হাওরের ঘরে ঘরে বন্যার ক্ষত

অনেক বাড়িঘরে এখনো বন্যার পানি। ছবি: প্রথম আলো
অনেক বাড়িঘরে এখনো বন্যার পানি। ছবি: প্রথম আলো

উঠানজুড়ে বন্যার পানি। ঘরের বেড়ার গায়ে হাঁটুসমান পানির দাগ এখনো স্পষ্ট। মেঝেতে থিকথিকে কাদা। কয়েকটা ইট বিছিয়ে পা ফেলার ব্যবস্থা করছিলেন শেলেনা বেগম (৪০)। মেয়েটাকে নিয়ে ১৫ দিন পর ঘরে এসেছেন। এ কয়েকটা দিন পরিবারের সবাইকে নিয়ে ছিলেন অন্যের বাড়িতে।

শেলেনা বেগমের ঘরের মেঝে ও বেড়া মাটির, ওপরে টিনের চালা। বললেন, দুই দফা বন্যার পানি ঢুকেছে তাঁর ঘরে। সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। পানি নামলেও ঘরের ভেতর কাদার কারণে হাঁটা দায়। তাই ইট বিছিয়েছেন মেঝেতে। বালু ফেলতে হবে। একটি রাজহাঁস ছিল। সেটি বিক্রি করেছেন ৭০০ টাকায়। এই টাকা দিয়ে ইট কিনেছেন। বন্যার পানির তোড়ে ঘরের বেড়া ভেঙে গেছে। ধসে গেছে রান্নাঘর। দিনমজুর স্বামী ফয়জুল হকের হাতে কাজ নেই। ঘর ঠিক করার মতো হাতে টাকাও নেই। আর ঘর না হয় হলো। কিন্তু খেয়েপরে বাঁচবেন কীভাবে, এই চিন্তায় এখন দিশেহারা তাঁরা। 

শেলেনা বেগমের বাড়ি সুনামগঞ্জের বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের সংগ্রামপুর গ্রামে। সুনামগঞ্জ-সাচনা সড়কের উত্তর দিকে কাছুখালি হাওরের পারে এই গ্রাম। গ্রামের অনেক বাড়িঘরে এখনো বন্যার পানি। 

 গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে ওই গ্রামে গিয়ে কথা হয় শেলেনার সঙ্গে। মায়ের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে মেয়ে সুরমা বেগম (১০) বলছিল, ‘ই ঘরও থাকতাম কিলা? চারদিকে পানি। বেড়া ভাঙা, ডর করে। সরকার থাকি আমরারে কিছু সাহায্য দিলে উপকার অইত।’

শেলেনার প্রতিবেশী শফিক নূর (৩৫) জানালেন, বন্যার পানি ঘরের ভেতর প্রবেশ করায় গোলায় থাকা ধান ভিজে নষ্ট হয়ে গেছে। দুবারের বন্যায় তাঁদের অবস্থা একেবারে কাহিল। কীভাবে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। শফিক নূর বলেন, ‘একবার সরকার থাকি দশ কেজি চাউল পাইছিলাম। ই চাউলদি খয় বেলা যায় খইন? আর তো সাহায্য পাইলাম না। আমরার চলার কোনো উপায় নাই। রুজি–রোজগার নাই। হাত একবারে খালি।’

তাঁদের ঘরের পেছনে আরও তিনটি ঘর। সব কটিতেই তালা ঝুলছে। ঘরগুলো যেন পানির ওপর ভাসছে। মানুষজন আশ্রয় নিয়েছেন গ্রামের মূল সড়কের পাশে থাকা আত্মীয়ের বাড়িতে। এসব ঘরে বন্যার পানি থাকায় আমির উদ্দিন, শিরিনা বেগম, আমাতি বেগমের পরিবার এখনো বাড়ি ফেরেনি। নৌকায় থাকা মাঝি মিজানুর রহমান বলছিলেন, এবার বন্যার পানি নামছে খুবই ধীরে। তাই এসব ঘর থেকে পুরোপুরি পানি সরে যেতে আরও সপ্তাহখানেক লেগে যাবে।

দক্ষিণ দিকের একটি টিনের ঘরের বারান্দায় থাকা কিছু হাঁসকে খাবার দিচ্ছিলেন মুক্তার আলী (৫২)। তাঁর ঘরেও ছিল বন্যার কোমরসমান পানি। পানি নামার পর তিনিও গতকাল এসেছেন বাড়িতে। তিন মেয়ে এখনো আছে তাদের নানার বাড়ি। ঘরের ভেতর খাটের ওপর তাঁর স্ত্রী মমিনা বেগম জিনিসপত্র গোছগাছ করছিলেন। মুক্তার আলী জানালেন, তাঁর কোনো জমিজিরাত নেই। হাঁস পালন করে সেই আয় দিয়ে সংসার চলে। বন্যার পানিতে তাঁর ২২৬টি হাঁস মরে গেছে। ক্ষতি হয়েছে বসতঘরেরও। মমিনা বেগম বলেন, ‘ঋণ করি চলরাম। সামনের দিন কিলা যাইব আল্লাই জানে। একটার পর একটা বিপদ। বিপদ ইবার আমরার পিছু ছাড়ের না।’

কৃষক আবদুস সালাম জানালেন, সংগ্রামপুর গ্রামে ৩৭০টি পরিবার আছে। মানুষজন কৃষিকাজের পাশাপাশি হাওরে মাছ ধরে, কেউ কেউ দিনমজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করেন। করোনার প্রাদুর্ভাবের পর থেকে দরিদ্র মানুষের অনেকেই বেকার। বেশির ভাগ ঘরেই বন্যার পানি ছিল। অনেকের ঘরবাড়ি ক্ষতি হয়েছে। দুই দফা বন্যার দখল কাটিয়ে ওঠা এসব মানুষের জন্য খুবই মুশকিল।

ফতেপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান রণজিৎ চৌধুরী জানলেন, তাঁর ইউনিয়নে ৪৮টি গ্রাম। পরিবারের সংখ্যা পাঁচ হাজার। এর মধ্যে তিন হাজার পরিবারই বন্যায় আক্রান্ত। এ পর্যন্ত সরকারিভাবে তাঁরা ৬০০টি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দিয়েছেন। এ ছাড়া ১২টি আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা ১৫০টি পরিবারকে দেওয়া হয়েছে শুকনো খাবার। রণজিৎ চৌধুরী বললেন, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের তুলনায় যে সহায়তা দেওয়া হয়েছে, সেটি পর্যাপ্ত নয়। আরও সহায়তা প্রয়োজন। 

সুনামগঞ্জে প্রথম দফা বন্যা দেখা দেয় গত ২৫ জুন। গোটা জেলা তখন কমবেশি বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। ওই বন্যার পানি নামতে না নামতেই ১০ জুলাই থেকে আবার জেলায় দ্বিতীয় দফা বন্যা শুরু হয়। এখনো পুরো জেলা বন্যাকবলিত। গত তিন দিন সুনামগঞ্জে ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় এবং উজান থেকে পাহাড়ি ঢল কম নামায় জেলার নদী ও হাওরে পানি কমছে। তবে পানি ধীরে নামায় মানুষজন রয়েছেন চরম ভোগান্তিতে।

সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল আহাদ প্রথম আলোকে বলেন, জেলার সব উপজেলায় তাঁদের ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত আছে। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে শুকনো খাবার দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের হাতে পর্যাপ্ত ত্রাণ আছে।