পরীক্ষার প্রায় সব পড়া ভুলে গেছি

>করোনাভাইরাস পাল্টে দিয়েছে আমাদের জীবনের বাস্তবতা। দেশ–বিদেশের পাঠকেরা এখানে লিখছেন তাঁদের এ সময়ের আনন্দ–বেদনাভরা দিনযাপনের মানবিক কাহিনি। আপনিও লিখুন। পাঠকের আরও লেখা দেখুন প্রথম আলো অনলাইনে। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: [email protected]

আমার বিছানার কাছে কোনো টেবিল ক্যালেন্ডার নেই। থাকলে প্রতিটা দিন ঘুম থেকে উঠে লাল মার্কারে গত দিনের তারিখটি কেটে দিতাম। মনের ক্যালেন্ডারে প্রহর গুনে চলেছি। কেননা, আমার প্রতিটা দিন অপেক্ষা, অনিশ্চয়তা নিয়ে কাটছে।

লেখাটুকু পড়ে ভাববেন না আমি করোনা আক্রান্ত। তবে আশপাশে সংক্রমণ যে হারে ছড়িয়ে পড়ছে, তাতে কবে যে এই যুদ্ধংদেহী অণুজীবটির সঙ্গে আমার শরীরের অ্যান্টিবডিদের লড়তে হয়, সেই আশঙ্কাও মন থেকে সরাতে পারছি না।

আমি শিক্ষার্থী। আপাতত এইচএসসি পরীক্ষার্থী বলেই পরিচিত। কোনো দিন সপ্নেও ভাবিনি উহানে ভাইরাসের থাবায় পর্যুদস্ত যে শহরের চিত্রগুলো পত্রিকার পাতায় বা পর্দায় দেখতাম সেটি যে একদিন আমাদেরই চোখের সামনে ঘটতে দেখব, হয়তোবা আমাদেরও নিউজ বুলেটিন হয়ে উঠতে হবে।

এখন আমি বোন ফ্রাকচারড পেশেন্ট। বৃষ্টিদিনে পিছলা রাস্তায় সাইকেল চালাতে গিয়ে পড়ে গিয়ে আহত হই ২১ জুন সন্ধ্যা ছয়টায়। প্রাথমিকভাবে মচকে গেছে ধারণা করে সেমতো চিকিৎসা চলছিল। কিন্তু চলতে–ফিরতে বুঝতে পারলাম, সেরে উঠতে তো এত দিন লাগার কথা নয়।

১২ জুলাই এক্স–রে করাই। বলাই বাহুল্য, শুধু করোনার ভয়েই এত দিন হাসপাতালমুখী হইনি। যদি আগে হাসপাতালে এক্স–রে করাতাম, এত দিন এ হয়তো দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠতাম। এক্স–রে করে দেখা যায় ফিবুলা হাড়ে গ্রিনস্টিক ফ্রাকচারড। সেদিনই পায়ে প্লাস্টার করা হয়। খুব অসুস্থ হয়ে আমি এখন পর্যন্ত হাসপাতালেও ভর্তি হইনি কোনো দিন। ছোটখাটো কাটাছেঁড়া স্যাভলন আর ওয়ানটাইম ব্যান্ডেজ দিয়েই চলে যেত। সেই আমার জন্য এটা যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত। তবু মনকে সান্ত্বনা দিই, ‘আরও কত কষ্টে কত মানুষ দিনাতিপাত করছে, সেই তুলনায় আল্লাহ আমাকে অনেক অনেক ভালো রেখেছেন।’

তবে চোখ বন্ধ করে অন্ধের কষ্ট যেমন বোঝা যায় না, তেমনি বর্তমান অবস্থা আগে উপলব্ধি হয়নি। আগে ভাবতাম, ব্যান্ডেজ নিয়ে সারা দিন শুয়ে যারা থাকে, তাদের কতই না আরাম। কোনো কাজ নেই, মা–বাবার বকুনি নেই, খাবারটাও বিছানায় এনে দেয়। কিন্তু এখন রীতিমতো বিরক্ত। শুধু মনে হয়, বর্ষার এই মৌসুমে কবে আবার আমি বৃষ্টিতে ভিজতে পারব, পারব প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি করতে আবার।

শিক্ষার্থী হিসেবে নিজের জীবনের অনিশ্চয়তা আমাকে ঘিরে ধরেছে। প্রতিদিনের মতো চার মাস আগে এই সময়টাতে ভেবে চলেছিলাম আগত পরীক্ষায় কোন প্রশ্নের উত্তরটি কীভাবে লেখব কিংবা কতটুকু পড়াইবা আর বাকি আছে। একদিন হঠাৎ দুপুরের দিকে খবরে শুনি আমাদের পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। মাঝে তিন দফা লকডাউন বাড়ানোর ফলে বলতে গেলে এখন আশাহত হয়ে পড়েছি। কী পড়ব? কতটুকু কীভাবে পড়ব? অ্যাডমিশন নাকি পরীক্ষার জন্য? পরীক্ষার পড়া তো মনে হয় সব ভুলে গেছি।

নিজেকে কিন্তু হতাশ হতে দিচ্ছি না। আমার মনোবলের সামনে হতাশা কখনোই ডানা মেলতে পারবে না। আমরা কেউ হারতে শিখিনি, দমে যেতেও না। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে কী হবে, কালকের দিনটি কীভাবে যাবে, আমরা জানি না। আমরা জানি না মৃত্যু কখন আমাদের দরজায় এসে কড়া নাড়বে। তবু সুদিন সুসময়ের দিকে চেয়ে, মনকে শক্ত করে বর্তমান সময়কে পাড়ি দিয়ে যাই।

*লেখক: এইচএসসি পরীক্ষার্থী, কাদিরাবাদ ক্যান্টনমেন্ট স্যাপার কলেজ, নাটোর।