সাহেদের বিরুদ্ধে ২ দিনে ১০ কোটি টাকা বাগানোর অভিযোগ

সাহেদ করিম
সাহেদ করিম

মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমের বিরুদ্ধে দুই দিনে কমপক্ষে ১০ কোটি টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নেওয়ার খবর এসেছে র‌্যাবের হটলাইন নম্বরে। কিন্তু সাহেদ ঠিক কী পরিমাণ সম্পদের মালিক হয়েছেন, গতকাল রোববার পর্যন্ত সে তথ্য পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

তদন্তকারীদের ধারণা, সাহেদ বিদেশে টাকা পাচার করেছেন। এর মধ্যে যুক্তরাজ্য থেকে ই-মেইলে টাকা পাচারের তথ্য পাঠিয়েছে একটি প্রতিষ্ঠান। যুক্তরাষ্ট্রে সাহেদ টাকা পাঠিয়েছেন এমন খবরও পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

যুক্তরাজ্যের ট্রান্স গ্লোবালনেক্সাস থেকে এ মেহতা নামের এক ব্যক্তি সাহেদের বিরুদ্ধে টাকা পাচারের অভিযোগ করেছেন। এই প্রতিষ্ঠান এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পণ্য আনা-নেওয়া ও খালাসের কাজ করে থাকে। র‌্যাব ও পুলিশ টাকা পাচারের তথ্য যাচাই করে দেখবে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ বলেন, গতকাল দুপুর পর্যন্ত র‌্যাবের কাছে ফোন এসেছে ১২০টি, ই-মেইলে অভিযোগ এসেছে ২০টি। সব অভিযোগই প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, পাওনা টাকা পরিশোধ না করা প্রসঙ্গে। বেশ কিছু ই-মেইল এসেছে বিদেশ থেকে। আরও দু-তিন দিন ‘সেবা সংযোগটি’ চালু রাখবে র‌্যাব।

সাহেদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত ফৌজদারি অপরাধের কোনো অভিযোগ পায়নি র‌্যাব। যদিও একটি টর্চার সেলের সন্ধান র‌্যাব পেয়েছিল। রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানের পর উত্তরা পশ্চিম থানায় যে ১৭ জনকে আসামি করে র‌্যাব মামলা করেছে, সেখানে সাহেদের কয়েকজন সহযোগীর নাম আছে। তাঁরা ওই টর্চার সেলে লোকজনকে ডেকে এনে মারধর করতেন বলে অভিযোগ আছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) রিমান্ডে থাকা সাহেদ করিমকে নিয়ে শনিবার রাতে অভিযান চালায়। এ অভিযানে সাহেদের ব্যবহৃত একটি নম্বরবিহীন গাড়ি পাওয়া যায়। এর আগে র‌্যাবের অভিযানেও সাহেদের একটি নম্বরপ্লেটহীন গাড়ি পাওয়া গেছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, প্রভাবশালী মন্ত্রী, সাংসদ, রাজনৈতিক নেতা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজন ও সাংবাদিকদের সঙ্গে ভালো যোগাযোগ ছিল সাহেদের। সেই যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন।

মামলা না নেওয়ার অভিযোগ পুলিশের বিরুদ্ধে

লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সরকারি চাকরি দেওয়া, বদলির তদবির করে টাকা আদায়, পাথর, বালু, রড, সিমেন্ট, বিটুমিন সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ না করা, ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না করা, ভ্যানের ভুয়া লাইসেন্স দিয়ে টাকা আদায়ের মতো অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। বেতন না পাওয়ার অভিযোগ করে প্রতিকার চেয়েছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। রোগীদের অভিযোগ হাসপাতালে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের। অভিযোগকারীদের অনেকেই প্রবাসী।

অভিযোগ এসেছে ঢাকার মিরপুর, উত্তরা, পূর্বাচল, গাবতলী, খিলগাঁও, কলাবাগান, খিলক্ষেত, শাহজাহানপুর, বনানী ডিওএইচএস, সুনামগঞ্জের ছাতক, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া, লক্ষ্মীপুর, ফরিদপুর, ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, বগুড়া থেকে। সৌদি আরব, ইতালি ও যুক্তরাজ্য থেকেও অভিযোগ জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা। তাঁদের অনেকেই বলেছেন, বিদেশে পাঠানোর নাম করে সাহেদ তাঁদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছিলেন। বিদেশে পাঠাতে পারেননি, টাকাও ফেরত দেননি। গতকাল পর্যন্ত সর্বোচ্চ ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা থেকে সর্বনিম্ন ৪৫ হাজার টাকা পর্যন্ত জালিয়াতির অভিযোগ পেয়েছে র‌্যাব।

ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ ফিরিয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ করেন। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তপন কুমার সাহা অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। জানা গেছে, সাহেদ গ্রেপ্তার হওয়ার পর ওসি ভুক্তভোগীদের খবর দিয়ে ডেকে আনছেন মামলা করার জন্য।

ছাতকের এখলাস খান ভুক্তভোগীদের একজন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাহেদ করিমের কাছে তাঁর পাওনা ১ কোটি ৪৯ লাখ টাকা এবং রিজেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদ পারভেজের কাছে তাঁর পাওনা ৪০ লাখ টাকা। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি সাহেদকে তিনি বালু ও দুই জাহাজ পাথর দেন। মাল সরবরাহের পর সাহেদ তাঁকে ৩০ লাখ টাকার একটা চেক দেন। এখলাসের একটা খননযন্ত্র প্রয়োজন ছিল, যার দাম ৯৪ লাখ টাকা। সাহেদ বলেন, তাঁর প্রতিষ্ঠান এই খননযন্ত্র এনে দেবে, ২০-২৫ দিন সময় লাগবে। এখলাস ওই সময় চেকটি নিয়ে চলে যান। কিন্তু ব্যাংকেও ৩০ লাখ টাকা না থাকায় চেকটি প্রত্যাখ্যাত হয়। এরপর থেকে তিনি বারবার যোগাযোগ করেও সাহেদকে আর পাননি। পরে ঢাকায় রিজেন্টের প্রধান কার্যালয়ে গেলে সাহেদ করিম তাঁকে হত্যার হুমকি দেন। এক সহযোগী তাঁর মাথায় পিস্তল ঠেকান। ফিরে এসে তিনি উত্তরা পশ্চিম থানায় মামলা করতে গেলে পুলিশ মামলা নিতে অস্বীকৃতি জানায়। পুলিশ তাঁকে ছাতকে ফিরে গিয়ে মামলা করতে বলে। ছাতক থানা মামলা নেওয়ার নামে বারবার ঘোরাতে থাকে এখলাসকে। সাহেদ ধরা পড়ার পর উত্তরা পশ্চিম থানা তাঁকে ঢাকায় এসে মামলা করতে ফোন করে। আজ সোমবার তাঁর ঢাকায় আসার কথা।

পূর্বাচলে ওবায়দুল মজিদ নামের একজন বালু সরবরাহকারী সাহেদের কাছে ১২ লাখ টাকা পান। পূর্বাচল প্রকল্পের জন্য সাইট ইঞ্জিনিয়াররা প্রচুর বালু সংগ্রহ করছিলেন। সেই সুবাদে তিনিও বালু দেন। এরপর আর টাকা পাননি। এ নিয়ে উত্তরা পশ্চিম থানায় জিডি ও আইনি নোটিশ পাঠিয়েও কোনো সুরাহা হয়নি।

কিশোরগঞ্জে গাড়িচালক খসরুকে বিদেশে পাঠানোর নাম করে সাহেদ পাঁচ বছর আগে ১৫ লাখ টাকা নেন বলে জানান। খসরু প্রথম আলোকে বলেন, কুয়েতে পাঠানোর কথা বলে সাহেদ প্রথমে তাঁর থেকে ১০ লাখ টাকা নেন। পরে তাঁকে আর পাঠাতে পারেননি। এরপর বলেন, কুয়েত শ্রমিক নেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। তিনি খসরুকে দক্ষিণ কোরিয়ায় পাঠাবেন। সে জন্য তিনি আরও ৫ লাখ টাকা দাবি করেন। খসরু ধারকর্জ করে আবার টাকা দেন। শেষ পর্যন্ত বিদেশে যাওয়া হয়নি। টাকা ফেরত চাইতে রিজেন্টের কার্যালয়ে গেলে মারধর করে ফিরিয়ে দেওয়া হয়।

বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের ছেলে আবদুল্লাহ বলেন, তিনি ছাত্র পড়িয়ে নিজের খরচ চালান। এ বছরের মার্চে এক ব্যক্তি চাকরির প্রতিশ্রুতি দিয়ে তাঁকে সাহেদের কাছে নিয়ে যান। ফেসবুকে সাহেদের আইডি দেখে তিনি তাঁকে প্রভাবশালী বলেই মনে করেছিলেন। তা ছাড়া সাহেদের বাড়িও তাঁদের এলাকায়। সাহেদ তাঁকে প্রাথমিকভাবে ৫০ হাজার টাকা রেখে যেতে বলেন। চাকরির সন্ধান পেলে ফোন করবেন বলে জানান। সেই ফোন আর আসেনি।