থমকে গেছে জীবনের স্পন্দন

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

করোনাকালে একটা জরুরি কাজে রাজশাহী যাওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা হওয়ার পর সেই যে বাড়িতে এসে বসেছি, তারপর তেমন কোথাও যাওয়া হয়নি। বাড়ি থেকে কঠিন নিষেধাজ্ঞা—কোথাও যাওয়া লাগবে না, চুপচাপ ঘরে বসে থাকো। আর বাইরের যে পরিস্থিতি তাতে বের হওয়ারও সুযোগ তেমন নেই। সুতরাং বাড়িতে বসে থেকে একটা একঘেয়েমি এবং মানসিক বিষাদ আমাকে চেপে ধরেছিল। তাই এই কঠিন মুহূর্তেও ঘর ছেড়ে বের হওয়া থেকে কেউ আমাকে বিরত করতে পারেনি।

খুলনা থেকে ট্রেনে যাত্রা শুরু হয় আমার। আমি খেয়াল করে দেখেছি, ট্রেনে জীবনের স্পন্দন সবচেয়ে ভালোভাবে উপলব্ধি করা যায়। ট্রেনের একটা বগি মানে হলো একটা নতুন পৃথিবী। এখানে সব রকমের মানুষের সন্নিবেশ ঘটে। পত্রিকার হকার, বই বিক্রেতা, বাদামওয়ালা, ঝালমুড়িওয়ালাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে সরগরম হয়ে থাকে একেকটা বগি। তা ছাড়া যাত্রীদের কলকাকলিতে মুখর একটা পরিবেশ থাকে। ট্রেনের একটানা ছুটে চলার অপূর্ব শব্দও মোহিত করে রাখার মতো। আমি যতবার ট্রেনে ভ্রমণ করেছি, কখনো এর ব্যতিক্রম দেখিনি।

খুলনা রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে পা দিয়েই যেন বুঝে গেলাম, সবকিছুতে বিরাট একটা পরিবর্তন এসেছে। এত দিন বাড়িতে বসে শুধু সংবাদমাধ্যমে জানতাম পরিবর্তনের কথা, কিন্তু বাইরে বের হয়ে এসে বাস্তব পরিস্থিতিটা উপলব্ধি করতে পারলাম। ট্রেনের টিকিট কাটার জন্য কাউন্টারে যাত্রীদের দীর্ঘ লাইন, হইচই এসবের কিছুই নেই। প্ল্যাটফর্মে সব সময় শুয়ে থাকা পাগলটার অস্তিত্বও চোখে পড়ল না কোথাও। প্ল্যাটফর্ম ধরে এক পাশ থেকে অন্য পাশে যাত্রীদের ছোটাছুটি নেই। এমন ফাঁকা প্ল্যাটফর্ম দেখে কেন যেন মনটা হু হু করে উঠল। এমন নিস্পন্দ, নিষ্প্রভ অবস্থা আমি কখনো দেখিনি।

ট্রেনে উঠেও দেখলাম ভেতরটা একদম ফাঁকা। অথচ বরাবরই দেখে এসেছি, ট্রেনে মানুষের গাদাগাদি, চিৎকারে কান ঝালাপালা। এবার এসবের কিছুই নেই। আগে বগিতে বগিতে হকার ও ভিক্ষুকদের যে রাজত্ব দেখতাম, তার কিছুই না দেখে সত্যিই আশাহত হয়েছি। হয়তো সেসব দেখতে দেখতে নিজেকে একটা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিয়েছিলাম। রাজশাহী পৌঁছেও একই অবস্থা। শহরে লোকজনের চলাচল খুব বেশি নেই। এমনিতে রাজশাহী ঘনবসতিপূর্ণ শহর না হলেও এতটা ফাঁকা কখনো লাগেনি। বেশ কয়েকটি বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই শহরে অবস্থিত হওয়ায় শহরটা সব সময় সরগরম থাকে। সব শিক্ষার্থী বাড়িতে চলে যাওয়ার দরুন একদম খাঁ খাঁ করছে আমার প্রাণের শহরটা।

রাতে খাবারের বন্দোবস্ত না থাকার কারণে হোটেলে খেতে যেতে হলো। সেখানে গিয়েও থমকে গেলাম। যে হোটেলে সিরিয়াল দিয়ে খাবার নিতে হতো, সেখানেও মানুষের আনাগোনা নেই। হোটেল বয় টেবিলে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। আমি গিয়ে ডাক দিতেই উঠে বসল। তারপর হাসিমুখে আমার খাবার দিতে লাগল। খাওয়া শেষে বিল দিতে গেলে ম্যানেজার জানালেন তাঁর দুঃখের কথা। চার মাস হলো হোটেলে কোনো বেচাকেনা নেই। ফলে বেতন দিতে না পারায় অধিকাংশ কর্মচারী চলে গেছেন। বড় অসহায় তাঁর মুখখানা। এভাবে চলতে থাকলে তাঁকে পথে বসতে হবে।

আগে শহরের রিকশাওয়ালারা একটা আয়েশি ভঙ্গি নিয়ে রিকশা চালাতেন। ভাবটা এমন, কেউ তাঁদের রিকশায় না উঠলেও কিছু আসে যায় না। কিন্তু এবার আমি তাঁদের চোখেমুখে বেঁচে থাকার আকুতি দেখতে পেয়েছি। জানি না কীভাবে তাঁদের সংসার চলছে। দেশের সব শ্রমজীবী মানুষই বড় কষ্টে দিন অতিবাহিত করছেন।

চার মাস পর বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট দিয়ে প্রবেশ করে আরেকবার বেদনাহত হলাম। যে ক্যাম্পাসটি মধ্যরাতেও আমাদের পদচারণে মুখর থাকত, দিনের আলোতেও প্রাণের স্পন্দন অনুভব করতে পারলাম না। কয়েকজন কর্মচারী ছাড়া আর কাউকেই চোখে পড়ল না। আহা! আবার কবে মুখর ক্যাম্পাসটাতে ফিরে আসতে পারব! একটা ভাইরাস, যাকে আমরা চোখেই দেখতে পাই না, সে কীভাবে অসীম বীরত্বের সঙ্গে তার উপস্থিতি জানান দিচ্ছে। সে আমাদের জীবনটাকে থমকে দিয়েছে। আমরা মানুষেরা, যারা প্রতিনিয়ত বড়াই করি নিজেদের বড়ত্বের, তারা কত সহজেই না অসহায় হয়ে পড়েছি!

*শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়
[email protected]