সংস্কৃতিসেবীদের ভাতা: মৃত্যুর পর টাকা তুলছেন কে?

বছর তিনেক আগে মারা গেছেন সংগীতশিল্পী ছবি সেনগুপ্ত। তবু সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ২০১৮-১৯ ও ২০১৯-২০ অর্থবছরের ঠাকুরগাঁওয়ের অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর ভাতা বরাদ্দের তালিকায় তাঁর নাম রয়েছে। আবার ওই তালিকায় একই ব্যক্তির একাধিক নামও দেখা গেছে।

সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা যায়, সারা দেশে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় থেকে সংস্কৃতিসেবীদের ভাতা দেওয়া হচ্ছে। ২০১৯ সালের ২১ জুলাই ২০১৯-২০ অর্থবছরে আবারও অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবী ও প্রতিষ্ঠানে ভাতা-অনুদানের জন্য আবেদন আহ্বান করে মন্ত্রণালয়। ১৫ সেপ্টেম্বরের মধ্যে নিজ নিজ জেলা প্রশাসকের বরাবর আবেদন জমা দিতে বলা হয়। ওই বিজ্ঞাপনে ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে যাঁরা ভাতা পেয়ে আসছিলেন, তাঁদের আবেদন করার প্রয়োজন নেই বলে জানানো হয়। সেখানে অনুদান পাওয়ার যোগ্যতা সম্পর্কে বলা হয়েছিল, দুস্থ, অসহায়, ভূমিহীন, উপার্জনে অক্ষম, অসুস্থ, প্রতিবন্ধী সংস্কৃতিসেবীরা এই ভাতা পাওয়ার যোগ্য হবেন। ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁওয়ের জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান সেলিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় সেই আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে তা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। পরে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে গত ১০ মে ৩১ জন সংস্কৃতিসেবীর নামের বিপরীতে ৪ লাখ ৬৮ হাজার টাকা ও ৯ জুন ৬ জনের নামের বিপরীতে ৮৬ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ আসে। ওই তালিকায় ছবি সেনগুপ্তের নামও রয়েছে।

ছবি সেনগুপ্ত ঠাকুরগাঁও সরকারি বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। ২০১৭ সালের ৪ মার্চ তিনি মারা যান। মারা যাওয়ার বছর তিনেক পরও ১০ মে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. নওসাদ হোসেন স্বাক্ষরিত ভাতা বরাদ্দের চিঠিতে তাঁর নামে প্রতি মাসে ১ হাজার টাকা করে এক বছরে ১২ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। চিঠিতে তাঁর নামের ক্রমিক নম্বর ১৭।

একই তালিকার ৫ নম্বরে রয়েছেন শহরের বাহাদুরপাড়া এলাকার লোকমান হাকিম খাঁর নাম। লোকমান হাকিমের ছেলে হাবিবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তাঁর বাবা ২০১৫ সালের কোরবানির ঈদের পরপরই মারা গেছেন। তবে দিনটি নিশ্চিত করে বলতে পারেননি তিনি। মারা যাওয়ার বছর পাঁচেক পরও অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর তালিকায় তাঁর নামটি খুঁজে পাওয়া গেছে। লোকমান হাকিমের নামে প্রতি মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা করে বছরে ১৪ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

একটি সূত্র জানায়, গত বছর পর্যন্ত ছবি সেনগুপ্ত ও লোকমান হাকিমের নামে বরাদ্দ দেওয়া অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর টাকা উত্তোলন করা হয়েছে। লোকমান হাকিমের স্ত্রী মর্জিনা বেগম দাবি করে বলেন, স্বামী মারা যাওয়ার পর তাঁর নামে মাত্র একবার বরাদ্দের ১৪ হাজার ৪০০ টাকার একটি চেক হাতে পেয়েছিলেন। এরপর সেই টাকা কারা তুলেছে, বলতে পারেননি তিনি।

আর ছবি সেনগুপ্তের ছেলে তাপস সেনগুপ্ত জানান, ২০১৭ সালে মারা যাওয়ার আগে তাঁর মায়ের নামে অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর ভাতার আবেদন করা হয়েছিল। পরে তা অনুমোদন দেওয়া হয়। গত বছর পর্যন্ত মায়ের পক্ষে তিনি (তাপস সেনগুপ্ত) বরাদ্দের টাকা নিয়মিত পেয়েছেন। কিন্তু এ বছর তাঁকে ভাতার চেক দেওয়া হয়নি।

এ ছাড়া তালিকায় একই ব্যক্তির নাম একাধিকবার এসেছে, এমন অন্তত চারটি ঘটনা পাওয়া গেছে। ঠাকুরগাঁও পৌর শহরের আশ্রমপাড়া মহল্লার মনির উদ্দিন আহম্মেদের ছেলে মোজাম্মেল হকের নামে দুবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ১০ মে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মো. নওসাদ হোসেন স্বাক্ষরিত জেলার ৩১ জন অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর নামের তালিকার ১ নম্বরে তাঁর নামে প্রতি মাসে ১ হাজার ৬০০ টাকা করে এক বছরে ১৯ হাজার ২০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। পরে গত ৯ জুন যুগ্ম সচিব অসীম কুমার দে স্বাক্ষরিত জেলার ৬ জন অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর নামের বিপরীতে ৮৬ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়ার চিঠির ১ নম্বরে তাঁর নামে আবারও প্রতি মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা করে এক বছরে ১৪ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

ওই দুটি তালিকায় একই মহল্লার মুরারি ভট্টাচার্যের ছেলে প্রণব ভট্টাচার্যের নামে দুই দফা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ১০ মের বরাদ্দপত্রে তালিকার ১৬ নম্বরে তাঁর নামে প্রতি মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা করে মোট ১৪ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। আবার ৯ জুনের বরাদ্দের ২ নম্বর তালিকায় তাঁর নামে প্রতি মাসে আবারও ১ হাজার ২০০ টাকা করে মোট ১৪ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।

১০ মের বরাদ্দের তালিকার ৯ ও ২৮ নম্বরে পীরগঞ্জ উপজেলার জগথা গ্রামের রবীন্দ্রনাথ দাসের ছেলে গৌতম দাসের একই নামে দুবার ১ হাজার ২০০ টাকা করে মোট ১৪ হাজার ৪০০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। গত বছরের ২০ মে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (অনুষ্ঠান) ফয়জুর রহমান ফারুকীর স্বাক্ষরিত চিঠিতে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া সংস্কৃতিসেবীর তালিকারও ৯ ও ২৬ নম্বরে গৌতম দাস ওরফে বাবলুর নামে দুবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় জানায়, সে বছর একই চিঠিতে গৌতম দাস ওরফে বাবলুর নামে দুটি বরাদ্দ থাকলেও তাঁর নামে একটি বরাদ্দের টাকা ছাড় করা হয়।

অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবী ও প্রতিষ্ঠানে ভাতা-অনুদান প্রদান যাচাই–বাছাই কমিটির যেসব নাম মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল, তার বাইরেও অন্তত পাঁচ ব্যক্তির নাম বরাদ্দপত্রে রয়েছে। তাঁদের একজন সদর উপজেলার উত্তর ঠাকুরগাঁওয়ের মুদিদোকানি আবু তাহের। তিনি দুই বছর থেকে প্রতি মাসে ১ হাজার ২০০ টাকা হারে বছরে মোট ১৪ হাজার ৪০০ টাকা পাচ্ছেন। তালিকায় নাম কীভাবে এল? এ প্রসঙ্গে তিনি জানান, মোস্তফা কামাল নামে তাঁর এক খালাতো ভাই চাঁদপুরে থাকেন। তিনি আবু তাহেরসহ আরও চারজনের নাম ওই তালিকায় উঠিয়ে দিয়েছেন। আবু তাহের বলেন, ‘ছোটবেলা স্কুলে পড়ার সময় গানবাজনা করতাম। পরে জানতে পারি ইসলাম ধর্মে গানবাজনা হারাম। তখন থেকেই গানবাজনায় তওবা করি। সেটাও ৪০ বছর হয়ে গেছে।’ গান তওবার পরও অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর ভাতা নিচ্ছেন কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, খালাতো ভাই ভাতার ব্যবস্থা করে দেওয়ায় না করতে পারিনি।

জেলা শহরের সাংস্কৃতিক কর্মী অমল কুমার বলেন, অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবীর ভাতা বরাদ্দের নীতিমালায় সংস্কৃতিসেবীর নিজ ব্যাংক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ভাতা প্রদান করার কথা বলা হলেও ঠাকুরগাঁওয়ে বাহক চেকের (বেয়ারার চেক) মাধ্যমে ভাতার টাকা দেওয়া হচ্ছে। এতে মৃত ব্যক্তির নামে বরাদ্দের টাকাও অন্য লোকজন ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে আত্মসাৎ করার সুযোগ পেয়ে যাচ্ছেন।

অসচ্ছল সংস্কৃতিসেবী ও প্রতিষ্ঠানে ভাতা-অনুদান প্রদান যাচাই–বাছাই কমিটির সদস্যসচিব ও জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাংস্কৃতিক কর্মকর্তা সৈয়দ জাকির হোসেন বলেন, প্রতিবছর তালিকার অসংগতিগুলো চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়কে জানানো হলেও তা সংশোধন করা হচ্ছে না। এতেই এসব বিপত্তি ঘটছে।

এ বিষয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) নুর কুতুবুল আলম জানান, সংস্কৃতিসেবীর তালিকায় বেশ কিছু অসংগতি ধরা পড়েছে। যে দুজন সংস্কৃতিসেবী মারা গেছেন ও একই নামে একাধিক বরাদ্দ এসেছে, সে চেকগুলো হস্তান্তর করা হয়নি। চলতি বছর চেক হস্তান্তর করা না হলেও গত বছর পর্যন্ত ওই দুই মৃত ব্যক্তির নামের বরাদ্দ উত্তোলন হলো কেমন করে? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমরা বাইরের জেলা থেকে এখানে চাকরি করতে এসেছি। স্থানীয় অনেকের বিষয়ে আমাদের জানা নেই। আবার স্থানীয় ব্যক্তিরা আমাদের বিষয়টি জানাননি। এবার জানতে পেরে ব্যবস্থা নিয়েছি।’

জেলা প্রশাসক কে এম কামরুজ্জামান সেলিম জানান, তালিকায় যেসব ভুল রয়েছে, তা সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।