যমুনা গিলছে জনপদ, শূন্য করে দিচ্ছে জীবন

বাড়িঘর পানিতে ডুবে যাওয়ায় পরিবারগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় ‍নিয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় সারিয়াকান্দির রৌহদহ এলাকায়। ছবি: সোয়েল রানা
বাড়িঘর পানিতে ডুবে যাওয়ায় পরিবারগুলো বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে আশ্রয় ‍নিয়েছে। মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় সারিয়াকান্দির রৌহদহ এলাকায়। ছবি: সোয়েল রানা

বগুড়ায় যমুনা নদী ভয়ংকরভাবে ফুঁসে উঠেছে। প্রবল স্রোতের তোড়ে নদী ভাঙনে বিলীন হচ্ছে বিভিন্ন চরের জনপদ। ভাঙনে বসতভিটা হারিয়ে দিশেহারা মানুষ। অনেকে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটছেন এক চর থেকে অন্য চরে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, যমুনায় পানি বৃদ্ধি গত বছরের রেকর্ড ছাড়ানোর অপেক্ষায়। গত বছরের ১৮ জুলাই যমুনায় সর্বোচ্চ বিপৎসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। নদীতে হু হু করে পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় এবার এ রেকর্ড ভাঙতে পারে দু-এক দিনের মধ্যে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের বগুড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মাহবুবর রহমান বলেন, সারিয়াকান্দির মথুরাপাড়ায় যমুনা নদীর বিপৎসীমা ধরা হয় ১৬ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার। গতকাল মঙ্গলবার সকাল ছয়টায় সেখানে পানি প্রবাহিত হয়েছে ১৭ দশমিক ৪৭ সেন্টিমিটার অর্থাৎ বিপৎসীমার ৭৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে। পানি অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পাওয়ায় আজ বুধবার সকাল ছয়টায় সেখানে ১৭ দশমিক ৮২ সেন্টিমিটার পানি রেকর্ড করা হয়েছে। অর্থাৎ যমুনায় বর্তমানে বিপৎসীমার ১১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। ২৪ ঘণ্টায় পানি বেড়েছে ৩৮ সেন্টিমিটার।

জেলা প্রশাসকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা শাখা সূত্র জানায়, বগুড়ার সারিয়াকান্দি, সোনাতলা ও ধুনট উপজেলার ১৫টি ইউনিয়নের ৯৮টি গ্রাম বর্তমানে প্লাবিত। পানিবন্দী পরিবারের সংখ্যা প্রায় ১৯ হাজার ৭২। বন্যায় দুর্ভোগে পড়েছে প্রায় ৭৮ হাজার মানুষ। খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে বসবাস করছে প্রায় ৩ হাজার পরিবার। পানিতে নিমজ্জিত রয়েছে কৃষকের প্রায় ৯ হাজার হেক্টর জমির পাট, ধান, বীজতলাসহ আবাদি ফসল।

মঙ্গলবার বিকেলে যমুনার বন্যাদুর্গত সারিয়াকান্দি ও সোনাতলার আট/দশটি চর ঘুরে দেখা গেছে, পানি বৃদ্ধির সঙ্গে প্রবল স্রোতের তীব্রতা বেড়ে যাওয়ায় ফুঁসছে যমুনা। ভাঙছে নদীর কুল। ভাঙনে বিলীন হচ্ছে সারিয়াকান্দির আউচারপাড়া, সুজনেরপাড়া, উত্তর শিমুলতাইড়, মানিকদাইড়সহ বেশ কয়েকটি চরের জনপদ। বসতি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কেন্দ্র, মসজিদ, কবরস্থান ভেঙে বিলীন হচ্ছে চর। এসব চরের পাটের ফসল পানিতে নিমজ্জিত। যমুনার ঢলে ভাসছে দলিকা, হাটবাড়ি, বিরামের পাঁচগাছি, খাটিয়ামারিসহ বিস্তীর্ণ চরের অর্ধশত লোকালয়।

সহায়সম্বল নিয়ে কলাগাছের ভেলায় করে বাঁধে যাচ্ছে বানভাসি মানুষেরা। সারিয়াকান্দির রৌহদহ এলাকায়। প্রথম আলো
সহায়সম্বল নিয়ে কলাগাছের ভেলায় করে বাঁধে যাচ্ছে বানভাসি মানুষেরা। সারিয়াকান্দির রৌহদহ এলাকায়। প্রথম আলো

প্রবল স্রোতের তাণ্ডবে নদী ভাঙনে বিলীন আউচারপাড়া চর। এই চরের প্রায় ৪০০ বসতভিটা, গাছপালা, আধাপাকা স্কুল ভবন, পাকা স্বাস্থ্য কেন্দ্র নদীগর্ভে চলে গেছে। এক মাস আগেও যেখানে হাজারো মানুষের বসবাস ছিল, সেখানে এখন বসতির কোনো চিহ্ন নেই। গৃহহারা মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন তেকানীচুকাইনগর চরে খোলা আকাশের নিচে।

নদীভাঙনে দিশেহারা ফিরোজ হোসেন খন্দকার বলেন, ‘কয়দিন আগেও এটি চারশডা ঘরের বসতি আচলো। স্কুল, ক্লিনিক, মসজিদ সবই আচলো। এখন সবই লদীর প্যাটত।’ তিনি বলেন, ‘১০ বিঘা জমির পাটের খ্যাতসহ আবাদি জমি, বাপ দাদার বসতভিটা চোখের সামনে লদীটা খায়্যা ফালাল। কিচ্চুই করবার পারনো না।’

বাঁধে আশ্রয় নিতে ভেলায় ভেসে রওনা দিয়েছেন তিন নারী। সারিয়াকান্দির ঘুঘুমারি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো
বাঁধে আশ্রয় নিতে ভেলায় ভেসে রওনা দিয়েছেন তিন নারী। সারিয়াকান্দির ঘুঘুমারি এলাকায়। ছবি: প্রথম আলো

উত্তর শিমুলতাউড় চর নদী ভাঙনে বিলীনের পথে। লোকালয়ের সঙ্গে এখানে বিলীনের পথে একটি কমিউনিটি ক্লিনিকও। চরের বাসিন্দা সোহেল শেখ বলেন, ‘এক মাস আগেও লদী আচলো দুই আড়াই কিলোমিটার দুরত। হঠাৎ শুরু হলো ভাঙনের তাণ্ডব। এক মাসেই চাড়ডা চর ভাঙ্গে পুরোডাই শ্যাষ।’

এভাবে আউচারপাড়া, কাকালীহাতা, সুজনেরপাড়া ও উত্তর শিমুলতাইড় চরের প্রায় দেড় হাজার বসতবাড়ি যমুনায় বিলীন হয়েছে বলে জানান চরের বাসিন্দারা। ফয়েজ শেখ বলেন, ‘বসতভিটাটা হারানো, সঙ্গে সাতবিঘার পাট। এখন অন্য চরে খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্চি।’

চালুয়াবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী বলেন, তাঁর ইউনিয়নের ১৩টি চরের ২০ হাজার মানুষ এখন পানিবন্দী। নদী ভাঙনে বসতবাড়ি হারিয়ে ৯০০ পরিবার গৃহহারা। তারা তিন সপ্তাহ ধরে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন।