সন্তানকে নিয়ে মাচায় উঠেও রক্ষা নেই

গ্রামে অবসরে গল্পের জন্য বাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গায় বাঁশের মাচা থাকে। বন্যায় রোজিনা আক্তার তাঁর দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে সেই মাচায় ঠাঁই নেন। মাচার চারপাশে টিন, বাঁশ, প্লাস্টিক দিয়ে ঝুপড়ি বানান। কিন্তু সেখানেও এখন পানি ছুঁই ছুঁই করছে। ছবি: সত্যজিৎ ঘোষ
গ্রামে অবসরে গল্পের জন্য বাড়ির পাশে ফাঁকা জায়গায় বাঁশের মাচা থাকে। বন্যায় রোজিনা আক্তার তাঁর দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে সেই মাচায় ঠাঁই নেন। মাচার চারপাশে টিন, বাঁশ, প্লাস্টিক দিয়ে ঝুপড়ি বানান। কিন্তু সেখানেও এখন পানি ছুঁই ছুঁই করছে। ছবি: সত্যজিৎ ঘোষ

শরীয়তপুরের নড়িয়ার পশ্চিম চাকধ গ্রামের বাসিন্দা রোজিনা আক্তার। গত বৃহস্পতিবার তাঁর কোলজুড়ে আসে ফুটফুটে সন্তান। তখন তাঁর বাড়ির উঠানে ছিল বন্যার পানি। দুই দিনেই সেই পানিতে ডুবেছে বসতঘর ও রান্নাঘর। বাধ্য হয়ে নবজাতক ও আরেক সন্তানকে নিয়ে বসতঘর ছেড়ে গ্রামের ফাঁকা জায়গায় থাকা বাঁশের মাচায় ঠাঁই নেন তিনি। কিন্তু সেখানেও এখন পানি ছুঁই ছুঁই করছে।

রোজিনা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘বন্যার মধ্যে খুব অসহায় অবস্থায় পড়ে গেলাম। স্বামী বিল্লাল হোসেন রিকশা চালিয়ে সংসারের খরচ জোগান দেন। এলাকায় পানি উঠে সড়ক তলিয়ে গেছে, রিকশা চলছে না। আয়ও বন্ধ। এক প্যাকেট শুকনা খাবার পেয়েছিলাম। এরপর কী হবে, আল্লাহই জানেন।’

ওই গ্রামের পাঁচটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে সড়কের পাশে অটোরিকশা গ্যারেজে। তাদেরই একজন রেহানা খাতুন। আজ দুপুরে ওই গ্যারেজে পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে রান্না করছিলেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাশের গ্রামের একটি স্কুলকে আশ্রয়কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু গবাদিপশু ও বাড়ির অন্যান্য জিনিস রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে পারছেন না। তাই বাধ্য হয়ে গ্যারেজে আশ্রয় নিয়েছেন। এই মুহূর্তে বেশি সমস্যা হচ্ছে খাওয়ার পানি, রান্নার জ্বালানি ও গবাদিপশুর খাদ্যসংকটে।

আজ মঙ্গলবার পদ্মা নদীর পানি নড়িয়ার সুরেশ্বর পয়েন্টে বিপৎসীমার ৩৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এরই মধ্যে নদীর তীর উপচে জেলার নড়িয়ায় ১৫টি, জাজিরায় ১২, শরীয়তপুর সদরে ১০ ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নে ৩০০টি গ্রাম এখন প্লাবিত। এতে অন্তত ৭০ হাজার পরিবার পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।

পাশের গ্রামে আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও গবাদিপশু ও বাড়ির অন্যান্য জিনিস রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি অনেকেই। তেমনই একজন রেহেনা বেগম। তাই আশ্রয় নিয়েছেন পাশের অটোরিকশা গ্যারেজে। সেখানেই সারছেন রান্নার কাজ। ছবি: প্রথম আলো
পাশের গ্রামে আশ্রয়কেন্দ্র থাকলেও গবাদিপশু ও বাড়ির অন্যান্য জিনিস রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি অনেকেই। তেমনই একজন রেহেনা বেগম। তাই আশ্রয় নিয়েছেন পাশের অটোরিকশা গ্যারেজে। সেখানেই সারছেন রান্নার কাজ। ছবি: প্রথম আলো

আজ জাজিরার নাওডোবা, পালেরচর, নড়িয়ার কেদারপুর, মুলফৎগঞ্জ, পশ্চিম চাকধ, রাজনগর, নশাসন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পানিবন্দী মানুষগুলোর অনেকের ঘরেই শুকনা খাবার নেই। কেউ কেউ উঁচু মাচা বা নৌকায় রান্না করছে। তবে গ্রামগুলোতে খাওয়ার পানি, রান্নার জ্বালানি ও গো-খাদ্যের সংকট তীব্র।

এদিকে গতকাল সোমবার রাতে ঢাকা-শরীয়তপুর সড়কের নড়িয়ার রাজনগর, জামতলা, মৃধাকান্দি, ডগ্রি এলাকায় পানি উঠেছে। সড়কে হাঁটুসমান পানি উঠে যাওয়ায় যানবাহন চলাচল ব্যাহত হচ্ছে। আজ দুপুরে ওই সড়ক পরিদর্শনে যান শরীয়তপুর–১ আসনের সাংসদ ইকবাল হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘জেলার এ গুরুত্বপূর্ণ সড়কটিতে যানবাহন চলাচল বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। আমরা বালুর বস্তা-ইটসহ নির্মাণসামগ্রী ফেলে সড়কটি সচল রাখার চেষ্টা করছি। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ দিয়েছেন একজন মানুষও যেন অর্ধাহারে-অনাহারে না থাকে। আমরা বন্যাকবলিত মানুষদের বাড়িতে খাদ্যসহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কাজ শুরু করেছি।’

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কাজী আবু তাহের প্রথম আলোকে বলেন, বন্যাকবলিত মানুষের জন্য ২৯৮টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করা হয়েছে। সেখানে তারা ঘরের জিনিসপত্র ও গবাদিপশু নিয়ে আশ্রয় নিতে পারবে। পানিবন্দী প্রতিটি পরিবারকে ১০ কেজি করে চাল দেওয়ার কার্যক্রম শুরু হয়েছে। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বরাদ্দকৃত ৪৭০ মেট্রিক টন চাল এরই মধ্যে বিভিন্ন ইউনিয়নে পৌঁছে গেছে।