করোনায় দুর্নীতির অভিনবত্বে এগিয়ে বাংলাদেশ

চিকিৎসাসেবার নামে প্রতারণার অভিযোগে রাজধানীর উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করা হয়। সম্প্রতি তোলা।  ফাইল ছবি
চিকিৎসাসেবার নামে প্রতারণার অভিযোগে রাজধানীর উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালা করা হয়। সম্প্রতি তোলা। ফাইল ছবি

বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে। হাসপাতাল থেকে সুরক্ষাসামগ্রী চুরি হয়ে যাচ্ছে, আর তা পাওয়া যাচ্ছে খোলাবাজারে। দক্ষিণ আফ্রিকায় অর্থ ও লোকবলের অভাবে নার্সদের ক্লিনারের কাজ করতে হচ্ছে আর চিকিৎসকেরা করছেন লন্ড্রির কাজ। নিম্নমানের পরীক্ষার কিট কেনার দায়ে জিম্বাবুয়ের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর চাকরি চলে গেছে। নতুন রোগী ভর্তি করলে আয় বেশি, এ জন্য পুরোনো রোগীদের রোগমুক্তির সনদ দিয়ে বিদায় করে দেওয়ার অভিযোগে একটি হাসপাতালের বিরুদ্ধে তদন্ত করছে গ্রিস পুলিশ।

গত মার্চে লন্ডন পুলিশ কোভিড-১৯ শনাক্তের জাল কিট তৈরির অভিযোগে ফ্রাঙ্ক লুডলো নামের ৫৯ বছরের এক ব্যক্তিকে আটক করে। পাশের দেশ ভারতের অমৃতসরে ইএমসি নামের এক বেসরকারি হাসপাতাল স্বাস্থ্যবান ও সুস্থদের করোনা ‘পজিটিভ’ বানিয়ে ভর্তি করে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে।

সব মিলিয়ে কোভিড-১৯-এর সময়ে অনেক দেশই দুর্নীতি নিয়ে কমবেশি সংকটে আছে। সরকারি কিছু কর্মচারী, বেশ কিছু ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যকর্মী, বেসরকারি খাতের অনেক উদ্যোক্তা এসব দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। বেশি অভিযোগ বেশি দরে পণ্য কেনাকাটার। কিন্তু দুর্নীতির ক্ষেত্রে অভিনবত্বের পরিচয় দিয়েছে বাংলাদেশ। সুরক্ষা পণ্য কেনাকাটায় দুর্নীতি, কাজ দেওয়ায় অনিয়ম এবং অসহায় ও দুস্থদের ত্রাণ বিতরণে দুর্নীতি তো আছেই। তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে গেছে ভুয়া পরীক্ষার কেলেঙ্কারি। নতুন ধরনের এই দুর্নীতির কারণে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমেও জায়গা করে নিয়েছে বাংলাদেশ। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস-এ প্রকাশিত সংবাদের শিরোনাম হচ্ছে ‘বিগ বিজনেস ইন বাংলাদেশ: সেলিং ফেক করোনাভাইরাস সার্টিফিকেট’।

স্বাভাবিক সময়ের দুর্নীতি
এমনিতেই স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বিশ্বব্যাপী নতুন কিছু নয়। বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির প্রতিরোধ নিয়ে কাজ করা বার্লিনভিত্তিক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) বলছে, স্বাভাবিক সময়েই বছরে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতির পরিমাণ ৪৫৫ বিলিয়ন বা সাড়ে ৪৫ হাজার কোটি ডলার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) হিসাবে, বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতের বাজেট হচ্ছে সাড়ে ৭ ট্রিলিয়ন ডলার, আর এর ৭ শতাংশই নষ্ট হয় দুর্নীতিতে। এর অর্থ প্রতিবছর স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি ৫০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। ধনী দেশগুলোর সংগঠন অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট বা ওইসিডি বলছে, কেনাকাটায় স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি সর্বোচ্চ ২ ট্রিলিয়ন (১ লাখ কোটিতে ১ ট্রিলিয়ন) ডলার। আর ইউরোপীয় কমিশনের (ইসি) সমীক্ষা বলছে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলোতে স্বাস্থ্য খাতে সব মিলিয়ে দুর্নীতি হয় ২৮ শতাংশ।

তবে সময়টা অস্বাভাবিক
কিন্তু এখন সময়টা অস্বাভাবিক। কোভিড-১৯-এর এ সময়ে জীবন যাচ্ছে, জীবিকাও ধ্বংস। মহাদুর্গতির মধ্যে বিশ্বের সব দেশ। কিন্তু বড় এই দুর্গতির মধ্যেই তৈরি হয়েছে বড় সুযোগ। আর বড় সুযোগ মানেই বেশি বেশি আয়।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কী ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে, তার একটি ধারণা পাওয়া যায় অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা বিষয়ে বৈশ্বিক সংগঠন গ্লোবাল ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম নেটওয়ার্ক (জিআইজিএন) থেকে। সেখানে বলা আছে, দেশে দেশে সরকারি কর্মকর্তারা এখন কেনাকাটা করছেন জরুরি ভিত্তিতে। জনসাধারণের কাছে সেসব তথ্য উন্মুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁরা তৈরি করছেন প্রতিবন্ধকতা এবং তথ্য অধিকার আইনে করা আবেদনগুলোর জবাব দিচ্ছেন দেরিতে। অনেক সরকারই আগেকার স্বাভাবিক ধাপ বাদ দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে নানা ধরনের পণ্য ও সেবা কিনছে। দ্রুত কেনাকাটার জন্য নতুন নিয়মনীতি করছে, এতে স্বচ্ছতা বজায় থাকছে না, যা উসকে দিচ্ছে নানা দুর্নীতি।

বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, করোনাকালের দুর্নীতির বড় অংশজুড়ে আছে কেনাকাটার চুক্তি ও পণ্যের অতিমূল্যায়িত সংক্রান্ত। যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক চুক্তিই করা হয়েছে একেবারে নতুন কোম্পানির সঙ্গে। ব্রাজিলে কোনো প্রতিযোগিতা ছাড়াই মাস্ক কেনা হয়, তাও আবার ৬৭ শতাংশ বেশি দরে। ইতালিতেও সরকার বেশি দামে কিনেছে ৪০ লাখ মাস্ক, আর চুক্তিও করেছে প্রতারণায় অভিযুক্ত দুই ব্যবসায়ীর সঙ্গে। রাশিয়াও ভেন্টিলেটর কেনার চুক্তি করেছে একদমই অপরিচিত ও সন্দেহজনক কিছু কোম্পানির সঙ্গে। বসনিয়া ভেন্টিলেটর কেনার চুক্তি করেছে একটি কৃষি খামারের সঙ্গে। স্লোভেনিয়ায় সুরক্ষাসামগ্রী কেনার জন্য চুক্তি করা হয়েছে এক ক্ষমতাবান ব্যবসায়ীর সঙ্গে, যার জুয়া, ইলেকট্রনিকস ও রিয়েল এস্টেট ব্যবসা আছে, কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।

বাংলাদেশ কী হয়েছে
বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের একটি। টিআইএর তালিকায় ১৯৮টি দেশের মধ্যে ১৪৬তম। সুতরাং রোগের মহামারির এই সময়ে বাংলাদেশে যে দুর্নীতি ঘটবে না, তা নিশ্চয়ই কেউ আশা করেননি। তবে মহাদুর্গতির এ সময়ে তা নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা থাকবে, সে আকাঙ্ক্ষা অনেকের ছিল।

বাংলাদেশে কোভিড-১৯ প্রথম শনাক্ত হয় গত ৮ মার্চ। মার্চ থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিভাগ ও জেলার স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্স শুরু করেন। দুস্থদের জন্য ত্রাণ ও নগদ সহায়তা কর্মসূচির ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তা বিতরণে কোনো দুর্নীতি হলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বারবার বলেছেন। সর্বশেষ ৯ জুলাই বাজেট অধিবেশনের সমাপনী ভাষণেও দল-মতনির্বিশেষে দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপ অব্যাহত রাখার কথা বলেন তিনি।

ঘোষণা অনুযায়ী, নগদ সহায়তা হিসেবে সারা দেশের ৫০ লাখ দরিদ্র পরিবারের একজন করে সদস্যের মুঠোফোন-ব্যাংক নম্বরে আড়াই হাজার টাকা দেওয়া শুরু করে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দেওয়া শুরু করে চাল, টাকা ও শিশুখাদ্য।

নগদ আড়াই হাজার টাকা দেওয়ার কর্মসূচি সফল করতে পারেনি সরকার। এখন পর্যন্ত নগদ অর্থ পেয়েছে মাত্র ১৬ লাখ ১৬ হাজার ৩৫৬ জন। অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই এই হাল। অনেক অবস্থাপন্নদের নাম এই তালিকায় ঢোকানো হয়েছে। নগদ সহায়তা এবং ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম-দুর্নীতির জন্য এখন পর্যন্ত বিভিন্ন পর্যায়ের ১০২ জন জনপ্রতিনিধিকে বরখাস্ত করা হয়েছে। বরখাস্ত হওয়াদের বেশির ভাগই কোনো না কোনোভাবে সরকারি দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।

করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সুরক্ষাসামগ্রী কেনা ও সরবরাহ নিয়েও ঘটেছে দুর্নীতি। নিম্নমানের সুরক্ষা পোশাক (পিপিই) ও মাস্ক কিনে তা সরবরাহ করা হয়েছে। এসব কেনাও হয়েছে অস্বাভাবিক বেশি দামে। করোনার শুরুতেই অর্থ মন্ত্রণালয় জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে ৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়। পরে সংকট মোকাবিলায় জরুরি স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কিনতে বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের অর্থায়নে দুটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করে সরকার। বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নের প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ১১৭ কোটি টাকা এবং এডিবির প্রকল্পের ব্যয় ১ হাজার ৩৬৫ কোটি টাকা। এই দুই প্রকল্পের কেনাকাটা নিয়েই উঠেছে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ। স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাকাটার বাইরে সফটওয়্যার কেনা, ওয়েবসাইট উন্নয়ন, অডিও-ভিডিও ফিল্ম নির্মাণ, সেমিনার সম্মেলন করা, ভ্রমণ ব্যয় এবং পরামর্শক খাতে বিপুল অর্থ ব্যয়ের পরিকল্পনা নিয়েও উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ।

তবে বাংলাদেশে করোনাকালের দুর্নীতির সব উদাহরণকে ছাপিয়ে গেছে জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের জালিয়াতির ঘটনা। করোনার নমুনা সংগ্রহ করে ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগে এই দুই প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারদের আটক করেছে সরকার। করোনার নমুনা সংগ্রহ করে তা ফেলে দিয়ে, ভুয়া ফলাফল দেওয়ার ঘটনা সারা বিশ্বে এখন পর্যন্ত বিরল।

বাংলাদেশে শুরু থেকেই টেস্ট করা হয়েছে খুবই কম। সমালোচনার মুখে টেস্টের সংখ্যা বাড়লেও ফল পেতে দীর্ঘ সময় এখনো অপেক্ষা করতে হয়। টেস্টের জন্য ধরতে হয় দীর্ঘ লাইন। এখন তো টেস্টের জন্য অর্থ নেওয়া শুরু করেছে সরকার। ফলে শুরু থেকেই করোনা টেস্ট নিয়ে যে আস্থার অভাব ছিল, তা আরও বেড়েছে। এর মধ্যেই আবার জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতালের ভুয়া টেস্টের তথ্য। রাজনৈতিক ও প্রশাসনিকভাবে ক্ষমতাবানদের একাংশের যোগসাজশের বিষয়টি এর মাধ্যমে আরও একবার প্রমাণিত হয়েছে। আবার এই দুই প্রতিষ্ঠানকে অনুমোদন দেওয়া ও চুক্তি স্বাক্ষর নিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরস্পরের দোষ দিচ্ছে। সুশাসন ও জবাবদিহির ব্যবস্থা নেই বলেই এমনটা ঘটছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। এ ছাড়া, চুক্তি সই করার আগে পড়ে দেখেন না বলে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর বক্তব্যও ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।

দুর্নীতি রোধের নীতিমালা
কোভিড-১৯-এর প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পরপরই কিন্তু বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা দুর্নীতি নিয়ে সতর্ক ও সচেতন হতে শুরু করেছিল। এ নিয়ে নীতিমালাও তৈরি করে অনেকে। ইউরোপের ৫০টি দেশের সংগঠন দ্য কাউন্সিল অব ইউরোপস গ্রুপ অব স্টেটস অ্যাগেইনস্ট করাপশনের (গ্রেকো) নীতিমালাটি গত ১৫ এপ্রিল প্রকাশ করা হয়। নীতিমালায় গ্রেকো বলেছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অগ্রাহ্য করা যাবে না এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। এ সময় ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হচ্ছে, মৌলিক অধিকার ও কথা বলার স্বাধীনতা হরণ করা হচ্ছে, মহামারির সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে বিপুল অর্থ ব্যয় হচ্ছে। এ অবস্থায় দুর্নীতির ঝুঁকি মোটেই ছোট করে দেখলে চলবে না। সুতরাং মহামারি সম্পর্কিত যেকোনো ব্যয়ের ক্ষেত্রে দুর্নীতি প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা অত্যন্ত জরুরি।

ওইসিডির নীতিমালা জারি করা হয় গত ২৬ মে। ‘পলিসি মেজার্স টু এভয়েড করাপশন অ্যান্ড ব্রাইবারি ইন দ্য কোভিড-১৯ রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি’ নামের নীতিমালায় ওইসিডি বলছে, করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী মানুষের দুর্ভোগ, অনিশ্চয়তা এবং বড় অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের এক অভূতপূর্ব চ্যালেঞ্জ নিয়ে এসেছে। এতে এমন পরিবেশ তৈরি হচ্ছে, যা দুর্নীতি ও ঘুষের জন্য উপযুক্ত। এ সময় ঘুষ-দুর্নীতি বেড়ে গেলে সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং সরকারের কাজের ওপর সাধারণ নাগরিকদের আস্থাহীনতা প্রকট হবে। এই আস্থা ধরে রাখতে এখনই দুর্নীতি প্রতিরোধের ব্যবস্থা করা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বিশ্বব্যাংকের নীতিমালাটি প্রকাশ করা হয় গত ২৮ এপ্রিল। নীতিমালায় সম্ভাব্য দুর্নীতির সব কটি পথের কথাই বলা আছে। যেমন কোভিড-১৯ মোকাবিলায় প্রতিটি সরকারই জরুরি ভিত্তিতে স্বাস্থ্যসেবা দিচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অতিমূল্যায়িত দরে জরুরি পণ্য কেনা, রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের অনুকূলে কাজের আদেশ দেওয়া, কাজ না করেই অর্থ পরিশোধের ঘটনা ঘটতে পারে। আবার জরুরি পণ্য সরবরাহের ক্ষেত্রেও রয়েছে দুর্নীতির আশঙ্কা। যেমন উপকারভোগীর হাতে যাওয়ার আগেই তা আত্মসাৎ হতে পারে, সেসব পণ্য চলে যেতে পারে অবস্থাপন্ন ও রাজনৈতিক সংশ্লিষ্ট ও সমর্থকদের কাছে। দেওয়া হতে পারে নিম্নমানের ও জাল পণ্য। সংক্রমণ তীব্র হলে চিকিৎসাসেবা পেতে আক্রান্তদের বাড়তি খরচ বা ঘুষ দিতে হতে পারে। এ ছাড়া, লোকবলের সংকটে জরুরি ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রেও দুর্নীতির সুযোগ রয়েছে। স্বজনপ্রীতির ও পৃষ্ঠপোষকতার কারণে নেওয়া হতে পারে অদক্ষ জনবল।

বিভিন্ন সংস্থার নীতিমালাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে, তারা যত ধরনের দুর্নীতির আশঙ্কা করেছিল, তার সব কটিই বাংলাদেশে ঘটছে। কিছু ক্ষেত্রে তাদের ধারণাকেও ছাড়িয়ে গেছে। যেমন জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারির ঘটনা।

কথা বলতে না দেওয়া
মারাত্মক করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ে প্রথম সতর্ক করে দেওয়া চীনের চিকিৎসক লি ওয়েনলিয়াংয়ের ঘটনাই প্রমাণ করে, তথ্য গোপন রাখাটা কতটা বিপজ্জনক। বরং সংকট মোকাবিলায় অবাধ তথ্যপ্রবাহই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অথচ বিভিন্ন দেশ তথ্য গোপন রাখা এবং বিরোধীদের দমনে করোনাকালের প্রেক্ষাপটকে বেছে নিয়েছে। এই মূল্যায়ন আন্তর্জাতিক সংগঠন কাউন্সিল অব ইউরোপ ও বার্লিনভিত্তিক সংগঠন টিআইয়ের। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও ‘ইনফোডেমিক’ বা তথ্যের অতিমহামারির এই সময়ে সঠিক তথ্য প্রচারকে সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে।

এ রকম এক সময়ে তথ্য লুকানো এবং স্বাধীন মতপ্রকাশ দমনের অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সংবাদ সম্মেলন রাতারাতি বুলেটিন হয়ে যাওয়ার কারণে সঠিক তথ্য পেতে গণমাধ্যমের এখনো সমস্যা হচ্ছে। সরকারের ত্রাণ বিতরণের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলায় সমালোচিত সাইবার আইনে মামলা ও গ্রেপ্তারের অভিযোগও রয়েছে।

কী করতে হবে
জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) গত ৯ জুন করোনার সময়ে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিয়ে চার বিশেষজ্ঞের একটি যৌথ লেখা প্রকাশ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্যব্যবস্থা বিভাগের টিম লিডার ডেভিড ক্লার্ক; এইডস, যক্ষ্মা ও ম্যালেরিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধসংক্রান্ত গ্লোবাল ফান্ডের দুর্নীতি দমন বিশেষজ্ঞ অনিতা ওয়েয়ারজিনস্কা; ইউএনডিপির এইচআইভি, স্বাস্থ্য ও উন্নয়ন টিমের নীতি বিশেষজ্ঞ মার্ক ডিবিয়াম এবং ইউএনডিপির দুর্নীতি দমন সম্পর্কিত গ্লোবাল কর্মসূচির উপদেষ্টা আঙ্গা টিমিলসিনা লেখাটি তৈরি করেছেন।

এই চার বিশেষজ্ঞ বলেছেন, কোভিড-১৯-এর মহামারির সময়ে একটি কার্যকর জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলার বিষয়টি অবশ্যই বিবেচনায় নিতে হবে। এর ফলে দুর্নীতির যে বাড়তি সুযোগ তৈরি হয়েছে, তা প্রতিরোধে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে একটি কাঠামো গড়ে তোলাটাও জরুরি হয়ে পড়েছে। এই কাঠামোর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত থাকতে হবে সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির বিষয়টি। এ জন্য সরকার, নাগরিক সমাজ, বিশেষজ্ঞ এবং দুর্নীতি দমন ও নিরীক্ষা সংস্থাগুলোকে সঙ্গে নিয়ে একটি তদারকি ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন।

চার বিশেষজ্ঞ জাল মেডিকেল পণ্য, সরবরাহের ঘাটতি এবং কেনাকাটা ও বিতরণের অনিয়মের প্রতিবেদন তৈরির জন্য ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারকে উৎসাহিত করার পরামর্শ দিয়েছেন। এটিকে তাঁরা বলেছেন, ‘স্মার্ট দুর্নীতি দমন পদ্ধতি’, যা কিছু দেশ ব্যবহার করে লাভবান হয়েছে। যেমন ইউক্রেন কেনা প্রতিটি পণ্যের নাম, দাম, কেনাকাটার শর্ত এবং সরবরাহকারীর তালিকা অনলাইনে প্রকাশ করছে। একই কাজ করছে কলম্বিয়ার জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট। আরও কয়েকটি দেশও এই একই ধরনের ব্যবস্থা নিয়ে সফল হয়েছে।

সামনে আরও আশঙ্কা
বিশ্বব্যাংকের নীতিমালায় বলা আছে, করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে অনেক বেসরকারি খাতের জন্য বিভিন্ন দেশ প্রণোদনা তহবিল গঠন করছে। কিন্তু স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির ব্যবস্থা না থাকলে, প্রতিষ্ঠান দুর্বল হলে এই অর্থের অপব্যবহার হবে, যাদের প্রয়োজন তারা পাবে না, রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা নিয়ে যাবে।

বাংলাদেশ সরকার প্রায় ১ লাখ কোটি টাকার প্রণোদনা তহবিলের ঘোষণা দিয়েছে। দুই মাসের বেশি সময় আগে এই তহবিলের ঘোষণা দিলেও বাস্তবায়নের গতি অত্যন্ত শ্লথ। এই অর্থের বড় অংশ প্রভাবশালী ও ঋণখেলাপিদের নিয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা এরই মধ্যে বলা শুরু হয়েছে।

বাজেট সহায়তা হিসেবেও বড় অঙ্কের ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে বিভিন্ন দাতার কাছ থেকে ৩১০ কোটি ডলার বা প্রায় সাড়ে ২৬ হাজার কোটি টাকা পেয়েছে বাংলাদেশ। আরও ২০০ কোটি ডলার বা ১৭ হাজার কোটি টাকা পাবে বলে সরকার আশা করছে।

বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) তাদের দেওয়া অর্থ ব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারের স্বচ্ছতা বা জবাবদিহির প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা আনুষ্ঠানিকভাবে সদস্যদেশগুলোকে বলে দিয়েছেন, ‘যত পারেন খরচ করবেন, কিন্তু খরচের রসিদটি রাখবেন।’

এমনিতেই দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে করোনার এই সময়ে স্বাস্থ্য খাতের করুণ বা কুৎসিত চেহারাটি প্রকাশ পেয়ে গেছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অভিনব সব দুর্নীতি। করোনাকালে দুর্নীতি প্রতিরোধে আগাম সতর্ক ব্যবস্থা হিসেবে বাংলাদেশ যা করেছে, তা হচ্ছে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ। কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি ছাড়া প্রতিরোধে কার্যকর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল না। ঘটনা ঘটার পর ব্যবস্থা নেওয়াটাই এখন পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা, সুশাসনের সংকট, সংস্কার না করা—সবকিছুরই ফলাফল হচ্ছে কোভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণের ব্যর্থতা।

সামনের দিনগুলোতে আরও অনেক অর্থ খরচ হবে। অনেক অর্থ আসবে বাংলাদেশে। ফলে দুর্নীতিরও নতুন নতুন সুযোগ ঘটবে। কোন পথে তা সামাল দেওয়া হবে, সেটাই হবে পর্যবেক্ষণের বিষয়।