ধুনটে দুর্ভোগে বানভাসি মানুষ

যমুনার পানি ঘরে প্রবেশ করায় বারান্দায় চৌকির ওপর মাটির চুলায় চলছে রান্না। বগুড়ার ধুনট উপজেলার শিমুলবাড়ি গ্রামে। ছবি: মাসুদ রানা
যমুনার পানি ঘরে প্রবেশ করায় বারান্দায় চৌকির ওপর মাটির চুলায় চলছে রান্না। বগুড়ার ধুনট উপজেলার শিমুলবাড়ি গ্রামে। ছবি: মাসুদ রানা

অনেক পরিবারের বাড়িঘরসহ আঙিনায় সাঁতারপানি। আবার কোথাও বুকসমান। গ্রামের রাস্তাটি ডুবে গেছে অনেক আগেই। গোটা গ্রামে থই থই করছে পানি। অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে কুঁড়েঘর তুলে আশ্রয় নিয়েছে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে। আবার অনেকে বাড়িঘরের মায়া ছাড়তে না পেরে এখনো অবস্থান করছে পানির মধ্যেই। এ চিত্র বগুড়ার ধুনট উপজেলায় ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের শিমুলবাড়ি গ্রামের। গ্রামটির অবস্থান যমুনা নদীর বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধের পূর্ব পাশে। গ্রামটিতে ২০০ পরিবার বসবাস করছে।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ওই গ্রামের বাসিন্দা ষাটোর্ধ্ব জরিনা বেগমের বাড়িতে সাঁতারপানি। স্বামী বাড়ি ছেড়ে হাঁস, মুরগি, ছাগল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন মেয়ের বাড়িতে। বাক্প্রতিবন্ধী নাতি রবিউলকে নিয়ে জরিনা খাতুন ১০ দিন ধরে অবস্থান করছেন ঘরের পাশে বেঁধে রাখা মাঝিদের মাছ ধরার নৌকায়। ওই নৌকায় এক বেলা রান্না করছেন। এখন পর্যন্ত মেলেনি কোনো ত্রাণ।

গ্রামের একটু ভেতরে ঢুকেই দেখা গেল, ঘরের বারান্দায় চৌকির ওপর মাটির চুলায় জ্বলছে আগুন। রান্নার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন অলেছা নামের এক বিধবা। বাড়ির আঙিনায় বুকসমান পানি। পরিবারের অন্য কোনো সদস্য তাঁর সঙ্গে নেই। আট দিন ধরে একাই থাকছেন তিনি ওই বাড়িতে। পাশেই প্রায় ৩০টি পরিবারের বাড়িতে সাঁতারপানি।

সামছুল হক (৭০) বলেন, ‘আমি নয়বার যমুনা নদীর ভাঙনের শিকার হয়েছি। এ কারণে মনের দুঃখে একবার গ্রাম ছাইড়া শহরে চইলা গেছিলাম। সেখানে ভালো লাগল না। কেন যে ভুলতে পারলাম না যমুনার মায়া। তাই জীবনের শেষ বেলায় ফিরে আইলাম শিমুলবাড়ির এই গ্রামে। যমুনা নদীর পানি বাড়ায় দুই সপ্তাহ ধইরা বাড়িঘর ছাইড়া গরু, ছাগল নিয়া আশ্রয় নিয়াছি শিমুলবাড়ি বাঁধে। শুনি, ত্রাণ দেওয়ার তালিকা করছে। তবে কখন দিব, তা জানানো হয় নাই।’

বাঁধে আশ্রয় নেওয়া কাঞ্চন বিবি, শাফলা খাতুন, আফজাল হোসেন বলেন, গত বন্যায় ১৫ দিন আগে ১০ কেজি করে চাল দেওয়া হয়েছিল। নতুন করে বন্যা হওয়ার পর তাঁদের আর কোনো ত্রাণ দেওয়া হয়নি।

যমুনা নদীর পানি বেড়ে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় বিপৎসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শুক্রবার ভোরে থেকে সেই পানি ২ সেন্টিমিটার কমে বিকেল পর্যন্ত ১২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এক সপ্তাহ ধরে আকস্মিকভাবে এই পানি বাড়ার ফলে ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের ৭টি গ্রামের প্রায় ৬০০ পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) বগুড়া কার্যালয়ের উপসহকারী প্রকৌশলী আসাদুল হক বলেন, কয়েক দিন ধরে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল ও ভারী বর্ষণে যমুনা নদীর পানি বেড়ে শহরাবাড়িঘাট এলাকায় বিপৎসীমার ১২৮ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। শুক্রবার সকাল থেকে ২ সেন্টিমিটার কমে এখন ১২৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

বাড়িতে সাঁতারপানি। যমুনার স্রোতে ভেঙে গেছে ঘরের চালা। তবুও বাড়ির মায়া ছাড়তে পারেননি জরিনা বেগম। এক সপ্তাহ ধরে ঘরের পাশেই মাঝিদের মাছ ধরার নৌকায় বাস করছেন তিনি। বগুড়ার ধুনট উপজেলার শিমুলবাড়ি গ্রামে। ছবি: মাসুদ রানা
বাড়িতে সাঁতারপানি। যমুনার স্রোতে ভেঙে গেছে ঘরের চালা। তবুও বাড়ির মায়া ছাড়তে পারেননি জরিনা বেগম। এক সপ্তাহ ধরে ঘরের পাশেই মাঝিদের মাছ ধরার নৌকায় বাস করছেন তিনি। বগুড়ার ধুনট উপজেলার শিমুলবাড়ি গ্রামে। ছবি: মাসুদ রানা

ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আতিকুল করিম বলেন, পানিবন্দী পরিবারগুলোর তালিকা করা হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে ১০ কেজি করে ৫০০ পরিবারের মধ্যে ৫ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হবে।

ধুনট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সঞ্জয় কুমার মোহন্ত বলেন, যমুনা নদীর বানভাসিদের তালিকা তৈরি করে পাঁচ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া শিশুদের মধ্যে ভিটামিনযুক্ত খাবার বিতরণ করা হবে।