ওয়াসায় এমডির শাসন, দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ

বর্ষা আসে বর্ষা যায়, দিন বদলায়, কাল বদলায়, বদলায় না শুধু ঢাকা ওয়াসার সেবা। শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকট আর বর্ষায় হাবুডুবু, নালা-খালে পয়োবর্জ্য। তারপরও সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকের (এমডি) আশা, ওয়াসা ঘুরে দাঁড়াবে। ১০ বছর পরও এই ঘুরে দাঁড়ানো শেষ হয়নি, শেষ হয়নি এই শীর্ষ কর্মকর্তার মেয়াদও।

টানা পাঁচবার নিয়োগ পাওয়া এই কর্মকর্তার নিজের নিয়োগ, তাঁর মাধ্যমে দেওয়া অন্যদের নিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রে আছে বিতর্ক। দুর্নীতির অভিযোগ গেছে দুদক পর্যন্ত। কিন্তু কোনো কিছুরই ফয়সালা হয় না। এমডির ভয়ে কর্মকর্তারা মুখ খোলেন না। জনসেবার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি এখন এমডি–শাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।

ঢাকা শহরে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনের উদ্দেশ্যে ১৯৬৩ সালে যাত্রা শুরু হয় ঢাকা ওয়াসার। সে সময়ের একটি অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলত সংস্থাটি। পরে ১৯৯৬ সালে ‘ওয়াসা অ্যাক্ট’ নামে নতুন আইন হয়। 

এই আইন অনুযায়ী সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হচ্ছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা এমডি। বোর্ড চেয়ারম্যান থাকলেও সভা ডাকা ছাড়া তাঁর একক কোনো ক্ষমতা নেই।

এমডির বিতর্কিত নিয়োগ

ঢাকা ওয়াসার আইন অনুযায়ী ওয়াসা বোর্ডের সুপারিশ বা প্রস্তাবের পর সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে এমডি নিয়োগ দেওয়া হয়। এই প্রক্রিয়াতেই ২০০৯ সালে ওয়াসার এমডি পদে আসীন হন প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। এ ক্ষেত্রে ওয়াসা বোর্ড নজিরবিহীন জালিয়াতি করেছে বলে অভিযোগ আছে। বিষয়টি জানতে পেরে ওয়াসা বোর্ডকে সতর্ক করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়।

>শীর্ষ কর্মকর্তার টানা পাঁচবার নিয়োগ পাওয়া নিয়ে প্রশ্ন
আইনের যথাযথ অনুসরণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি

প্রথমবারের নিয়োগসংক্রান্ত নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এমডি নিয়োগের জন্য ওয়াসা বোর্ড ২০০৯ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে অথবা সিনিয়র পর্যায়ে সাধারণ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ২০ বছরের আবশ্যিক অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। ওই সময় এই পদের জন্য তাকসিম এ খানের জমা দেওয়া জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে তাঁর কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময়ের ওয়াসা বোর্ড চেয়ারম্যানের সঙ্গে তাকসিমের সখ্য থাকায় মৌখিক পরীক্ষায় তাঁকে সর্বোচ্চ নম্বর দেওয়া হয়।

প্রথম দফার মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে ওয়াসা বোর্ডের ১৯৮তম সভায় তাকসিম এ খানের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু সে সময়ের স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম এক বছর মেয়াদ বাড়ান। এরপর ওয়াসা বোর্ডের আরেকটি সভায় সিদ্ধান্ত হয়, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী দেশে না ফেরা পর্যন্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত থাকবে। কিন্তু মন্ত্রী দেশে ফেরার আগেই এমডির মেয়াদ আরও দুই বছর বাড়ানো হয়। এর পরবর্তী ওয়াসার বোর্ড সভায় বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং নিয়োগটি বিধিসম্মত হয়নি বলে জানানো হয়। এ ঘটনায় বিব্রত বোধ করে বোর্ড।

চতুর্থ দফায় ওয়াসা বোর্ড আবারও তাকসিম এ খানের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ানোর প্রস্তাব মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। ওই সময়ের মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন এক বছর কেটে দিয়ে দুই বছরের প্রস্তাব প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠালে তা অনুমোদিত হয়। উল্টো ঘটনা ঘটে পঞ্চম দফায়। এবার (’১৭ সালের আগস্টে) তাকসিমের মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়ানোর জন্য ওয়াসা বোর্ডকেই নির্দেশ দেয় মন্ত্রণালয়। বোর্ড মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ মেনে প্রস্তাব পাঠায় এবং আবারও তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান তিনি।

তবে এ ধরনের নির্দেশনা পাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওই সময়ের বোর্ড চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, তাঁর বোর্ডের সুপারিশে এমডি নিয়োগ হয়নি। আগের বোর্ডের সুপারিশে সব হয়েছে।

এভাবে এমডির নিয়োগ নিয়ে গত সোমবার একটি বিবৃতি দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। বিবৃতিতে ঢাকা ওয়াসায় সুশাসন নিশ্চিত করতে শীর্ষ পদে নিয়োগে আইনের যথাযথ অনুসরণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে।

ঢাকা ওয়াসার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি সময় এমডি পদে থাকার ইতিহাস গড়া তাকসিম এ খানের কাছে টিআইবির এই বিবৃতির প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে প্রথম আলোকে তিনি একটি লিখিত বক্তব্য দেন। ইংরেজিতে লেখা এই বক্তব্যের মর্মার্থ হচ্ছে, সরকারের অনুমোদন (মন্ত্রণালয় বা সরকারপ্রধান) সাপেক্ষে ওয়াসা বোর্ড এমডি নিয়োগ দেয়। তাই এ ব্যাপারে তিনি কোনো মন্তব্য করতে চান না। তবে নথিপত্র (টিআইবির বিবৃতি) হাতে পেলে ওয়াসা বোর্ড বা ব্যবস্থাপনা পর্ষদ জবাব দিতে পারে।

এ সম্পর্কে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, বিধিসম্মতভাবে কাউকে পাঁচ দফা নয়, আরও বেশি নিয়োগ দিলেও টিআইবির আপত্তি নেই। কিন্তু তাকসিম এ খানের নিয়োগটি বিতর্কিত। প্রথমবার নিয়োগ দেওয়ার সময় বিজ্ঞপ্তিতে যে যোগ্যতা-দক্ষতা-অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছিল, তা তাকসিম খানের ছিল না। তাঁর পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিধি মানা হয়নি।

তাকসিম খানের পঞ্চম দফার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৪ অক্টোবর। এখন ষষ্ঠ দফায় নিয়োগের জন্য চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। ওয়াসার পরবর্তী বোর্ড সভায় এ ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে। বোর্ড চেয়ারম্যান এম এ রশিদ সরকার করোনায় আক্রান্ত হওয়ায় গত সপ্তাহের নির্ধারিত সভা হয়নি।

এমডির নিয়োগপ্রক্রিয়া অবশ্যই স্বচ্ছ হওয়া উচিত বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ওয়াসার আইনটিও এমন হওয়া উচিত, যাতে একজন দীর্ঘদিন একই পদে থাকতে না পারেন।

দুর্নীতির অভিযোগ

প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো, ঠিকাদার নিয়োগে সিন্ডিকেট, ঘুষ লেনদেন, পদ সৃষ্টি করে পছন্দের লোককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, অপছন্দের লোককে ওএসডি করাসহ বিস্তর অভিযোগ ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে। গত বছর ওয়াসার ১১টি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওয়াসার প্রকল্পগুলো নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না। নানা প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের নকশা ও বিবরণ অনুযায়ী কাজ করা হয় না। প্রকল্পে পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন কিছু শর্ত আরোপ করা হয়, যাতে নির্দিষ্টসংখ্যক ঠিকাদার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেন। এ ছাড়া ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পদ্ধতি ও রাজনৈতিক পরিচয় এবং কাজ পাওয়ার বিনিময়ে ঘুষ লেনদেন বর্তমানে একটি প্রচলিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুদকের প্রতিবেদন বলছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়।

দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তাকসিম খান মন্ত্রণালয়ে কথা বলার পরামর্শ দেন। নিয়োগ-পদোন্নতি নিয়ে জানতে চাইলে গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর কাছে কোনো অভিযোগ আসেনি। অভিযোগ না আসায় তিনি এ ব্যাপারে কথা বলবেন না।

এমডির নিয়োগ দেওয়া আরও দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে দুদকে গত বছর একটি অভিযোগ জমা পড়েছিল। দুদক অভিযোগ খতিয়ে দেখার দায়িত্ব দিয়েছিল স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে। মন্ত্রণালয় একটি কমিটিও করে। ওই কমিটির প্রধান ছিলেন অতিরিক্ত সচিব জহিরুল ইসলাম। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পাঁচ–ছয় মাস আগে তিনি তদন্ত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছেন। তদন্তে দুর্নীতির প্রমাণ পাওয়া গেছে কি না, জানতে চাইলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এদিকে ওয়াসার ওয়েবসাইটে দেওয়া জনবলকাঠামো অনুযায়ী সংস্থাটিতে পরিচালক নামে কোনো পদ নেই। কিন্তু ওয়াসার এমডি পছন্দের দুজন ব্যক্তিকে পরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়েছেন। এ ছাড়া জ্যেষ্ঠতার ক্রম ডিঙিয়ে একাধিক পদে পদোন্নতি দেওয়ার ঘটনাও আছে। অন্যদিকে গণমাধ্যমে কথা বলার অপরাধে একজন কর্মকর্তাকে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়েছে।

ওয়াসার কোনো কর্মকর্তা গণমাধ্যমে বক্তব্য দিতে চান না। কোনো এলাকায় একটি পানির পাইপ ফেটে গেলেও কেউ বক্তব্য দেন না। এমডির সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। 

কতটা ঘুরে দাঁড়াল ওয়াসা

ঢাকা ওয়াসার মূল দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা এবং জলাবদ্ধতা নিরসন করা। তাকসিম এ খান দায়িত্ব গ্রহণের পর সেবার মান বাড়াতে ২০১০ সালে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করা হয়। এখন ১০ বছর পর দেখা যাচ্ছে, সেবা প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি, গ্রাহক পর্যায়ে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে, জলাবদ্ধতা কমেনি, বরং বেড়েছে।

জানা গেছে, ঢাকা শহরে প্রথম পানি শোধনাগার হয়েছিল ১৮৭৪ সালে, ওয়াসা প্রতিষ্ঠারও বহু আগে। কিন্তু এখনো ঢাকার সব জায়গার মানুষ সমানভাবে পানি পায় না। শুষ্ক মৌসুমে বিভিন্ন এলাকায় পানির সংকট থাকে। এ ছাড়া পানির মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও গত ১২ বছরে অন্তত ১৩ বার পানির দাম বেড়েছে। ২০০৯ সালে যে পানির দাম ছিল পৌনে ৬ টাকা, এখন তা ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা।

ওয়াসার হিসাব বলছে, ঢাকার ৮০ শতাংশ এলাকায় এখনো পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকা ডুবে যাওয়া এখন দৃশ্যমান। ওয়াসা এমন ঘুরে দাঁড়িয়েছে যে খোদ সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ের সামনেই জলাবদ্ধতা হয়।

এ বিষয়ে আলী ইমাম মজুমদার বলেন, ঢাকা ওয়াসা জলাবদ্ধতা নিরসনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। সব জায়গায় এখনো পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করতে পারেনি সংস্থাটি।