ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ হোক বছরজুড়ে

আতিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান, আফসানা আলমগীর, তহমিনা জেসমিন, রাবেয়া সুলতানা, আফসানা মিমি।
আতিকুল ইসলাম, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান, আফসানা আলমগীর, তহমিনা জেসমিন, রাবেয়া সুলতানা, আফসানা মিমি।

এডিস মশা ও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি পরিচালনার বিষয়টি শুধু জুন-জুলাই মাসের বা ডেঙ্গু মৌসুমের কাজ নয়। এই কর্মসূচি বছরব্যাপী চালাতে হবে। আশার কথা, এবার সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থাগুলো বেশ আগেই ডেঙ্গু ও মশকনিধন কর্মসূচি শুরু করেছে। প্রস্তুতিমূলক কাজ আগেভাগে শুরু করায় ডেঙ্গুর প্রকোপ এ বছর এখন পর্যন্ত কম। তবে এ নিয়ে আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই।

মশকনিধন কার্যক্রম কতটা ঠিকভাবে হচ্ছে, সেই তদারকি জোরদার করা প্রয়োজন। পাশাপাশি এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ জরুরি। এ জন্য জনসচেতনতা আরও বাড়ানো প্রয়োজন। গতকাল বৃহস্পতিবার ‘ডেঙ্গু প্রতিরোধে আমরা কতটা প্রস্তুত’ শীর্ষক ভার্চ্যুয়াল গোলটেবিল বৈঠকে বিশিষ্টজনদের আলোচকেরা এসব বিষয় উঠে এসেছে। বৈঠকের আয়োজন করে প্রথম আলো এবং বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সোশ্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম (সিপ)। সহযোগিতায় ছিল ইউকেএইড এবং স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশ।

সাধারণত জুন থেকে সেপ্টেম্বর—এই সময় ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। গত বছর ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তের সংখ্যা এর আগের সব বছরের রেকর্ড ছাড়িয়েছিল। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে, ২০১৯ সালে সারা দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ১ হাজার ৩৫৪ জন। প্রথম আলোসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে প্রায় ৩০০ জনের মৃত্যু হয়। আর সরকারি হিসাবে মৃতের সংখ্যা ১৭৯।

তবে এবার পরিকল্পিত ও সমন্বিতভাবে বছরব্যাপী মশকনিধন এবং সচেতনতামূলক কাজ চলছে বলে বৈঠকে জানান ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, মশকনিধনের কীটনাশক নিয়ে আগে বড় সিন্ডিকেট সক্রিয় ছিল। সেই সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এখন বাসাবাড়িতে ব্যবহারের জন্য উন্নতমানের কীটনাশক আমদানির সুযোগ তৈরি হয়েছে। শর্ষের দানার মতো এসব কীটনাশক বাসায় ব্যবহার করলে তিন মাস পর্যন্ত মশার লার্ভা জন্মাতে পারবে না। আগামী তিন মাসের মধ্যে নগরবাসী এই কীটনাশক বাজার থেকেও কিনতে পারবে। মেয়র জানান, উত্তর সিটির ৪০টি জায়গায় এবার বিনা মূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এর আগে সূচনা বক্তব্যে প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক আব্দুল কাইয়ুম বলেন, গত বছর সারা দেশে ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ ছিল। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ডেঙ্গু প্রতিরোধে কার্যক্রম শুরু করেছে। কোভিড-১৯–এর মহামারির মধ্যে এবার যেন ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা না দেয়, সেটাই সবার প্রত্যাশা।

গত বছরের মতো এডিস মশাবহিত রোগ এবার যেন না ছড়ায় সে জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যালেরিয়া ও এডিসবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার আফসানা আলমগীর খান। তিনি বলেন, ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য ৫২ হাজার ৬০০ কিট উপজেলা পর্যায়ে ইতিমধ্যে সরবরাহ করা হয়েছে। ২০১৯ সালের চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সমাধানে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম শুধু রাষ্ট্রের বা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব বলে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই বলে মনে করেন স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশের এক্সিকিউটিভ কমিটির চেয়ার রাবেয়া সুলতানা। তিনি বলেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি যেন শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক না হয়। মুসলিম এইড ইউকে, বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টরের দায়িত্বে থাকা রাবেয়া সুলতানা জানান, গত বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর ৪৯ শতাংশই ছিল ঢাকার বাইরে।

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. মোমিনুর রহমান বলেন, ডিএনসিসির চিরুনি অভিযানে দেখা গেছে, যেসব স্থাপনায় মশার লার্ভা পাওয়া গেছে তার ৪০ শতাংশই নির্মাণাধীন ভবন। এসব ভবনসংশ্লিষ্টদের আরও সচেতনতা প্রয়োজন।

সিপের উপনির্বাহী পরিচালক তহমিনা জেসমিন বলেন, ডেঙ্গু নিয়ে সিপ গত ৩০ এপ্রিল থেকে একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেছে। তিন মাসব্যাপী এই প্রকল্পের মাধ্যমে জনসচেতনতা সৃষ্টিতে জোর দেওয়া হচ্ছে। করোনার এই সময়ে ডেঙ্গু নিয়ে যেন আতঙ্ক তৈরি না হয় সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি অধ্যাপক আকতার মাহমুদ বলেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালাতে নির্মাণাধীন ভবন ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বলা আছে। সেখানে কীভাবে ব্যবস্থাপনা করলে ডেঙ্গু মশা উৎপন্ন হবে না, সেটি যুক্ত করা প্রয়োজন। ডেঙ্গু রোগী এবং ডেঙ্গু মশার প্রজনন তথ্য সংগ্রহ ও স্থানগুলো চিহ্নিত করে রিয়াল টাইম ম্যাপিং (তাৎক্ষণিক তথ্য হালনাগাদ ও নকশা) করা সম্ভব। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে এবং ম্যাপ দেখে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হবে।

ডেঙ্গুতে গত বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয় বলে জানান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, আর্থিক ক্ষতির হিসাবে চিকিৎসা ব্যয়, মৃত্যুজনিত দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে এই হিসাবের মধ্যে বাসাবাড়িতে মশা নিয়ন্ত্রণে সিটি করপোরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানের ব্যয় যুক্ত করা হয়নি।

অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শওকত আলী (অব.) বলেন, ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় বাংলাদেশের চিকিৎসক, নার্সরা যথেষ্ট সফলতা অর্জন করেছেন।

ডিএনসিসির ৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর কাজী জহিরুল ইসলাম বলেন, এডিস মশার প্রজননস্থল চিহ্নিত করতে চিরুনি অভিযান চালিয়ে সুফল পাওয়া যাচ্ছে। এমন অভিযান আগামী আগস্ট–সেপ্টেম্বর মাসেও চলমান রাখা গেলে ভালো হয়। প্রতিটি ওয়ার্ডের নাগরিকদের সঙ্গে নিয়ে কার্যক্রম চালানো গেলে ডেঙ্গু নির্মূল সম্ভব।

চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানী আতিক আহসান বলেন, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীর অবস্থান দ্রুত চিহ্নিত করা জরুরি। রোগীর অবস্থানের আশপাশের ৪০০ বর্গগজ এলাকায় মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম চালানো গেলে সুফল পাওয়া সম্ভব।

অভিনেত্রী ও পরিচালক আফসানা মিমি বলেন, সব সমস্যা সরকারের, সব সমস্যা সিটি করপোরেশনের—জনগণের মধ্যে এমন ধারণা রয়েছে। সাধারণ নাগরিকদেরও কিছু দায়িত্ব রয়েছে। নিজের চারপাশ পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব নিজেরও। ডাবের খোসা, প্লাস্টিকের খালি বোতল, চিপসের প্যাকেটগুলো যত্রতত্র সাধারণ লোকজনই ফেলছেন। এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে লোকজনকে সচেতন হতে হবে।

ভার্চ্যুয়াল বৈঠক সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক ফিরোজ চৌধুরী। এই বৈঠকে যুক্ত হয়ে মেডিকেল শিক্ষার্থী আলভী ইয়াছার বলেন, করোনা পরিস্থিতির মধ্যেও তিনি সিপের প্রকল্পের আওতায় সিটি করপোরেশনের মশকনিধন ও সচেতনতামূলক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছেন।