স্বাস্থ্যে অনিয়মের দায় নিচ্ছে না কেউ

করোনা মহামারির মধ্যে দেশের স্বাস্থ্য খাতে নানা অনিয়ম ও বিশৃঙ্খলায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কারা জড়িত, তা চিহ্নিত করা হচ্ছে না, বরং একে অপরকে দোষারোপ করে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর দায় এড়ানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

জেকেজি হেলথ কেয়ার ও রিজেন্ট হাসপাতাল কেলেঙ্কারির রেশ কাটতে না কাটতেই গতকাল রোববার রাজধানীর গুলশানে বেসরকারি সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অভিযান চালায় র‌্যাব। হাসপাতালটি অনুমতি ছাড়াই করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করছিল বলে র‌্যাব জানিয়েছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, সাহাবউদ্দিন মেডিকেলের করোনা পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি ছিল না। অথচ অধিদপ্তর থেকে সরেজমিন পরিদর্শন না করেই তাদের নমুনা পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। পরে সেই অনুমোদন বাতিল করে অধিদপ্তর।

পরীক্ষার প্রস্তুতির আগেই অনুমোদন

শুধু সাহাবউদ্দিন মেডিকেল নয়, আরও চারটি বেসরকারি পরীক্ষাকেন্দ্রের প্রস্তুতির আগেই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর নমুনা পরীক্ষার অনুমোদন দিয়েছিল। অভিযোগ রয়েছে, অধিদপ্তর সরেজমিন পরিদর্শন না করেই এসব কেন্দ্রের অনুমতি দিয়েছে। অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১২ জুলাই এক দিনে পাঁচ প্রতিষ্ঠানের করোনাভাইরাস পরীক্ষার অনুমোদন স্থগিত করায়। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো কেয়ার মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্টেমজ হেলথ কেয়ার, থাইরোকেয়ার ডায়াগনস্টিক এবং চট্টগ্রামের এপিক হেলথ কেয়ার।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক নাসিমা সুলতানা ওই পাঁচ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া চিঠিতে বলেন, ওই হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারকে কোভিড-১৯ আরটিপিসিআর ল্যাবরেটরি পরীক্ষার অনুমোদন দেওয়া হলেও তারা কাজ শুরু করতে ব্যর্থ হয়েছে। সে জন্য কোভিড-১৯ আরটিপিসিআর পরীক্ষার অনুমোদন স্থগিত করা হয়েছে।

গতকাল অভিযানে থাকা র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম জানান, করোনা পরীক্ষার অনুমতি স্থগিত করা হলেও সাহাবউদ্দিন মেডিকেল কলেজ বেআইনিভাবে করোনাভাইরাসের অ্যান্টিবডি পরীক্ষা করছিল। হাসপাতালটি বাইরে থেকে নমুনা পরীক্ষা করিয়ে প্রতিবেদন দিচ্ছিল। বাইরে থেকে নমুনা পরীক্ষা করে এনে ফলাফল দেওয়া বেআইনি।

করোনা পরীক্ষায় এমন জালিয়াতি ও অনিয়মের কারণে ২৩ জুলাই থেকে বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে বিদেশগামী যাত্রীদের জন্য কোভিড–১৯ পরীক্ষার সনদ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাংলাদেশ বিমানের ওয়েবসাইটে ১৬টি প্রতিষ্ঠানের নাম উল্লেখ করে বলা হয়েছে, এসব কেন্দ্রে কোভিড–১৯ পরীক্ষা করাতে হবে। এই ১৬ কেন্দ্রের মধ্যে কোনো বেসরকারি হাসপাতাল বা পরীক্ষাকেন্দ্র নেই।

বর্তমানে দেশের ৮০টি ল্যাবে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করা হচ্ছে। এর মধ্যে ৩৫টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক প্রতিষ্ঠানের মান বা তাদের সক্ষমতার বিষয়টি অধিদপ্তর সরেজমিন পরিদর্শন করে যাচাই–বাছাই করেনি। অধিদপ্তর নিজেদের দায়িত্ব পালন না করাতেই জেকেজি ও রিজেন্ট হাসপাতাল প্রতারণা করার সুযোগ পেয়েছে।

জনস্বাস্থ্যবিদ ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক অধ্যাপক বে-নজির আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য খাতে অব্যবস্থাপনা দীর্ঘদিনের। করোনার সময়ে সেটি বেশি করে ধরা পড়ছে। সাধারণ মানুষকে ভুগতে হচ্ছে। মাঝেমধ্যে হাসপাতাল ও ক্লিনিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের ফলে কিছুদিন আলোচনা হয়, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। স্বাস্থ্য খাতকে জনবান্ধব করতে হলে জাতীয়ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

দায় নিচ্ছে না কেউ

বাংলাদেশ থেকে যাওয়া বেশ কয়েকজন যাত্রীর করোনা ধরা পড়ার পর ঢাকা থেকে জাপান, কোরিয়া ও ইতালির ফ্লাইট বন্ধ হয়। বিদেশে যাওয়ার পর বিমানবন্দরেই প্রবাসী বাংলাদেশিদের শরীরে করোনা শনাক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন দেশের গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এতে বাংলাদেশের করোনা পরীক্ষার মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে গত ১৩ এপ্রিল থেকে জেকেজি হেলথ কেয়ার বুথের মাধ্যমে করোনা শনাক্তের নমুনা সংগ্রহ শুরু করে। কিন্তু জেকেজির বিরুদ্ধে বাসা থেকে টাকার বিনিময়ে নমুনা সংগ্রহ এবং পরীক্ষা ছাড়াই নমুনার ফল দেওয়ার অভিযোগ ওঠে।

তেজগাঁও থানার পুলিশ গত ২৩ জুন জেকেজির সিইও আরিফুল হক চৌধুরীসহ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে। ১২ জুলাই গ্রেপ্তার করা হয় জেকেজির চেয়ারম্যান সাবরিনা চৌধুরীকে। জিজ্ঞাসাবাদে সাবরিনা ও আরিফ দুজনই জানিয়েছেন, তাঁদের কাজ পেতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দুজন পরিচালক এবং স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুজন অতিরিক্ত সচিবের সহায়তা পেয়েছেন।

করোনা চিকিৎসার জন্য সরকার নির্ধারিত রিজেন্ট হাসপাতালে ৬ জুলাই অভিযান চালিয়ে সেটি সিলগালা করে দেয় র‌্যাব। চুক্তি ভঙ্গ করে করোনা রোগীদের কাছ থেকে বিল আদায়, ভুয়া প্রতিবেদন তৈরিসহ নানা অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ ওরফে সাহেদ করিমকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

স্বাস্থ্য খাতে অনিয়মের ঘটনায় এখনো স্বাস্থ্য বিভাগের কারও বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান গতকাল রাতে মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়মের সঙ্গে কোনো কর্মকর্তা জড়িত থাকলে অবশ্যই তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইতিমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বেশ কয়েকটি অনিয়মের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে কাজ শুরু করেছে।

অনিয়মের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করতে তদন্ত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও হেলথ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুমের সহকারী পরিচালক আয়শা আক্তার। গতকাল প্রথম আলোকে তিনি বলেন, কেউ দোষী হলে তাঁদের অবশ্যই বিচারের আওতায় আনা হবে।

দুদকের অনুসন্ধান দল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে

গতকাল বেলা দুইটার দিকে দুদকের চার সদস্যের একটি অনুসন্ধানকারী দল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে যায়। তাঁরা প্রায় এক ঘণ্টা স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের দপ্তরে ছিলেন। সেখান থেকে বেরিয়ে অনুসন্ধান দলের প্রধান আবু বকর সাংবাদিকদের বলেন, তাঁরা রিজেন্ট হাসপাতাল-সংশ্লিষ্ট কিছু নথিপত্রের খোঁজে অধিদপ্তরে গিয়েছিলেন।

দুদকের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে করোনার নমুনা পরীক্ষায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করা চুক্তির নথিপত্রে যাঁদের স্বাক্ষর ও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে দুদকের অনুসন্ধান দল। তবে তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি।

রিজেন্ট হাসপাতালের কেলেঙ্কারির তদন্তে গঠিত দুর্নীতি দমন কমিশনের অনুসন্ধান দলের প্রধান আবু বকর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এখনো কাউকে জিজ্ঞাসাবাদ করার সিদ্ধান্ত নিইনি। নথিপত্র পর্যালোচনা করব, দেখব কার কী সম্পৃক্ততা আছে, কে সাক্ষী হবে, কে আসামি হবে। এরপর কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’

তিন কর্মকর্তাকে দুদকের জিজ্ঞাসাবাদ

নিম্নমানের মাস্ক, পিপিইসহ স্বাস্থ্য সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের (সিএমএসডি) তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে দুদক। গতকাল রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে তলব করে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়।

দুদক জানিয়েছে, যাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাঁরা হলেন কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের সাবেক সহকারী পরিচালক (মজুত ও বিতরণ) ডা. মো. শাহজাহান। বর্তমানে তিনি সিএমএসডির সহকারী পরিচালকের (প্রশাসন) দায়িত্বে আছেন। এ ছাড়া কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের সাবেক ডেস্ক অফিসার (অতিরিক্ত দায়িত্ব–স্টোর) ডা. সাব্বির আহম্মেদ ও কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের স্টোর অফিসার কবির আহম্মেদ।

কোভিড-১৯–এর চিকিৎসায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে নিম্নমানের মাস্ক, পিপিই ও অন্যান্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম ক্রয়সহ বিভিন্ন হাসপাতালে সরবরাহের নামে অন্যদের যোগসাজশে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎপূর্বক অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক অনুসন্ধান চালাচ্ছে। দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে অনুসন্ধানকারী দল তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। আজ সোমবার আরও তিন কর্মকর্তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে বলে জানিয়েছে দুদক।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য নজরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তর একে অপরকে দোষারোপ করার মূল কারণ দুর্নীতি। কে মিথ্যা বলছে, কে সত্য, তা নির্ণয় করা কঠিন। তবে দুই পক্ষেরই দোষ রয়েছে। স্বাস্থ্য খাতের প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতিপরায়ণ লোকদের চিহ্নিত করে সরিয়ে দিতে হবে। দুর্নীতি থাকলে খাতটিকে জনবান্ধব করা সম্ভব হবে না।