জীবিকার চাকা থমকে গেছে

সুজন শেখ একসময় খুলনা শহরে রিকশা চালাতেন। এখন কয়েক বছর ধরে শরবতের ব্যবসায়। খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের বিভিন্ন যানের চালক-হেলপাররা মূলত তাঁর ক্রেতা। আগে প্রতিদিন হাজার দেড়েকের মতো বেচাবিক্রি হলেও এখন সেটা কোনোভাবেই ৩০০ টাকার বেশি হচ্ছে না। ছবি: প্রথম আলো
সুজন শেখ একসময় খুলনা শহরে রিকশা চালাতেন। এখন কয়েক বছর ধরে শরবতের ব্যবসায়। খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের বিভিন্ন যানের চালক-হেলপাররা মূলত তাঁর ক্রেতা। আগে প্রতিদিন হাজার দেড়েকের মতো বেচাবিক্রি হলেও এখন সেটা কোনোভাবেই ৩০০ টাকার বেশি হচ্ছে না। ছবি: প্রথম আলো
>দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় জেলা খুলনায় উপজেলা রয়েছে ৯টি। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় উপজেলা ডুমুরিয়া। ৪৫৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এই উপজেলায় ১৪টি ইউনিয়ন ও ২৩৭টি গ্রাম রয়েছে। কৃষি ও শ্রমনির্ভর অর্থনীতির এই উপজেলায় লোকসংখ্যা সাড়ে তিন লাখের ওপর। করোনাকালে এই জনপদজুড়ে খেটে খাওয়া শ্রমজীবী আর প্রান্তিক মানুষের কষ্টের গল্পগুলো ভিন্ন রকম হলেও জীবনযাপনে একটি বিষয় অভিন্ন। আর তা হলো, ভীষণ মানবেতর আর দুর্বিষহ অবস্থার মধ্য দিয়ে সময় কাটছে তাঁদের। প্রথম আলোর সঙ্গে আলাপকালে উঠে এসেছে তাঁদের কষ্টের চিত্র।

খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের বালিয়াখালী সেতু। একসময়ের প্রমত্তা হামকুড়া নদীর ওপর বেশ বড়সড় এই সেতু তৈরি হয়েছিল। নদীটি এখন হাওয়া হয়ে গেছে। নিচে ফসলের মাঠ। সেতুতে ওঠার ঠিক আগে আগে সড়কের পাশে খেজুরপাতার পাটিতে ধান শুকাতে দেওয়া। প্রায় যাত্রীহীন দু-একটা গাড়ি সড়ক দিয়ে ছুটে চলছে। পাশে দাঁড়ানো একটা শরবতের ভ্যানগাড়ি। তাতে লেখা—সুজন ভাইয়ের টেস্টি লেবুর শরবত।

ওই ভ্যান থেকে বেশ উচ্চ শব্দে ভেসে আসছে গান—‘সময় গেলে সাধন হবে না…।’ পাশে দাঁড়াতেই দোকানি কী ভেবে গান বন্ধ করে মুখে একটা স্মিত হাসি দিলেন। আলাপ-পরিচয়ে জানা গেল তাঁর নাম সুজন শেখ। একসময় খুলনা শহরে রিকশা চালাতেন। এখন কয়েক বছর ধরে এই ব্যবসায়। এই পথের বিভিন্ন যানের চালক-হেলপাররা মূলত তাঁর ক্রেতা। আগে প্রতিদিন হাজার দেড়েক টাকার মতো বেচাবিক্রি হলেও এখন সেটা কোনোভাবেই ৩০০ টাকার বেশি হচ্ছে না। সুজন শেখ বলেন, ‘সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছে। এরপর আবার কিস্তি আছে। কিস্তি ঠেকাব, না সংসার ঠেকাব। বেচতে না পারলে বাঁচব কী করে। সাহায্য–সহানুভূতি বলতে পেয়েছি এই পর্যন্ত ১০ কেজি চাল।’

এখান থেকে কিছু দূর সামনে গিয়ে টিপনা গ্রামের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কৃষিপণ্যের বাজার ‘ভিলেজ সুপার মার্কেট’। মোটামুটি জমজমাট এই বাজার এখন ফাঁকা বললেই চলে। ছবি তোলার সময় ৩০-৩২ বছরের এক যুবক এগিয়ে এলেন। জিনস প্যান্ট পরা, গায়ে রংচঙা টি-শার্ট। নাম জানালেন, মো. শাহিনুর রহমান। স্থানীয় ইউপি সদস্য একটু পর এখানে ত্রাণ দেবেন, তা নিতেই এসেছেন। করোনার হতাশার কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘এখানকার অনেকেই আমরা শহরে রিকশা চালাতাম। ভালো জামাকাপড় পরে একসঙ্গে পাঁচজন যেতাম। ভোরের বাস এসে হর্ন দিত। খুলনা গিয়ে গ্যারেজ থেকে রিকশা নিয়ে পোশাক বদলিয়ে নেমে পড়তাম। আবার সন্ধ্যায় জামাকাপড় বদলিয়ে চলে আসতাম। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ জানত না শহরে কী করি। দিনে ৫০০ থেকে ৮০০ টাকা পর্যন্ত আয় হতো। তিন মাস শহরে যেতে পারি না। আয়–রোজগার বন্ধ।’

কিছুক্ষণ পর স্থানীয় ইউপি সদস্য মহসিন হোসেন শেখ সেখানে এসে হাজির। ১০ কেজি চাল ও দেড় কেজি আলুর ৪৫টি প্যাকেটও ভ্যানে চলে এল। পকেট থেকে স্যানিটাইজারের বোতল এগিয়ে দিয়ে মহসিন হোসেন বললেন, ‘কমপক্ষে লাগবে ২০০ প্যাকেট। পেলাম ৪৫টা। এলাকার মানুষের হাতে কাজ নেই। সামনে কী হবে তা বলা কঠিন।’
ত্রাণ বিতরণের ফাঁকে আরও জানালেন, এলাকায় চুরিও বেড়েছে। মানুষ না খেয়ে কত দিন চলবে। অভাবে স্বভাব নষ্ট হচ্ছে। গত কয়েক দিনের মধ্যে এখানে বেশ কিছু গরু চুরির ঘটনা ঘটেছে। ঘেরে পয়জনিং করে, জাল দিয়ে মাছ মেরে নিয়ে যাচ্ছে।

টিপনা গ্রামের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কৃষিপণ্যের বাজার ‘ভিলেজ সুপার মার্কেট’। করোনার আগে মোটামুটি জমজমাট এই বাজার এখন ফাঁকা বললেই চলে। ছবি: প্রথম আলো
টিপনা গ্রামের আধুনিক সুযোগ-সুবিধার কৃষিপণ্যের বাজার ‘ভিলেজ সুপার মার্কেট’। করোনার আগে মোটামুটি জমজমাট এই বাজার এখন ফাঁকা বললেই চলে। ছবি: প্রথম আলো

দুশ্চিন্তায় কৃষক ও কৃষিশ্রমিক
উপজেলার কালিকাপুর দত্তপাড়া গ্রামের কৃষক কুমারেশ মণ্ডল ছয় বিঘা জমিতে সবজি চাষ করেছিলেন। খরচ হয়েছিল প্রায় ৮০ হাজার টাকা। ফলনও হয়েছিল বাম্পার। তবে করোনার কারণে ফসল বিক্রি করতে পারেননি বললেই চলে। কুমারেশ বলেন, ‘সব মিলিয়ে হাজার পঁচিশেক টাকা পেয়েছিলাম। অনেক সবজি পচে গিয়েছিল। খরিফ-২ মৌসুমে আবারও সবজি লাগিয়েছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার ৬৪ হাজার পরিবার কৃষির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ৩০ হাজার ৮৬০ হেক্টর কৃষিজমিতে ৩ মৌসুম মিলে ৭ হাজার ৯৩০ হেক্টরে সবজি উৎপাদন করেন কৃষকেরা। সব মিলিয়ে প্রায় ৬০০ কোটি টাকার সবজি উৎপাদিত হয় এই উপজেলায়।

গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে মে মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কৃষকের আর্থিক ক্ষতি কত, তার ওপর ব্র্যাকের করা এক গবেষণায় দেখা গেছে, করোনাভাইরাসের সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে মাত্র দেড় মাসেই দেশে কৃষকদের ক্ষতি হয়েছে ৫৬ হাজার ৫৩৬ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।

ডুমুরিয়া উপজেলা সদরের কৃষিসামগ্রী ব্যবসায়ী শেখ মঞ্জুর রহমান পেশাগত কারণেই এলাকার কৃষকদের হাঁড়ির খবর জানেন। মঞ্জুর জানালেন, এলাকায় কৃষকের হাত এখন বেশ খালি। তাঁর দোকানে অনেক কৃষকের প্রচুর টাকা বকেয়া পড়েছে। সপ্তাহ দুই পর থেকে যে ফসলটা উঠবে, সেটার দিকে তাকিয়ে আছেন অনেক কৃষক।

মহাসড়কের পাশে পাঁচজন কৃষিশ্রমিক নিয়ে মাঠে কাজ করছিলেন খর্ণিয়া গ্রামের কৃষক আবদুর সাত্তার মোড়ল। কেমন চলছে দিন, জানতে চাইলে সেখানে কাজ করা শ্রমিক আঙরদহ গ্রামের রামপদ দাশ বললেন, ‘আমাদের কোনো দিনই ভালো চলে না। এখন আরও খারাপ। কাজকাম কমে গেছে। সকাল ৭টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত কাজ করলে ৩০০ টাকা হয়। তা–ও সব দিন নয়।’ সুভাষ নামের একজন কৃষিশ্রমিক বলে উঠলেন, ‘মাস্ক নিয়ে আবার কিছু বইলেন না। মাটি কাটার কাজ, এমনিই দম আটকে আসে। পরের বাড়ির কাজ, বসে তো থাকতে দেবে না। আমাগে শরীরে কষ্ট, পেটে কষ্ট, মনে কষ্ট।’

ডুমুরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. মোছাদ্দেক হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খুলনা জেলা প্রশাসন বেসরকারি মানবিক সহায়তা সেলের মাধ্যমে যে খাদ্য ও শাকসবজি বিতরণ করেছিল, সেখানে ১৫ লাখ টাকার সবজি বিক্রি করতে পেরেছেন ডুমুরিয়ার কৃষকেরা। তবে সেটা মোট সবজির ১০০ ভাগের ১ ভাগও না। খরিফ-১-এ কৃষক প্রচুর সবজি উৎপাদন করেও দাম ঠিকমতো পাননি।

ডুমুরিয়া উপজেলা সদরের হাশেম আলী কৃষি আড়ত সারা বছর জমজমাট থাকে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সবজি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সবজি কেনেন। এখন সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা। ছবি: প্রথম আলো
ডুমুরিয়া উপজেলা সদরের হাশেম আলী কৃষি আড়ত সারা বছর জমজমাট থাকে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তের সবজি ব্যবসায়ীরা এখান থেকে সবজি কেনেন। এখন সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা। ছবি: প্রথম আলো

মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা আম্পান
বরাতিয়ার কৃষক অনিমেষ দে। সফল পেঁপেচাষি। পথে দেখা হতে আগে থেকে পরিচয় থাকা এই কৃষক ডেকে তাঁর খেতে নিয়ে গেলেন। সেখানে ভেঙে পড়া পেঁপেগাছ দেখালেন। বললেন, ‘প্রতিদিন কম করে হলেও পাঁচ-ছয় হাজার টাকার পেঁপে বিক্রি করতাম। তবে কপাল খারাপ, বুলবুলে ধরা খেলাম। আর আম্পানে দলা করে দিয়ে গেল। একটা গাছও মাথা উঁচু করে নেই। পেঁপেগাছের মধ্যে সাথি ফসল হিসেবে আদা, কচু, ওল কচু ছিল। সেগুলো আপাতত বিক্রি করছি। এগুলোই এখন ভরসা।’

অনিমেষের মতো খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলায় আম্পানে অনেক কৃষক ব্যাপক ক্ষতির শিকার হয়েছেন। কৃষিতে উপজেলায় ক্ষতির পরিমাণ ২০ কোটি টাকার মতো।

খুলনা অঞ্চলের চুইঝাল দেশবিখ্যাত। লতাজাতীয় এই গাছ এখন ডুমুরিয়ার বেশ কিছু জায়গায় বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হচ্ছে। জাতীয় পুরস্কার পাওয়া কৃষক নবদ্বীপ মল্লিক বছর দুই ধরে বাণিজ্যিকভাবে শুরু করেছেন চুইঝালের চারা (কলম) উৎপাদন। সেখান থেকে তাঁর ভালো আয় আসে। তবে আম্পানে সেই চুইঝালের নার্সারির চার হাজার কলম বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

নতুন করে আবার চুইয়ের নার্সারিতে হাত দিয়েছেন নবদ্বীপ। সেখানে কাজ করা নবদ্বীপের বাবা সুভাষ মল্লিক বললেন, ‘প্রতিবছর ৯০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার আম বিক্রি করি আমরা। এবার আম্পানে সব শেষ। সব মিলিয়ে গাছ থেকে ২২ কেজি আম পেয়েছি।’

সরকারি তথ্যমতে, আম্পানের সময় আম, কলা আর পেঁপের মৌসুমে দেশের বিভিন্ন এলাকার বাগানে প্রায় ৪০ লাখ টন ফল ছিল। আম্পানে অন্তত ৫ শতাংশ পুরো নষ্ট হয়ে গেছে।

খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পাশে পাঁচজন কৃষিশ্রমিক নিয়ে মাঠে কাজ করছিলেন খর্ণিয়া গ্রামের কৃষক আবদুর সাত্তার মোড়ল। এলাকায় সবজি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকা নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই কৃষক। ছবি: প্রথম আলো
খুলনা-সাতক্ষীরা মহাসড়কের পাশে পাঁচজন কৃষিশ্রমিক নিয়ে মাঠে কাজ করছিলেন খর্ণিয়া গ্রামের কৃষক আবদুর সাত্তার মোড়ল। এলাকায় সবজি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা না থাকা নিয়ে কিছুটা ক্ষোভ প্রকাশ করেন এই কৃষক। ছবি: প্রথম আলো

গবাদিপশুর খামারিরা বিপাকে
খুলনা অঞ্চলের প্রতিষ্ঠিত একমাত্র দৈনিক দুধের বাজার ডুমুরিয়া-শরাফপুর সড়কের পাশের দুধের বাজার। বাজারটি ঠিক কবে থেকে চালু হয়েছিল, তা কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। কারও মতে, ১০০ বছর, কারও মতে তারও বেশি। ডুমুরিয়া উপজেলার গুটুদিয়া, খলসি, বান্ধা, নোয়াকাঠি, সাহস, উলা, শোভনা, চিংড়া, সদর, মীর্জাপুর, বানিয়াখালী, টোলনা, বামনদিয়া, গোনালী, হাজীডাঙ্গা, মেছোঘোনা, বাহাদুরপুর এবং বটিয়াঘাটা উপজেলাসহ আশপাশের গ্রাম থেকে প্রায় দেড় শ নারী-পুরুষ প্রতিদিন এ বাজারে দুধ নিয়ে আসেন।

দুধবাজারের বেশির ভাগ ক্রেতাই খুলনা শহরের। পাইকারি ক্রেতারা মূলত এই বাজার থেকে দুধ কিনে নিয়ে খুলনা শহরের বাসাবাড়ি, চায়ের দোকান ও মিষ্টির দোকানে সরবরাহ করে থাকেন। তবে সেখানে আগের চেনা দৃশ্য আর নেই। এখনকার চিত্র বর্ণনা করছিলেন একজন বিক্রেতা মো. হাবিবুল্লাহ—‘করোনার আগে প্রতি লিটার দুধ ৪৫ থেকে ৫৫ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হতো। এখন ২৫ থেকে সর্বোচ্চ ৩৫ টাকা। আগে আসার সঙ্গে সঙ্গে দুধ ঢাইলে দৌড় মারিছি। খুলনার ব্যাপারীরা দুধ নেত। এখন বেলা গড়িয়ে গেলিও দুধ বিক্রি হতি চায় না। চাহিদা নেই। গরুর খাবারদাবার মিলিয়ে এখন ভীষণ লসে চলছে।’

দেশের গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের সবচেয়ে বেশি অর্থায়নকারী সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পল্লী কর্ম-সহায়ক ফাউন্ডেশন (পিকেএসএফ) থেকে পোলট্রি ও ডেইরি খাতে করোনাভাইরাসের প্রভাব নিয়ে একটি প্রতিবেদন কিছুদিন আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, বর্তমানে দেশে দিনে ১২০ থেকে ১৪০ লাখ লিটার তরল দুধ উৎপাদিত হচ্ছে। যার বেশির ভাগই বিক্রি হচ্ছে না। এসব তরল দুধ কম দামে বিক্রি হওয়ায় খামারিরা নিজেরা আর্থিকভাবে বিপদে পড়েছেন। তাঁরা গরুকেও ঠিকমতো খাবার কিনে দিতে পারছেন না।

এখানকার অনেক কৃষক সারা বছর একটি বা দুটি গরু পালন করে কোরবানির ঈদের সময় বিক্রি করেন। এভাবেই সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা আনেন তাঁরা। এ রকম একজন কৃষক শেখ রুহুল আমিন বলেন, ‘প্রতিবছর একটা দুইটা গরু কোরবানির সময় বিক্রির জন্য রাখি। ভালো দাম পাই। এ বছর কী হবে, বুঝতে পারছি না। খাবারের দামও তো এবার বেশি ছিল। করোনা যে কত দিক দিয়ে ক্ষতি করল!’

শত বছরের পুরোনো ডুমুরিয়ার দুধবাজারে আগের চেনা দৃশ্য আর নেই। এখন বেলা গড়িয়ে গেলেও দুধ বিক্রি হতে চায় না। চাহিদা নেই। গরুর খাবারদাবার মিলিয়ে এখন ভীষণ লোকসান চলছে খামারিদের। ছবি: প্রথম আলো
শত বছরের পুরোনো ডুমুরিয়ার দুধবাজারে আগের চেনা দৃশ্য আর নেই। এখন বেলা গড়িয়ে গেলেও দুধ বিক্রি হতে চায় না। চাহিদা নেই। গরুর খাবারদাবার মিলিয়ে এখন ভীষণ লোকসান চলছে খামারিদের। ছবি: প্রথম আলো

হস্তশিল্পের কারিগরদের দুর্দিন
ডুমুরিয়ায় বাঁশশিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্তত ৫০০ পরিবার বর্তমানে চরম দুর্দিনের মধ্যে দিনযাপন করছেন। দীর্ঘদিন ধরে এসব কারিগর বাঁশ ও বেতশিল্পের ওপর নির্ভরশীল থেকে তাঁদের জীবিকা নির্বাহ করছেন। দেশে বাঁশজাত পণ্যের চাহিদা আগের চেয়ে কমে যাওয়ায় এমনিতেই কিছুটা খারাপ অবস্থা চলছে তাঁদের। করোনা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে।

ডুমুরিয়ার গোলনা দাস পাড়ায় ৭৫ ঘর দলিত সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। তাঁরা প্রায় সবাই বাঁশের ঝুড়ি, ডালা, কুলা, খাঁচার মতো পণ্য তৈরি ও বিক্রি করে জীবন নির্বাহ করেন। একটু-আধটু ভিটে ছাড়া কারও ফসলি জমি নেই।

নিবিড় মনে বাঁশ থেকে শোলা তুলছিলেন মহাদেব দাস ও কালিদাস। বললেন, ‘খাইয়েপইরে ভালোই চলে যাইত। এখন বাইরে যাওয়া যাচ্ছে না। ঘরে মাল ভরা, বেচাকেনা নাই। বৈশাখী মেলাও এবার হয়নি। যা দু-এক টাকা জমানো ছিল, তাতে হাত পড়েছে। নিজেরা বানাতাম, আবার বাইরে থেকে একটু-আধটু কিনেও হাটে বিক্রি করতাম। বিসিক থেকে প্রায় লাখখানেক টাকা লোন নেওয়া। তিন-চার মাস দিতে পারছি না। খাব, না কিস্তি দেব?’

পাশে কাজ করা অশীতিপর রাধাকান্ত বলেন, ‘পরিবার-পরিজন নিয়ে খুব দুর্দিন যাচ্ছে। অভাব গেছে, তবে একেবারে বেচাবিক্রি বন্ধ, এ রকম কোনো দিন দেখিনি। এদিকে বাজারে চাল, সবজি সবকিছুর দাম খুব বেড়ে গেছে। কিছু বেচতে পারলে তা–ও চলা যেত।’

করোনার আগে বাঁশের কাজে ভালোই চলত মহাদেব দাস ও কালিদাসের। এখন মন্দা চলছে। যা দু-এক টাকা জমানো ছিল, তাতে হাত পড়েছে। ছবি: প্রথম আলো
করোনার আগে বাঁশের কাজে ভালোই চলত মহাদেব দাস ও কালিদাসের। এখন মন্দা চলছে। যা দু-এক টাকা জমানো ছিল, তাতে হাত পড়েছে। ছবি: প্রথম আলো

সঞ্চয় ভাঙছে মানুষ

সংসারের চাকা ঘোরাতে গিয়ে অনেকেই হাত পাতছেন স্বজন কিংবা বন্ধুর কাছে। আর যাঁদের সঞ্চয় আছে, তাঁরা ভেঙে ফেলছেন। ডুমুরিয়া অঞ্চলের প্রচুরসংখ্যক মানুষ সমবায়ভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে থাকেন। তাঁরা আবার ওই সব প্রতিষ্ঠানের সদস্য। বর্তমানে একটু ছোট সমবায়ী প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা সঞ্চয় করতে পারছেন না। বেশির ভাগই সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন।

ডুমুরিয়া উপজেলা সমবায় কার্যালয়ের তথ্যমতে, উপজেলায় হাতে গোনা কিছু এনজিও ক্ষুদ্রঋণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে এখানে সমবায়ভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণ পরিচালনা করছে ২৮৬টি প্রতিষ্ঠান।
উপজেলার রামকৃষ্ণপুর গ্রামের নান্টু মল্লিক বিদেশে থাকতেন। দেশে এসে কৃষি ও মাছ চাষে জড়িয়ে পড়েন। তবে এবার তাঁর ধান ভালো হয়নি। করোনার কারণে মাছের দাম পাননি। আমভিটা আদর্শ মৎস্য সমবায় সমিতির এই সদস্য বাধ্য হয়ে তাঁর সঞ্চয় ভেঙেছেন। বললেন, ‘চলতি-খাতি গিলি তো টাকার দরকার। উপায় না পাইয়ে সমিতির বেশ বড় একটা সঞ্চয় ভেঙে ফেলতে হলো।’

ডুমুরিয়া উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা এফ এম সেলিম আখতার বলেন, ‘করোনার একটা বাজে প্রভাব পড়েছে। আমার কাছে প্রতিদিন অনেকে ফোন করেন যে তাঁরা টাকা তুলতে চাচ্ছেন। তবে সমিতি তাঁদের দিতে পারছে না। সেগুলো সমাধান করা লাগছে। মানুষের মধ্যে সঞ্চয় ভাঙানোর প্রবণতা বাড়ছে।’

ডুমুরিয়ার সুপ্রভাত সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির পরিচালক বাবলু খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘সঞ্চয়ের ওপর সমিতির ভালোমন্দ নির্ভর করে। এখন মানুষ সঞ্চয় করতে পারছেন না। আবার বেশির ভাগই সঞ্চয় ভেঙে ফেলছেন। ঋণ আদায়ও থমকে গেছে। আমাদের সুদিনের অপেক্ষায় থাকা ছাড়া কিছু করার নেই।’