ব্যাংক কর্মকর্তাও গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের ঘর পেলেন

ঝালকাঠির রাজাপুর চরপালট গুচ্ছগ্রাম আবাসন প্রকল্প এলাকায় নির্ধারিত উচ্চতায় মাটি ভরাট না করায় সৃষ্টি হয়েছে জলাদ্ধতা। ছবি: প্রথম আলো
ঝালকাঠির রাজাপুর চরপালট গুচ্ছগ্রাম আবাসন প্রকল্প এলাকায় নির্ধারিত উচ্চতায় মাটি ভরাট না করায় সৃষ্টি হয়েছে জলাদ্ধতা। ছবি: প্রথম আলো

ঝালকাঠির রাজাপুরে গুচ্ছগ্রাম-২–এর (সিভিআরপি) আওতায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘর নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। নির্মাণকাজ অসম্পন্ন রেখেই ঘরের চাবি সুবিধাভোগীদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। অনেকেই অসমাপ্ত ঘরে পুরোনো টিন-পলিথিনের বেড়া দিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন সেখানে। আবার প্রকল্প এলাকায় নির্ধারিত উচ্চতায় মাটি ভরাট না করায় বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে।

ঘর পাওয়া সুবিধাভোগীদের তালিকায়ও রয়েছে অনিয়ম। এ তালিকায় চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী ও সচ্ছল ব্যক্তিরা থাকায় প্রকৃত ভূমিহীন ব্যক্তিরা বঞ্চিত হয়েছেন। সচ্ছল ব্যক্তিদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে তাঁদের ঘর দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। প্রকল্পের বাসিন্দাদের অভিযোগ, মাটি ভরাট বাস্তবায়ন কমিটি ও স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি এ অনিয়মের সঙ্গে জড়িত।

উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার (পিআইও) কার্যালয় থেকে জানা গেছে, ভূমি মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উপজেলার বড়ইয়া ইউনিয়নের চরপালট গ্রামে চল্লিশকাহনিয়া মৌজার ২৪১১ নম্বর দাগে গুচ্ছগ্রাম-২–এর (সিভিআরপি) আওতায় আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাটি ভরাটের জন্য ২৬৫ দশমিক ২৯৯ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ দেওয়া হয়। মাটি ভরাটে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের নিয়ে পাঁচ সদস্যের একটি কমিটিকে দায়িত্ব দেয় উপজেলা প্রশাসন। ২০১৯ সালের শেষের দিকে মাটি ভরাট শেষে প্রকল্পের ৭০টি ঘরের জন্য ঘরপ্রতি দেড় লাখ টাকা করে ১ কোটি ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মৌখিকভাবে ঘর নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হয় ওই মাটি ভরাট কমিটিকে।

গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে পুনর্বাসনের জন্য ১৬২ পরিবার ঘরের জন্য আবেদন করে। তাদের মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই করে ৭০ জন উপকারভোগীকে নির্বাচন করা হয়। উপকারভোগী ৭০টি পরিবারের মধ্যে অনেক সচ্ছল পরিবারও রয়েছে। অর্থের বিনিময়ে মাটি ভরাট বাস্তবায়ন কমিটি ও স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি এসব সচ্ছল পরিবারের নাম তালিকাভুক্ত করে বলে অভিযোগ রয়েছে। এদের মধ্যে চাকরিজীবী, ব্যবসায়ী, অর্থসম্পদের মালিকেরাও রয়েছেন।

অপর দিকে ৭০টি উপকারভোগী পরিবারের তালিকায় নাম থাকলেও টাকা দিতে না পারায় তাঁদের নামে বরাদ্দ করা ঘর টাকার বিনিময়ে অন্য লোকদের দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন ওই গ্রামের লাকি বেগম, মনির হোসেন ও হেলাল হাওলাদার। তাঁদের অভিযোগ, যাঁরা ঘরের তালিকা থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে অনেক অসহায় পরিবার রয়েছে।

গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পের নির্মাণকাজ অসম্পন্ন রেখে ৭০টি পরিবারের মধ্যে অধিকাংশ ঘরের চাবি তড়িঘড়ি করে হস্তান্তর করা হয়েছে। অনেকেই বাধ্য হয়ে বেড়াবিহীন ঘরে পুরোনো টিন-পলিথিন দিয়ে ঠাঁই নিয়েছেন আশ্রয়কেন্দ্রে। অপরিকল্পিতভাবে মাটি ভরাটের কাজ করায় সামান্য বৃষ্টি ও জোয়ারের পানিতে তলিয়ে আবাসন প্রকল্প এলাকায় জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। প্রকল্পে ১০ ফুট উঁচু করে মাটি ভরাটের কথা থাকলেও করা হয়েছে ৭ ফুট। বিদ্যুৎ–সংযোগ প্রকল্পের ভেতরে ধরা থাকলেও সংযোগ দেওয়া হয়নি।

গত রোববার সকালে চরপালট গুচ্ছগ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, অনেক ঘরে বেড়া নেই। বাধ্য হয়ে ঘর নিজেরাই সংস্কার করছেন। নিরুপায় হয়ে অনেকেই পুরোনো টিন-পলিথিন দিয়ে কোনোরকম বসবাস করছেন। প্রতিটি ঘরের সামনে বৃষ্টির পানি জমে আছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সুবিধাভোগী জানান, স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহল ও মাটি ভরাট ব্যবস্থাপনা কমিটিকে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দিয়ে অনেক সচ্ছল ব্যক্তি ঘর পেয়েছেন। চরপালট গ্রামের প্রতিবন্ধী লাকি বেগমের (৩৮) মেয়ে নবম শ্রেণির ছাত্রী রেখা বলে, ‘আমার মা প্রতিবন্ধী। বাবা ছোটবেলায় আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। আমার নানি ভিক্ষা করে আমাদের খাওয়ায় এবং লেখাপড়া করায়। গুচ্ছগ্রামে ঘর পাওয়ার জন্য আমার মা আবেদন করেছিল। ইউএনও স্যার যাচাই-বাছাই করে আমার মায়ের নামে একটি ঘর বরাদ্দ দেন। কিন্তু কী কারণে আমার মায়ের নাম তালিকা থেকে বাদ পড়েছে, সে বিষয়ে আমরা কিছুই জানি না।’

একই গ্রামের হেলাল হাওলাদার বলেন, ‘তালিকায় আমার নাম থাকা সত্ত্বেও টাকা দিতে না পারায় আমার নাম বাদ পড়েছে।’

সচ্ছল ব্যক্তিদের একজন হলেন ব্যাংক এশিয়ার ভোলা শাখায় কর্মরত রাজাপুর চরপালট গ্রামের মো. আকবর হোসেন ওরফে রেজা। তাঁর স্ত্রী পারভিন বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী ব্যাংকে চাকরি করেন। আমাদের জমি অধিগ্রহণ করে গুচ্ছগ্রাম হয়েছে। তাই আমার স্বামীর নামে গুচ্ছগ্রামে একটি ঘর পেয়েছি। ভবিষ্যতে ঘরটি ভাড়া দেব। এ প্রকল্পে অনেকেই টাকা দিয়ে ঘর পেয়েছে।’

ঢাকায় পোশাক কারখানায় কর্মরত বড়ইয়া গ্রামের মো. মিরাজ হোসেনের বাবা সোবাহান বলেন, ‘আমার ছেলে ঢাকায় গার্মেন্টসে ভালো পদে চাকরি করে। সে গুচ্ছগ্রামে একখানা ঘর পাইছে।’

মাটি ভরাট বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি ও ইউপি সদস্য আহসান কবির দাবি করে বলেন, ‘ঘূর্ণিঝড় আম্পানের প্রভাবে ঘরগুলো নষ্ট হয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে দ্রুত উপকারভোগীদের বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। তাঁদের ঘরে রেখেই বাকি কাজগুলো চলমান। বিষখালী নদী দিয়ে বালু উত্তোলন করে গুচ্ছগ্রামের জায়গা ভরাট করা হয়েছে। আম্পানে অনেক বালুমাটি ধুয়ে গেছে। আমরা কোনো অনিয়ম করিনি। তবে কিছু সচ্ছল ব্যক্তি ঘর পেয়েছেন।’

পিআইও মো. আল মামুন-অর রশিদ জানান, তিনি অর্থ আদায় ও অনিয়মের বিষয়ে কিছুই জানেন না। প্রকল্প বাস্তবায়নের মূল দায়িত্বে রয়েছেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)। ইউএনও মো. সোহাগ হাওলাদার বলেন, ‘গুচ্ছগ্রাম প্রকল্পে আমরা বড়ইয়া ইউনিয়ন পরিষদে (ইউপি) প্রকাশ্যে বাছাইয়ের মাধ্যমে ৭০ জন উপকারভোগী নির্বাচন করেছি। এখন শুনছি, ঘর দেওয়ার কথা বলে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে একটি চক্র। এ জন্য সুনির্দিষ্ট অভিযোগ প্রয়োজন। তবে ঘরগুলো হস্তান্তর করা হলেও ভিটার মাটি ভরাট, চান্দিনার বেড়া নির্মাণ, বন্ধু চুলা লাগানোর কাজ করে দেওয়া হচ্ছে।’ তিনি জানান, নদীর তীরবর্তী হওয়ায় কিছু কাজ করার আগেই ঘরের চাবি হস্তান্তর করা হয়েছে।