৩৩ বছরের ফাহিম সালেহ ১৫ বছরই ছিলেন উদ্যোক্তা

ফাহিম সালেহ
ফাহিম সালেহ

কলম্বিয়ার বিজনেস মিডিয়া নাইরামেট্রিকস ফাহিম সালেহ স্মরণে লিখেছে, শৈশব থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের পথ বেছে নেন ফাহিম। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বিনিয়োগ করেন তিনি। ফাহিম সালেহর লিংকডইন প্রোফাইল বলছে, ৩৩ বছরের জীবনে ১৫ বছর উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। বাংলাদেশে বড় ধরনের প্রযুক্তি উদ্যোগের উদাহরণ টানতে গেলে সবার আগে মোটরসাইকেল রাইড শেয়ার কোম্পানি পাঠাওয়ের নাম আসে। বিশ্বজুড়ে এ কোম্পানি বেশ পরিচিতিও পেয়েছে। এরই সহ-উদ্যোক্তা ফাহিম সালেহ নিউইয়র্কে বীভৎস হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

পুলিশ এখনো খুনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে জানায়নি। বৈদ্যুতিক করাত দিয়ে ছিন্নভিন্ন করেছে ফাহিমের শরীর। হত্যাকারীকে পুলিশ এখনো গ্রেপ্তার করতে না পারলেও নিউইয়র্ক পুলিশ ফাহিমের হত্যাকারীকে চিহ্নিত করতে পেরেছে। তাঁকে গ্রেপ্তার করা এখন সময়ের ব্যাপার বলে একটি সূত্র জানিয়েছে।

বড় ধরনের কোনো ব্যবসায়িক লেনদেনের জেরে ফাহিম সালেহকে হত্যা করা হয়েছে বলে আভাস দেওয়া হয়েছে। ফাহিম সালেহর খণ্ডবিখণ্ড মরদেহ যেখানে পাওয়া গেছে, নিউইয়র্কের সেই বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্ট ফাহিম সালেহর মালিকানাধীন ছিল। নিউইয়র্কের পুলিশ বলছে, স্থানীয় সময় মঙ্গলবার বিকেলে মি. সালেহর খণ্ডবিখণ্ড মরদেহ পাওয়া যায়। এ সময় তাঁর মরদেহের পাশে একটি যান্ত্রিক করাত পাওয়া যায়। পুলিশ ধারণা করছে, পেশাদার খুনি এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। ফাহিম সালেহর শরীরের বিভিন্ন অংশ অ্যাপার্টমেন্টে ছড়ানো–ছিটানো ছিল এবং কিছু অংশ একটি ব্যাগে ঢুকিয়ে রাখা হয়েছিল।

সালেহর বোনকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকা লিখেছে, নৃশংস এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রথমে জানতে পারে ফাহিম সালেহর বোন। মঙ্গলবার সারা দিন ফাহিম সালেহর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ না হওয়ায় বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে সপ্তম তলায় কথা বলতে যান। সেখানে গিয়ে তাঁর বোন ফাহিম সালেহর খণ্ডবিখণ্ড মরদেহ দেখতে পান। পুলিশকে উদ্ধৃত করে নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, অ্যাপার্টমেন্টের নিরাপত্তা ক্যামেরায় দেখা গেছে কালো স্যুট এবং কালো মাস্ক পরা একজন ব্যক্তির সঙ্গে একই লিফটে প্রবেশ করেন ফাহিম সালেহ। লিফট ফাহিম সালেহর অ্যাপার্টমেন্টের সামনে দাঁড়ালে দুজনেই সেখান থেকে বের হয়ে যান। এরপর ফাহিম সালেহ তাঁর অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করেন। তখন সেই ব্যক্তি ফাহিম সালেহকে অনুসরণ করে। পুলিশ বলছে, এরপর দুজনের মধ্যে ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়।

ফাহিম সালেহর জন্ম সৌদি আরবে। এরপর পরিবারের সঙ্গে তিনি নিউইয়র্কে চলে যান। পড়াশোনা করেছেন নিউইয়র্কে। সেখানেই বসবাস করতেন। মেধাবী ছাত্র ফাহিম নিউইয়র্কে একটি হাইস্কুলে পড়া অবস্থাতেই উইজ টিন নামক একটি ওয়েবসাইট তৈরি করে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলেন। বেশ অর্থও আয় করতে সক্ষম হন। এরপর ম্যাসাচুসেটস স্টেটের বেন্টলি ইউনিভার্সিটি থেকে বিশেষ কৃতিত্বের সঙ্গে কম্পিউটার ইনফরমেশন সিস্টেমে ব্যাচেলর শেষ করেন ফাহিম। উদ্ভাবনী মেধাসম্পন্ন ফাহিম আর পেছনে ফিরে না তাকিয়ে কিংবা কোনো কোম্পানিতে চাকরির চেষ্টা না করেই মা-বাবার জন্মস্থান বাংলাদেশে ছোটেন। ২০০৭ সালে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে মিলে ফাহিম ঢাকায় হ্যাকহাউস নামের একটি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। সেটা খুব একটা সফলতা পায়নি। ফের ফিরে যান যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৪ সালে তিনি ঢাকায় এসে প্রযুক্তিভিত্তিক কিছু ব্যবসার উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু সেগুলো ব্যর্থ হয়। এর মধ্যে পাঠাও উদ্যোগ সফল হয়েছিল। শুরুতে পণ্য পরিবহন সার্ভিস থাকলেও পরবর্তী সময়ে রাইড শেয়ারিং সেবাও চালু করে পাঠাও।

বাংলাদেশে সফল রাইড শেয়ারিং অ্যাপ পাঠাওয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা ছিলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হুসেইন এম ইলিয়াস, রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিফাত আদনান এবং যুক্তরাষ্ট্রের বেন্টলি ইউনিভার্সিটির ফাহিম সালেহ। ইলিয়াস পাঠাও যাত্রা শুরু প্রসঙ্গে বলেছিলেন, ‘২০১৫ সালে বাংলাদেশের রাজধানীতে প্রথমে অন-ডিমান্ড ডেলিভারি সেবা হিসেবে পাঠাও প্রতিষ্ঠা করি। পরে এক বিনিয়োগকারী দেখান মোটরসাইকেল–ট্যাক্সির সম্ভাবনা। একই সেবা ইন্দোনেশিয়াতে শুরু করে সাফল্যের দেখা পেয়েছিলেন ওই বিনিয়োগকারী। ফলে পাঠাও সেবাকে নতুনভাবে ওই আঙ্গিকে সাজানোর সিদ্ধান্ত নিই আমরা। বাংলাদেশিরা মোটরসাইকেল–ট্যাক্সির বিষয়টিকে ঠিক কীভাবে গ্রহণ করবে, তা নিশ্চিত ছিলাম না। শুরুতে কিছুটা সময় নিয়েছিল মানুষ। সম্পূর্ণ অপরিচিত একজনের মোটরসাইকেলের পেছনে বসতে একটু সময় লেগেছিল, কিন্তু সময়ের সঙ্গে আমরা মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছি। ১০০টি মোটরসাইকেল আর ১০০ জন চালক নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলাম। পাঠাওয়ের সফলতার পর ফাহিম সালেহ তাঁর কিছু শেয়ার বিক্রি করে দিয়ে নিউইয়র্কে ফিরে যান। এরপর তিনি পাঠাওয়ের আদলে অন্য দেশে ব্যবসার চিন্তা করেন। বাংলাদেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং পাঠাও প্রতিষ্ঠার পর থেকে ফাহিম সালেহ চেয়েছিলেন আফ্রিকা মহাদেশে ব্যবসা বিস্তার করতে। এর অংশ হিসেবে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে নাইজেরিয়ায় গোকাডা নামে একটি রাইড শেয়ারিং সার্ভিস চালু করেন। তার সঙ্গে সহপ্রতিষ্ঠাতা হিসেবে আরও একজন ছিলেন। সালেহর মালিকানাধীন গোকাডা সার্ভিস ডেলিভারিতে এক হাজার মোটরসাইকেল রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার এক বছরের মধ্যেই সংকটে পড়ে তারা। কারণ, নাইজেরিয়ার সরকার মোটরসাইকেলে রাইড শেয়ারিং নিষিদ্ধ করে।

টেককাবাল নামে নাইজেরিয়ার একটি সংবাদমাধ্যম বলেছে, সংকটে পড়ার আগে এক বছরেই গোকাডা ৫৩ লাখ ডলার আয় করে। যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ হয়ে গেলে গোকাডা পার্সেল ডেলিভারি সার্ভিস চালু করে। বর্তমানে নাইজেরিয়ার রাজধানী লেগোসে তাদের ১০০০ মোটরসাইকেল রয়েছে। ব্রিটেনের ডেইলি মেইল অনলাইনের খবরে ফাহিম সালেহকে একজন মিলিয়নিয়ার প্রযুক্তিবিষয়ক উদ্যোক্তা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। একাধিক সূত্রে জানা গেছে যে নাইজেরিয়ার গোকাডার পাশাপাশি পিকআপ নামে কলম্বিয়ার আরেকটি রাইড শেয়ারিং কোম্পানিরও তিনি অংশীদার। এর মধ্যে ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে গোকাডা বড় ধরনের বিপর্যয়ের কবলে পড়লে গত বছরের শেষ দিকে ফাহিম কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এ ছাড়া ইন্দোনেশিয়াতেও একই ধরনের ব্যবসায় তাঁর সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে জানা গেছে।

কলম্বিয়ার বিজনেস মিডিয়া নাইরামেট্রিকস তাঁর স্মরণে লিখেছে, শৈশব থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের পথ বেছে নেন ফাহিম। ২০১৭ সালে গোকাডা চালুর পর গত বছরের জুনে ৫৩ লাখ ডলার তহবিল সংগ্রহ করে প্রতিষ্ঠানটি। তিনি সেবা আরও বাড়াতে চেয়েছিলেন। এ বছরের জানুয়ারিতে আরও তহবিল পায় তাঁর প্রতিষ্ঠান। তবে সরকার এ সেবা বন্ধ করে দেয়। তাঁর লিঙ্কডইন প্রোফাইলে দেখা যায়, ৩৩ বছরের জীবনে ১৫ বছর উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করেছেন। উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বিনিয়োগ করেন তিনি।

তবে মঙ্গলবারের ঘটনা সবাইকে হতবাক করে দিয়েছে। ২২ লাখ ডলারের বিলাসবহুল বাড়িতে কড়া নিরাপত্তায় তাঁর বীভৎস্য খুনের ঘটনা সবাইকে ধাক্কা দিয়েছে। সেখানকার অধিকাংশ বাসিন্দা তাঁর সম্পর্কে ভালো ধারণা পোষণ করেন। সালেহ নিজেও কোনো সময় বিপদ সম্পর্কে কোনো সূত্র দেননি। গত জুনে তিনি টুইট করেন, ২০২০ সাল ভালো অনুভব করছি। তিনি একটি গোকাডা বাইক ক্লাব প্রতিষ্ঠার কথাও বলেছিলেন।

তাঁর বন্ধুদের মতে, সাধারণ জীবনযাত্রা ছিল ফাহিমের। তিনি প্রতিদিন সকালে দৌড়াতেন। মিটিংয়ে ব্যস্ত থাকতেন। প্রযুক্তি গ্যাজেট সংগ্রহ করতেন। এবং ছোট কুকুর লাইলাকে নিয়ে থাকতেন। তাঁর সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট সাধারণত উদ্যোক্তা, প্রযুক্তিগত-প্রবণতা বা ব্র্যান্ড সম্পর্কে ছিল।

সালেহর বন্ধু পাঠাওয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট কিশোয়ার হাশমি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে ব্যক্তিগতভাবে আমি তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি। তাঁকে প্রথম দেখেছিলাম পাঠাওয়ের লাল টি–শার্টে । চালকদের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন। টিমকে তাঁদের জীবন ও অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে সাহায্য করেছেন।’

পাঠাও এক বিবৃতিতে বলেছে, ফাহিম বাংলাদেশে এবং এর বাইরেও প্রযুক্তি বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বাস করেছিলেন।

ফাহিম সালেহর (৩৩) মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ। দেশের সফটওয়‌্যার খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) পক্ষ থেকে হত্যাকাণ্ডের নিন্দা ও শোক প্রকাশ করা হয়েছে।

পাঠাওয়ের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হুসেইন এম ইলিয়াস ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘তাঁর এ ঘটনায় আমি দুঃখ ও আঘাত পেয়েছি। তিনি আমাদের মধ‌্যে প্রতিশ্রুতি দেখেছিলেন। আমাদের সবার একই উদ্দেশ‌্য ও লক্ষ‌্য ছিল।’

ফাহিম সালেহর পরিবারের পক্ষ থেকে সাংবাদিকসহ সব মহলের প্রতি তাঁদের এ কঠিন সময়ে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার প্রতি শ্রদ্ধা রাখার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। ১৬ জুলাই পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া এক বিবৃতিতে পরিবার, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে বা ফাহিমের বন্ধুর সঙ্গেও যোগাযোগ না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়েছে। পারিবারিক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ফাহিমের হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আসা সংবাদ শিরোনাম এখনো আমাদের অনুধাবনের বাইরে। ফাহিম সম্পর্কে যা বলা হচ্ছে, তিনি তাঁর চেয়েও বেশি ছিলেন।’