পানির অভাবে ১১ বছর ধরে বন্ধ হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ

পিরোজপুরের ইন্দুরকানির ভবানীপুর গ্রামের প্রসূতি রেকসনা বেগমের (৩৫) প্রসববেদনা শুরু হলে তাঁর স্বামী মোতালেব হোসেন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যান। সেখানে হাসপাতালের আয়া কোহিনূর বেগমের সঙ্গে স্ত্রীর প্রসব বিষয়ে কথা বলেন তিনি। এরপর কোহিনূর ও হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মী পারভীন বেগম মোতালেবের বাড়িতে গিয়ে তাঁর স্ত্রীর সন্তান প্রসব করান।

ঘটনাটি ২১ জুন রাতের। তবে রাত ১২টার দিকে রেকসনা ও তাঁর নবজাতক অসুস্থ হয়ে পড়েন। ইন্দুরকানি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অন্তর্বিভাগ চালু না থাকায় ২০ কিলোমিটার দূরে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে মা ও নবজাতককে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নবজাতকের মৃত্যু হয়। রেকসনা এরপর দুই দফা পিরোজপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। এখনো তিনি পুরোপুরি সুস্থ হননি। চিকিৎসকের পরামর্শে বাড়িতে রেখে তাঁর চিকিৎসা চলছে।

শুধু রেকসনা বেগম নন, ইন্দুরকানি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অন্তর্বিভাগ চালু না থাকায় চিকিৎসাসেবা পেতে বিড়ম্বনায় পড়ছেন এ উপজেলার লাখো মানুষ। চিকিৎসাসেবা নিতে যেতে হয় জেলা সদরের হাসপাতালে।

গত ২ জুন রাতে ইন্দুরকানি উপজেলার বালিপাড়া গ্রামের প্রসূতি সাবিনা ইয়াসমিনের (১৯) প্রসববেদনা শুরু হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। এরপর সাবিনার পরিবার জানতে পারে, হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ চালু না থাকায় রোগী ভর্তি নেওয়া হবে না। পরে একটি অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া করে সাবিনাকে নেওয়া হয় পিরোজপুর সদর হাসপাতালে। সেখানে নিতে দেরি হওয়ায় সাবিনার নবজাতককেও বাঁচানো যায়নি।
জানতে চাইলে পিরোজপুর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা নিজাম উদ্দিন জানান, ২ জুন রাত ১২টায় পিরোজপুর সদর হাসপাতালে সাবিনা মৃত সন্তান প্রসব করেন। বিলম্বিত প্রসবের কারণে শিশুটি শ্বাসকষ্টে মারা যায়।

সাবিনার ভ্যানচালক স্বামী তুহিন বয়াতি বলেন, ‘ইন্দুরকানি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকলে আমার সন্তান মারা যেত না। পিরোজপুর সদর হাসপাতালে পৌঁছাতে দেরি হয়ে যাওয়ায় আমার সন্তানকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।’

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অ্যাম্বুলেন্সচালক একরামুল গাজী বলেন, ‘হাসপাতালে অন্তর্বিভাগ চালু না থাকায় গুরুতর অসুস্থ প্রসূতি রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে করে পিরোজপুর সদর হাসপাতাল কিংবা খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। অনেক সময় প্রসূতি অ্যাম্বুলেন্সে বাচ্চা প্রসব করে থাকেন। আবার বিষপান করা রোগীর দ্রুত পাকস্থলী পরিষ্কার করার দরকার হয়। আমাদের হাসপাতালে সে ব্যবস্থা না থাকায় রোগীকে অন্য হাসপাতালে নেওয়ার পথে মারা যাওয়ার ঘটনাও ঘটে।’

হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সালে ইন্দুরকানি উপজেলায় ৩১ শয্যার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়। ২০০৮ সালের নভেম্বরে স্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর ভবনটি স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে হস্তান্তর করার পর সেখানে জনবল পদায়ন ও আসবাব সরবরাহ করা হয়। এরপর বহির্বিভাগে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও অন্তর্বিভাগে চিকিৎসা কার্যক্রম চালু হয়নি। ২০১৭ সালের অক্টোবরে হাসপাতালটি ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। শুধু সুপেয় পানি সরবরাহ নিয়ে জটিলতার কারণে ১১ বছর ধরে হাসপাতালে অন্তর্বিভাগ চালু করা হয়নি। বর্তমানে হাসপাতালে ৪ জন চিকিৎসক, ১৮ জন নার্স রয়েছেন। কাজ না থাকায় ১৩ জন নার্স পেষণে অন্য হাসপাতালে কর্মরত। হাসপাতালে ১০টি চিকিৎসক পদের মধ্যে মেডিসিন, শল্য, গাইনি, অবেদনবিদ পদের ৪টি কনিষ্ঠ পরামর্শক, ১টি চিকিৎসা কর্মকর্তা ও আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তার পদ শূন্য রয়েছে।

হাসপাতালে কর্মরত চিকিৎসকেরা জানান, করোনাকালের আগে হাসপাতালে প্রতিদিন ৮০ থেকে ৯০ জন রোগী চিকিৎসাসেবা নিত। অন্তর্বিভাগ চালু না হওয়ায় অনেক রোগী এখানে না এসে পিরোজপুর সদর হাসপাতাল ও বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে চিকিৎসাসেবা নেয়।

ইন্দুরকানি উন্নয়ন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আহাদুল ইসলাম বলেন, শুধু পানির সরবরাহ নেই, এমন কথা বলে ১১ বছর ধরে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের অন্তর্বিভাগ চালু করা হয়নি। অন্তর্বিভাগ চালু না হওয়ায় লক্ষাধিক মানুষ চিকিৎসাসেবা পেতে ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। প্রসূতি, দুর্ঘটনায় আহত, বিষ পান করে আত্মহত্যাচেষ্টার রোগীসহ জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হলে ১৬ কিলোমিটার দূরে পিরোজপুর সদর হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ভারপ্রাপ্ত আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা (আরএমও) আমিনুল ইসলাম বলেন, হাসপাতালের বহির্বিভাগ ও জরুরি বিভাগ চালু রয়েছে। সুপেয় পানির অভাবে অন্তর্বিভাগ চালু করা যাচ্ছে না।
ইন্দুরকানি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম মতিউর রহমান বলেন, ‘হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ চালুর জন্য পানির সমস্যা দূর করতে আমি স্থানীয় সাংসদসহ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করেও ফল পাচ্ছি না।’
পিরোজপুরের সিভিল সার্জন মো. হাসনাত ইউসুফ জাকী বলেন, ‘ইন্দুরকানি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে অন্তর্বিভাগ চালু করার জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে কয়েকবার চিঠি দিয়েছি। আশা করছি পানির সমস্যা দূর করা গেলে অন্তর্বিভাগ চালু করা যাবে।’