অন্য রকম করোনাযুদ্ধ

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ-বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ-বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

লেখার অভ্যাস আমার একেবারেই নেই । কখনো চেষ্টাও করিনি। কিন্তু প্রথম আলোর এ কলাম পড়ে ইচ্ছা হলো নিজের অভিজ্ঞতা সবার সঙ্গে ভাগ করে নিতে।

স্বামী, শ্বশুর ও আমি—এই তিন সদস্যের পরিবার আমাদের। বিয়ের আগে চাকরি করলেও এখন পুরোপুরি গৃহিণী। বাইরে যাওয়ার খুব একটা প্রয়োজন হয় না। স্বামীকে চাকরির কারণে বাইরে যেতে হয়, শ্বশুরও নিয়মিত মসজিদে যান। ভাইবোন, তাদের ছেলেমেয়েরা একেকজন একেক জায়গায়। করোনাকালে এ কারণে সব সময় খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম। আমার ঠান্ডা লাগার ধাত আছে। শ্বশুরেরও তাই। ফলে ভয়টা আরও বেশি। এ ভয়কে সত্যি করে দিয়ে ঈদের দুই দিন পরই উনি জ্বর, সর্দি, কাশিতে আক্রান্ত হলেন। যেহেতু উনার কয়েক দিন পরপরই ঠান্ডা লাগে, তাই এটাকে সাধারণ সর্দি–জ্বর হিসেবেই উনি ধরে নিলেন।

আমার মনে সন্দেহ থেকেই গেল। ঠিক তিন দিন পর প্রচণ্ড জ্বর আর পুরো শরীরে অসহ্য ব্যথা নিয়ে সকালে ঘুম ভাঙল আমার। ওই অবস্থায় নাশতা তৈরি করে সবাইকে খাইয়ে নিজে খেয়ে নিলাম। ভয় পেয়ে গেলাম। ফোন দিলাম ১৬২৬৩ নম্বরে। উনাদের পরামর্শে ওষুধ এবং গরম পানির চিকিৎসা নিতে শুরু করলাম।

মা অসুস্থ, ভাইবোনেরা সবাই দূরে। কাউকে কিছু জানালাম না। পরদিন রাত ১১টায় নেত্রকোনা থেকে ছোট ভাই ফোন দিল, ‘আপা, কী হয়েছে?’ অসুস্থতার কথা ওকে জানিয়েছে আমার এক বন্ধু। ও বলল, করোনা টেস্ট করাতে। সেই সঙ্গে অভয় দিল। আরও এক বন্ধু বলল টেস্ট করাতে। ভয়ে ভয়ে স্বামী–স্ত্রী দুজনই নমুনা দিলাম। শ্বশুর কিছুতেই রাজি হলেন না। পরে যখন রাজি হলেন, তত দিনে উনি সুস্থ হয়ে গেছেন এবং ফল নেগেটিভ এসেছে। দুই দিন পর রাত ১০টায় আমার ফোনে একটা কল এল। আমাকে বলা হলো ‘আপনার করোনা পজিটিভ এসেছে। সবার থেকে আলাদা থাকবেন ইত্যাদি ইত্যাদি।’

করোনা পজিটিভ, এটুকু শোনার পর মাথায় আর কিছু ঢোকেনি। মনে হয়েছিল, আমার সবকিছু কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে। আমি শূন্যে ভাসছি। কোনো বোধ আমার মধ্যে কাজ করছিল না। যেন মরে যাচ্ছি, এ রকম লাগছিল। চিৎকার করে কাঁদব কি না, বুঝতে পারছিলাম না। কিছুটা ধাতস্থ হয়ে স্বামীকে বললাম। সে–ও খুব নার্ভাস হয়ে গেল। রাতে আর কাউকে জানালাম না। পরদিন ছোট ভাইকে জানালাম। সে তার পরিচিত এক ডাক্তারের সঙ্গে ফোনে কথা বলিয়ে দিল। একসময়ের সহকর্মী বন্ধুর (নার্স) স্বামী ডাক্তার, তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করলাম। পরদিন বিকেলে স্বামীর রিপোর্ট এল পজিটিভ।

অদৃশ্য এক শত্রুর সঙ্গে শুরু হলো আমাদের পারিবারিক যুদ্ধ। জ্বর, হালকা কাশি ও প্রচণ্ড মাথাব্যথা—এই ছিল লক্ষণ। যেহেতু রান্না করার মতো কেউ ছিল না, তাই নিজেদের ব্যবস্থা আমাকেই করতে হয়েছে। আমাকে অন্য রকমভাবে করোনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়েছে। রান্না, পরিবেশন থেকে ঘরের সব কাজ এবং অন্য দুজনার শুশ্রূষা—সবই করতে হয়েছে। সেই অর্থে বিশ্রাম কিংবা শুয়ে থাকার সুযোগ পাইনি। এক হাতে মাথা চেপে ধরে দু-তিন দিন পরপর মাংস রান্না করে ফ্রিজে রেখে দিতাম। ওটাই গরম করে করে চলত। টানা ১৫ দিন কী যে দুর্বিষহ জীবন ছিল! সারাক্ষণ ভয় আর উৎকণ্ঠা, না জানি কী হয়। উনারা দুজন সুস্থ হয়ে উঠলেন। আমার অন্য সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠলেও মাথাব্যথা যাচ্ছিল না কিছুতেই। ২১ দিন পর আবার টেস্ট করলাম। এবার দুজনারই রিপোর্ট নেগেটিভ এল। কিন্তু মাথাব্যথাটা আমাকে ভুগিয়েছে পুরো এক মাস।

আল্লাহর কাছে শুকরিয়া নতুন জীবন ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। সুস্থ হয়ে সবাইকে বলেছি, কিন্তু আমার অসুস্থ মাকে এখনো বলা হয়নি। বন্ধুদের মধ্যে যাঁরা দু–একজন জানতেন, তাঁরা প্রতিনিয়ত খোঁজ নিয়েছেন এবং মানসিকভাবে শক্তি–সাহস জুগিয়েছেন। সেই সব শুভাকাঙ্ক্ষীর কাছে আমি কৃতজ্ঞ।