ্গা, কেতকিরহাট, খলাইহারা। ইউনিয়নের ভেতর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মিত হয়েছে। বাঁধে ইউনিয়নের সহস্রাধিক বানভাসি মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। করোনায় ইউনিয়নের মানুষের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। এর ওপর দুই দফা বন্যায় তাঁরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।

মঙ্গলবার সকালে ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, বন্যাকবলিত মানুষের দুর্ভোগের চিত্র। যেসব ঘরবাড়ি থেকে পানি নেমে গিয়েছিল, সেসব ঘরবাড়িতে দ্বিতীয় দফায় পানি উঠেছে। ফলে বন্যার পানিতে ডুবে আছে ঘরবাড়ি ও রাস্তাঘাট। বাড়ির উঠানে ছোট ছেলেমেয়েরা কলার ভেলায় খেলা করছে। কেউ পানির মধ্যে মাছ ধরছেন। অনেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি মেরামত করছেন। কেউ চৌকির ওপর রান্নাবান্না করছেন।

ভাষারপাড়া গ্রামের রিকশাচালক মফিজল মিয়া (৪৫) নিজের ভাষায় বললেন, ‘হামারঘরে বাড়ির কাচে বোরমোপুত্র (ব্রহ্মপুত্র) নদী। নদীত পানি বাড়লে হামারঘরে ঘরবাড়ি ডুবি যায়। এর মদ্যে বান আসি হামরা হাবুডুবু খাবার নাগচি। আগের বানের পানিত হামারঘরে ঘরের বেড়া নষ্ট হচে। সেগলা ভালো করি নাই। তার মধ্যে আবার পানি আচ্চে। উচা জাগাত যাই নাই। তিন দিন থাকি কষ্ট করি পানির মদ্দে আচি। বানের মদ্যে কোনো ইলিপ পানো না।’
একই গ্রামের দিনমজুর আবুল কালাম (৫০) বললেন, ‘প্রথমবারের বন্যায় আমাদের তিনটি ঘর ডুবে গিয়েছিল। সেগুলো পুরোপুরি না শুকাতে আবার দ্বিতীয় দফায় ডুবে গেল’। তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের গ্রামে দুইটি বিপদ আসে। শুকনো মৌসুমে নদী ভাঙে। বর্ষার সময় বন্যা হয়। বছরের বেশির ভাগ সময় আমাদের শান্তি নাই। হাতে কাজ থাকলে আমাদের কোনো অভাব হয় না। কিন্তু বন্যার সময় হাতে কাজ নাই। তিন দিন ধরে পানিতে ভাসছি। কিন্তু ত্রাণ পাই নাই। চেয়ারম্যানের কাছে গিয়েছিলাম। তিনি ত্রাণ দেন নাই।’

পার্শ্ববর্তী সৈয়দপুর গ্রামের আছিরন বেগম (৫৫) নিজের ভাষায় বলেন, ‘হামারঘরে এ্যাকনা ঘর, তাক তিন দিন আগোত ডুবি গেচে। তকন থাকি বানদোত আচি। মানসের বাড়িত কাম করি সোংসার চলাছি। একন বানের সমায় কাউয়ো কামোত ন্যায়না। এ বাড়িত ও বাড়িত থাকি চায়া খাব্যার নাগচি। আগের বানোত চারটে হাঁস বেচি এ্যাক হাজার ট্যাকা পাচিনো। তাক দিয়া চাউল কিনচি। তাক শ্যাষ হচে। আগে যার বাড়িত কাম করচি, তার কাচে ৫০০ ট্যাকা দেনা করচি। পরে কাম করি মোদ করমো। কয়দিন চেরমেনের কাচে গেচিনো, ইলিপ পাই নাই।’

হাড়োডাঙ্গা গ্রামের কৃষক আবদুল মজিদ (৫৫) বলেন, ‘আমাদের চারটি ঘর ও একটি নলকূপ ডুবে গেছে। তাই নদীর পানি গরম করে খাচ্ছি। ফলে অনেকের পেটের সমস্যা দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া বন্যার পানিতে পায়খানা–প্রসাবখানা ডুবে গেছে। ফলে কলার ভেলায় দূরে গিয়ে প্রকৃতির কাজ সেরে নিচ্ছি।’ তিনি বলেন, ঘরে খাবার নাই। কষ্টে আছি। কিন্তু ত্রাণ পাইনি।

এ প্রসঙ্গে কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান লিটন মিয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউনিয়নটিতে লোকসংখ্যা প্রায় ২৬ হাজার। এর মধ্যে ৮ হাজার মানুষ বেশি অভাবী। নদীভাঙনের কারণে এ ইউনিয়নে অভাবী লোকের সংখ্যা বেশি। কিন্তু সে অনুপাতে ত্রাণ বরাদ্দ পাইনি। এ পর্যন্ত ২ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি। যা প্রতিজনকে ১০ কেজি করে ২০০ জনের মধ্যে বিতরণ করেছি। আরও ৭ মেট্রিক টন নতুন করে বরাদ্দ পেয়েছি। যা আজ বুধবার ৭০০ জনের মধ্যে বিতরণ করা হবে।’

এসব বিষয়ে গতকাল বিকেলে ফুলছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু রায়হান মুঠোফোনে বলেন, যেসব ইউনিয়ন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত সেগুলোতে বেশি বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। কঞ্চিপাড়া ইউনিয়নের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে।