আলমারিতে ওষুধ, তবু প্রাণ যায় সাপের কামড়ে

বর্ষা, বন্যায় সাপের ‘উপদ্রব’ বেড়ে যায়। গণমাধ্যমে একের পর এক সাপে কাটা মানুষের মৃত্যুর খবর আসতে থাকে। গত ছয়–সাত সপ্তাহে সারা দেশে প্রায় ৩০ জন মানুষ মারা গেছেন সাপের কামড়ে।

খুবই ক্ষীণ দৃষ্টি, শ্রবণ ও ঘ্রাণশক্তির একটি ‘নিরীহ’ সরীসৃপ প্রাণী হঠাৎ কেন এত মৃত্যুর কারণ হয়ে ওঠে? কেন সাপের কামড়ে আহত ব্যক্তিরা যথাযথ চিকিৎসা–সুবিধা পান না? সাপ যত বিষধরই হোক না কেন, সময়মতো চিকিৎসা পেলে সাপের কামড়ে কারও মৃত্যু হওয়ার কথা নয়।

অস্ট্রেলিয়ান ভেনাম রিসার্চ ইউনিটের প্রধান মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ডেভিড উইলিয়াম এসব প্রশ্নের জুতসই জবাব দিয়েছেন। তাঁর মতে, সাপে কাটে দরিদ্র এলাকার মানুষদের, গরিবেরাই মরে বেশি; ভাগ্যক্রমে কেউ বেঁচে গেলে তার অবস্থা আরও শোচনীয় হয়ে ওঠে। তাতে নীতিনির্ধারক বা অন্যদের কী যায়–আসে! বিশিষ্ট এই বিজ্ঞানীর (ড. উইলিয়াম) কথা সমাজবিজ্ঞানী বা প্রগতিশীল রাজনীতিবিদের মতো শোনালেও কথাটা খাঁটি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ২০৩০ সালের মধ্যে সাপের কামড়ে মৃত্যু অর্ধেকে কমিয়ে আনার লক্ষ্যে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছে। এই লক্ষ্যে গঠিত কোর ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ড. উইলিয়াম। তিনি বলেছেন, ‘আমাদের একটা সমন্বিত, সাশ্রয়ী এবং টেকসই ব্যবস্থা খুঁজে বের করতে হবে। না হলে আমরা প্রজেক্টের মধ্যেই ঘুরপাক খাব আর মানুষ মরতেই থাকবে।’

বাংলাদেশে এখন মাতৃমৃত্যু অপেক্ষা সাপের কামড়ে মৃত্যুর হার বেশি। দেশে প্রতিবছর প্রায় সাত লাখ মানুষকে সাপে কামড় দেয়। এর মধ্যে প্রতিদিন ১৬-২০ জন মানুষ মারা যায়, বছর শেষে সেই হিসাব ৬-৭ হাজারে গিয়ে ঠেকে। এটা আনুমানিক হিসাব। সব শবের গণনা হয় না। জন্মনিবন্ধন হলেও সম্প্রতি ভাগাভাগির বিষয় না থাকলে মৃত্যুনিবন্ধন নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।

তবে বর্ষার সময় মৃত্যুহারটা বেড়ে যায়। বাড়ে সাপে কাটা রোগীর সংখ্যাও। এ সময় প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে সাপে কাটা রোগীকে উপযুক্ত হাসপাতালে আনার পথে মৃত্যু ঘটে। গত ৬–৭ সপ্তাহে যে ৩০ জনের মৃত্যু ঘটেছে, তাঁদের প্রায় সবাই এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে ছোটাছুটি করতে গিয়ে মারা যান।

২০১৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে মারা গিয়েছিলেন স্কুলশিক্ষক আয়েশা আক্তার (২৭)।টাঙ্গাইলের বাসাইল উপজেলার কাঞ্চনপুর দক্ষিণপাড়া গ্রামের আয়েশাকে ২০ সেপ্টেম্বর বুধবার রাত আটটায় বিষধর সাপ কামড় দেয়। ৮টা ৪৩ মিনিটে তিনি ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘টাঙ্গাইলে সাপের ভ্যাকসিন (অ্যান্টিভেনাম) কোথায় পাওয়া যায়?’ তাঁর সেই স্ট্যাটাসে অনেক আহা–উহু মার্কা ইমেজ আর উত্তর এলেও কেউ সঠিক তথ্য দিতে পারেনি। আয়েশাদের বাড়ির চারদিকে তখন বর্ষার পানি। তাই নৌকা দিয়ে তাঁকে প্রথমে প্রধান সড়কে নেওয়া হয়। তারপর গাড়িতে করে মির্জাপুর কুমুদিনী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, সেখানে সাপে কাটার অ্যান্টিভেনাম নেই। কোথায় পাওয়া যাবে অ্যান্টিভেনাম, সে তথ্য কুমুদিনী তাঁদের দিতে পারেনি।

নিরুপায় আত্মীয়স্বজন ঢাকায় রওনা দেন রাত একটায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে এসে পৌঁছালে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। তাঁর পরিবার এই অকালমৃত্যু মেনে নিতে পারেনি। সাপে কাটা মানুষ নাকি কয়েক দিন বেঁচে থাকে, এমন বিশ্বাসের ওপর ভর করে পরদিন ২১ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার দিকে আয়েশাকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেও তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

আয়েশার কাহিনি এখানেই শেষ হলে আফসোস কিছু কম হতো। স্রেফ পেশাদারত্বের তাগিদে একজন সংবাদকর্মী টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক চিকিৎসক পুতুল রায়কে ফোন করলে তিনি জানান, সাপে কাটার অ্যান্টিভেনাম টাঙ্গাইল সিভিল সার্জনের তত্ত্বাবধানে থাকে। চাহিদা দেওয়ামাত্রই আ্যন্টিভেনাম পাওয়া যায়। প্রথমে টাঙ্গাইল জেনারেল হাসপাতালে আনা হলে হয়তো সাপে কাটা রোগীকে বাঁচানো সম্ভব হতো। অর্থাৎ তরুণ শিক্ষক আয়েশা আক্তার মারা গেলেন তথ্যের অভাবে। বাড়ির কাছে সিভিল সার্জনের আলমারিতে ওষুধ থাকতে তাঁকে নিয়ে স্বজনেরা ছুটেছেন কুমুদিনী, বঙ্গবন্ধু মেডিকেল, ময়মনসিংহ মেডিকেলে—ফলাফল মৃত্যু।

বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার কাছ থেকে পাওয়া অ্যান্টিভেনাম সিভিল সার্জনের কাছ থেকে চাহিদা পাওয়ার ভিত্তিতে জেলা সদরে সরবরাহ করা হয়ে থাকে। অনেক সিভিল সার্জন নানা অজুহাতে অ্যান্টিভেনামের চাহিদা পাঠান না। সাপে কামড়ানোর পর একেকজন রোগীকে ১০টি করে অ্যান্টিভেনাম দিতে হয়। খোলাবাজারে এগুলো অনেক দামে বিক্রি হয় আর ‘স্লো আইটেম’ বিবেচনায় খুব কম ফার্মেসি এগুলোর মজুত রাখে। রাখলেও মেয়াদ–তারিখের পরোয়া করে না।

কেন এমন হয়

ওই যে ড. ডেভিড উইলিয়াম যে কথা বলেছেন, সাপের কামড়ে গরিব দেশের গরিব মানুষ বেশি মারা যান। সেটাই মূল কারণ। সাপের কামড়ে মৃত্যু রোধের ব্যবস্থাপনা অবহেলিত রোগবালাইয়ের (নেগলেকটেড ডিজিজ) তালিকায় পড়ে আছে।

প্রতিবছর ঠিক কত মানুষ মারা যাচ্ছেন সাপের কামড়ে, তার সঠিক কোনো হিসাব কোথাও পাওয়া যাবে না। জানা যাবে না তাঁদের পেশা কী ছিল, বয়স কত, কী চিকিৎসা পেয়েছিলেন, অ্যান্টিভেনাম কাজ করেছে কি করেনি, কিংবা সাপটার জাত কী ছিল। ১০ বছর আগে ২০১০ সালে একটা জরিপ করা হয়েছিল, সেটাই এখন পর্যন্ত থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড় করে চালানো হচ্ছে। এখন পর্যন্ত সাপের কামড়ের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার জন্য কোনো কর্মকৌশল তৈরি হয়নি। বাংলা না–জানা লোকদের দিয়ে ইংরেজিতে একটা খসড়া চিকিৎসা নির্দেশিকা বা গাইডলাইন তৈরি করে ইন্টারনেটে ছাড়া হয়েছে মতামতের জন্য।

এই খসড়ার ওপর ভিত্তি করে গত সপ্তাহে (৯ জুলাই ২০২০) অনলাইন প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছিল। আয়োজকদের দাবি, এই অনলাইন প্রশিক্ষণে ৩০০টির মতো স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান ও এর প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ৪২ পাতার গাইডলাইন দিয়ে ৩০০–৪০০ মানুষকে ১৫–২০ মিনিটের মধ্যে অনলাইন প্রক্রিয়ায় কীভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা যায়, তা এক রহস্য। কথিত গাইডলাইন অনুযায়ী অ্যান্টিভেনামের মজুত, বিতরণ, প্রশিক্ষণ—এসব বিষয় চুকিয়ে ফেলতে হবে এপ্রিল–মে মাসের মধ্যে। করোনার অজুহাতে এবার সেটা হয়নি। কিন্তু কখনো কোনো বছরে সেটা সময়মতো হয় কি?

সিঙ্গাপুর, চীন, জাপানের উদাহরণ টেনে লাভ নেই। আমাদের অর্থনীতিবিদেরা যে দেশকে আমাদের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা একটি দেশ মনে করেন, সেই পাপুয়া নিউগিনিতে ২০০৩ সালে প্রতি ৪ জনে ১ জন শিশু সাপের কামড়ে মারা যেত। এখন সেটা কমে প্রতি ৫০ জনে ১ জনের নিচে নেমে এসেছে। শুধু ইচ্ছা আর সৎ নিয়তের জোরেই তারা এটা করতে পেরেছে। আমাদের দেশে এ হার কমিয়ে আনার জন্য দরকার নিরাপদ ও কার্যকর অ্যান্টিভেনাম এবং প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী।

কার্যকর অ্যান্টিভেনাম কী

আমাদের হাসপাতালে যে অ্যান্টিভেনাম ব্যবহার করা হয়, তার পুরোটাই আসে ভারত থেকে। এগুলো তৈরি তামিলনাড়ুতে। সেখানকার স্থানীয় সাপের বিষ দিয়ে তারা তাদের অ্যান্টিভেনাম তৈরি করে থাকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুসারে, সাপের কামড়ের রোগীর চিকিৎসার জন্য স্থানীয় সাপ থেকে অ্যান্টিভেনাম তৈরি হলে তা সবচেয়ে কার্যকর হয়। কারণ, একেক দেশের সাপের প্রকৃতি একেক রকম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আমাদের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে বছরে যে ছয় হাজার অ্যান্টিভেনাম দিয়ে থাকে, সেটাও আনা হয় ভারত থেকে।

ভারতে যেসব সাপ থেকে ভেনাম সংগ্রহ করা হয়, সেগুলোর ২০ শতাংশ মাত্র বাংলাদেশের সাপের সঙ্গে মেলে। ভারতের নিজের রাজ্য বাংলাদেশ লাগোয়া পশ্চিমবঙ্গেই এখন তামিলনাড়ুর তৈরি অ্যান্টিভেনামের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। গত বছরের ৩ নভেম্বর রোববার পশ্চিম মেদিনীপুরের নীরদ বরণকে সাপে কামড়ালে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় পাঁশকুড়ার হাসপাতালে। চিকিৎসকেরা তাঁকে অ্যান্টিভেনাম দিয়েছিলেন, কিন্তু কোনো কাজ হয়নি, তিনি মারা গেছেন। বিশেষ করে ২০১৬ সালের পর অ্যান্টিভেনাম কাজ না করার ঘটনা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে।

তামিলনাড়ু থেকে পাইকারি বা বাল্ক ভেনাম আমদানি করে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে অ্যান্টিভেনাম ইনজেকশন বিক্রি করে দেশের একটি ওষুধ প্রতিষ্ঠান। ভারতে গোখরা, কেউটে, চন্দ্রবোড়া ও স্কেলড (একধরনের আঁশযুক্ত সাপ)—এই চার ধরনের সাপ থেকে ভেনাম (বিষ) সংগ্রহ করা হয়। এই সাপগুলোর কোনো কোনোটা বাংলাদেশে নেই। আবার কোনো কোনো প্রজাতির সাপ ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি আছে।

বিকল্পের খোঁজে বাংলাদেশ

আট কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৭ সালে দেশে প্রথমবারের মতো অ্যান্টিভেনাম তৈরির লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আর্থিক সহায়তায় পাঁচ বছর মেয়াদি অ্যান্টিভেনাম তৈরির প্রকল্পটিতে যুক্ত হয়েছেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, টক্সিকোলজি সোসাইটি অব বাংলাদেশ এবং জার্মানির গ্যেটে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষজ্ঞরা। জার্মানি থেকে জীববিজ্ঞানীরা এসে নিজেকে নিরাপদ রেখে বিষধর সাপ ধরা ও সাপগুলোকে খাইয়ে সুস্থ অবস্থায় বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রশিক্ষণ দিয়ে গেছেন। ২০১৭ সালের জুলাই মাস থেকে শুরু এই প্রকল্প শেষ হবে ২০২২ সালে। সে হিসাবে বলা যায়, অ্যান্টিভেনাম তৈরির কাজটি এখন একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে আমরা করোনাকালে বন্দী হয়ে গেছি। সবকিছুর সঙ্গে গবেষণাও বিঘ্নিত হচ্ছে, আমরা পিছিয়ে যাচ্ছি, কিন্তু সাপের কামড়ে মানুষের মৃত্যু বন্ধ নেই।

বিশেষ প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী কেন

এক গবেষণায় জানা যায়, সাপের কামড়ে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে চিকিৎসকের কাছে যায় মাত্র ৩ শতাংশ ব্যক্তি। যারা যায় বা যাদের নিয়ে যাওয়া হয়, তারা একান্ত বাধ্য হয়ে যায়। তার আগে স্থানীয়ভাবে নানা চেষ্টা তারা করে। বেশির ভাগ সময়ই স্থানীয় চেষ্টা সফল হয়, কারণ দেশের ৮২ থেকে ১০০ প্রজাতির সাপের মধ্যে মাত্র ছয় ধরনের সাপ বিষধর। বাকিগুলো কামড়ালে কিছু হয় না। কোনো চিকিৎসা ছাড়াই ওই রোগীরা সুস্থ হয়ে যান। কথিত ওঝারা সেই সুযোগটা কাজে লাগান। মানুষ মনে করে, ওঝার ঝাড়ফুঁকে সাপে কাটা রোগী ভালো হয়ে যায়। তাই বিষ–নির্বিষনির্বিশেষে সাপের কামড়ে মানুষ আগে ছোটে ওঝার কাছে। তাতে নষ্ট হয় গুরুত্বপূর্ণ সময়। রোগী ততক্ষণে শকে বা কোমায় চলে যায়। এ অবস্থায় পেশাদার চিকিৎসক বড় অসহায় হয়ে পড়েন। কারণ, রোগীর কাছ থেকে সাপের বিস্তারিত জানা সেই অবস্থায় সম্ভব হয় না। কিন্তু এটাই হচ্ছে চিকিৎসার প্রথম ধাপ।

রোগীর সঙ্গে আসা লোকদের মধ্যে অনেক সময় প্রত্যক্ষদর্শী কেউ থাকেন না। রোগী সাপের বর্ণনা দিতে না পারলে তাকে বা প্রত্যক্ষদর্শীকে সাপের ছবি দেখিয়ে কখনো কখনো সাপের ধরন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে হয়। এসব কাজের জন্য দরকার ধৈর্য ও অভিজ্ঞতা। প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নবীন স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিজ্ঞ ও ধৈর্যশীল করে তোলা সম্ভব। অনেক সময় রোগীর পরিস্থিতি দেখেও সাপের জাত নির্ণয় করা সম্ভব, যেমন গোখরা সাপ কামড় দিলে স্থানটি ফুলে যায়, স্নায়ুতন্ত্রে বিষক্রিয়া (নিউরোটক্সিন) হয়, রোগীর চোখ বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। সবুজ সাপ কামড়ালে স্থানটি ফুলে যায় ও রক্ত ঝরে। চন্দ্রবোড়া কামড়ালে এসব লক্ষণের পাশাপাশি প্রস্রাব বন্ধ হয়ে যায়। আর কেউটে কামড়ালে স্নায়ুতন্ত্রে বিষক্রিয়া ঘটে।

মাঠপর্যায়ে যেসব স্বাস্থ্যকর্মী আছেন, তাঁদেরও সাপে কাটা রোগীর প্রাথমিক ব্যাবস্থাপনা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা প্রয়োজন। এখনো সাপে কামড়ালে সাবেকি পদ্ধতিতে আক্রান্ত ব্যক্তির হাত বা পা এমন শক্ত করে বাঁধা হয় যে রক্ত চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। এতে কারও কারও গ্যাংগ্রিনও হয়ে যায়। এত শক্ত করে বাঁধার কোনো প্রয়োজন নেই। আক্রান্ত হাত বা পা যেন নড়াচড়া করা না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখলেই হবে। সে ক্ষেত্রে সতর্কতা হিসেবে হাত বা পায়ের দুই পাশে কাঠের টুকরা দিয়ে কাপড় দিয়ে আলতো করে বেঁধে যত দ্রুত সম্ভব চিকিৎসকের কাছে নিয়ে আসতে হবে। তা ছাড়া পল্লি এলাকার বাস্তবতা এবং সাপের ধরন সম্পর্কে জ্ঞান হালনাগাদ করার জন্য মাঠপর্যায়ে নিয়মিত আলোচনার কোনো বিকল্প নেই।

বাংলাদেশের উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে ঈশ্বরদী হাসপাতালের বেশ নামডাক আছে। ২০১১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত স্বাস্থ্যসেবায় বিশেষ অবদান রাখায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে পরপর ১২টি জাতীয় পুরস্কার ও পদক পায় এই হাসপাতাল। কিন্তু এখানেও সাপে কাটা রোগীদের চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা নেই।

দেশে সব বিষধর সাপের বিষের অ্যান্টিভেনাম তৈরি ও ইউনিয়ন পর্যন্ত মজুত রাখার ব্যবস্থা ডিজিটাল বাংলাদেশে অসম্ভব নয়। মনে রাখতে হবে, বর্ষা, বন্যায় সাপের উপদ্রব কেবল জলমগ্ন এলাকার সমস্যা থাকে না। সাপ মানুষের আগেই বন্যাপ্রবণ এলাকা ছেড়ে শুকনা এলাকায় চলে যায়। তাই বন্যা এলাকার চেয়ে বন্যামুক্ত এলাকায় সাপে কাটা রোগীর সংখ্যা অনেক বেশি দেখা যায়। বর্ষার সময় সারা দেশে সাপে কাটা রোগীর ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বাড়তি নজর দিতে হবে। প্রতিদিন গণমাধ্যমে প্রচার করতে হবে, কোন হাসপাতালে কত পরিমাণ অ্যান্টিভেনাম মজুত আছে। এই সাধারণ তথ্য টাঙ্গাইলের বাসাইলের স্কুলশিক্ষক আয়েশা আক্তারের প্রাণ রক্ষা করতে পারত; প্রাণ রক্ষা করতে পারে হাজার হাজার আয়েশার।

লেখক: গবেষক, [email protected]