দুর্নীতির লাগাম ধরতে না পারলে সামনে বিপদ

প্রথম আলো ফাইল ছবি।
প্রথম আলো ফাইল ছবি।

দেশের প্রবৃদ্ধি আর উন্নয়নের আড়ালে থাকা বাস্তবতা সামনে নিয়ে এসেছে করোনা মহামারি। স্বাস্থ্যব্যবস্থার ভঙ্গুর দশা দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। বাড়তে শুরু করেছে দারিদ্র্য। বাড়ছে অনিশ্চয়তা। এমন চরম দুর্যোগেও রাষ্ট্রে গণমুখী নীতি দেখা যাচ্ছে না। এই গণবিমুখতা বড় বিপদ ডেকে আনতে পারে সামনে।

সরকারি দলের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক রাজনীতিবিদ, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ইতিহাসবিদের সঙ্গে কথা বলে এমনটা জানা গেছে। তাঁরা বলছেন, দুর্নীতি লাগামছাড়া হয়ে গেছে। সরকারের সদিচ্ছা ও ‘জিরো টলারেন্সে’র কথা শোনা গেলেও বড় শাস্তির তেমন দৃষ্টান্ত নেই। এখন দুর্যোগের মধ্যেও বড় বড় দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার ঘটনা সামনে আসছে। এতে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে।

জানা গেছে, ত্রাণ বিতরণে অনিয়ম ও দুর্নীতির দায়ে যে শতাধিক স্থানীয় জনপ্রতিনিধিকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তার মধ্যে অধিকাংশই সরকারি দলের। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগে একাধিক আমলা বদলি হয়েছেন। তবে দুর্নীতি রোধে কঠোর শাস্তি চান আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতারা। পিরোজপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ হালিম হাওলাদার প্রথম আলোকে বলেন, কিছু দুর্নীতিবাজ আছেন, যাঁরা ত্রাণ চুরিতেও দ্বিধা করেন না। তাঁদের যেন সরকার কিছুতেই ছাড় না দেয়।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেছেন, সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি দ্বিধা-দ্বন্দ্বও দেখা যায়। কোনো কাজে স্বচ্ছতা নেই, মহামারির সময় এটি আরও স্পষ্ট হলো। ব্যবসায়ীরা সংসদে ঢুকে ‘গণ’ বাদ দিয়ে নিজেদের স্বার্থে নীতি তৈরি করছেন। আর আমলারা দেশটিকে প্রশাসনিক রাষ্ট্রে পরিণত করেছেন।

তবে লেখক ও গবেষক মুনতাসীর মামুন প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা ধরা পড়েছেন, তাঁদের শুধু বরখাস্ত করা হয়েছে। ব্যবসায়ীদের দৃশ্যমান অপকর্ম মাফ হচ্ছে। আমলাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা হলো বদলি আর পদোন্নতি। এখানে লুটপাটের পুঁজিবাদ বিস্তৃত হয়েছে। এটা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, যেটা বঙ্গবন্ধু ভেবেছিলেন।

টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ। দলটির নেতারা বলছেন, ধাপে ধাপে আমলাদের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে সরকারের। রাজনীতিবিদেরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। করোনার সময় বিষয়টি সবার কাছে স্পষ্ট হয়েছে। করোনা মোকাবিলার নীতিনির্ধারণী কাজে দলীয় নেতাদের উপস্থিতি নেই। মন্ত্রীরাও অনেক কিছু জানেন না। শুরু থেকেই সব করছেন আমলারা। স্থানীয় পর্যায়ে গঠিত কমিটিতে সাংসদদের উপদেষ্টা করা হয়েছে। তবে প্রতি জেলার দায়িত্বে আছেন একজন করে সচিব। এসব নিয়ে দলীয় নেতার অনেকের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও মুখ খুলতে চান না কেউ।

মুনতাসীর মামুন বলেছেন, মাঠে দলের নেতারা আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু জেলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সচিবদের। সরকারে জনপ্রতিনিধিদের স্থান সীমিত হয়ে আসছে। দাপট বাড়ছে আমলাতন্ত্র আর ব্যবসায়ীদের।

স্থানীয় কয়েকজন নেতা জানান, জেলা প্রশাসক কখনো তাঁদের ডাকেন, আবার কখনো ডাকেন না। আর দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব ঢাকা থেকে তদারকি করছেন। এর বাইরে দল থেকে তাঁরা আলাদা করে ত্রাণ দিচ্ছেন। সমন্বয়ের অভাব আছে সবখানে। পঞ্চগড় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আনোয়ার সাদাত বলেন, করোনাকালে দল ঢাকা পড়ে গেছে, এটা তো অস্বীকারের সুযোগ নেই।

>

করোনা মোকাবিলার কাজে দলের উপস্থিতি নেই
মন্ত্রীরাও অনেক কিছু জানেন না
সব করছেন আমলারা

এ বিষয়ে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হারুন-অর-রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, কোনো দল যদি আমলাতন্ত্র বা প্রশাসনের ‍ওপর বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে দল দুর্বল হয়ে পড়ে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) বলছে, একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর সংসদে শপথ নেওয়া জনপ্রতিনিধিদের ৬১ শতাংশ ব্যবসায়ী। পঁচাত্তরের পর থেকেই রাজনীতিতে ব্যবসায়ীদের আধিক্য বাড়তে থাকে। আমলারাও সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নিতে থাকেন। এরপর দেশটি চলে গেছে ব্যবসায়ী ও আমলাদের হাতে। বিশ্লেষকেরা বলছেন, গণমুখী না হয়ে ধনিকদের কেন্দ্র করে রাষ্ট্রের নীতি তৈরি হয়েছে। তিন দশক ধরে দেশের মানুষকে মাশুল দিতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে মুনতাসীর মামুনের বক্তব্য, আমলা ও ব্যবসায়ীরা যে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারক হয়ে ওঠেন, সে দেশের ভরাডুরি হয়েছে। যত অভিযোগই থাকুক, জনপ্রতিনিধিদের ওপরই নির্ভর করেছেন বঙ্গবন্ধু, আমলাতন্ত্রের ওপর নয়।

তবে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বলছেন, করোনা বৈশ্বিক সমস্যা। এর স্থায়িত্বকাল কেউ জানে না। বিশ্ব ও আঞ্চলিক রাজনীতির বাঁক পরিবর্তন হতে পারে। সবদিকেই নজর রাখতে হবে। আপাতত সব মনোযোগ করোনায়। কিন্তু স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে মানুষের ক্ষোভ রয়েছে। বড় সংকট তৈরি হতে পারে অর্থনীতিতে। শ্লথ হতে পারে উন্নয়নকাজ। বাড়ছে অভাব ও দারিদ্র্য। তৈরি হতে পারে ক্ষোভ।

তবে এতে বড় সংকট দেখছেন না কেন্দ্রীয় নেতারা। তাঁরা বলছেন, দেশের রাজনীতিতে তেমন শক্ত প্রতিপক্ষ নেই। গত কয়েক বছরে কিছুই করতে পারেনি মূল প্রতিপক্ষ বিএনপি। তাই সামনে সরকারের নিয়ন্ত্রণ আরও বাড়বে।

আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মুহাম্মদ ফারুক খান প্রথম আলোকে বলেন, করোনা মোকাবিলায় যেকোনো দেশের চেয়ে বাংলাদেশ ভালো করেছে। তবে এটি দীর্ঘস্থায়ী হলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি নিতে হবে।

সরকারি দলের নেতারা বলছেন, করোনা পরিস্থিতি আরও কয়েক মাস চললে সমস্যা বাড়বে। বন্যায় আমনের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। উন্নয়নের গতি কমতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য খাতের ভঙ্গুর দশায় চলমান উন্নয়ন নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। এসব নিয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চেষ্টা হতে পারে। এর আগে কোটাবিরোধী আন্দোলন, নিরাপদ সড়কের আন্দোলনেও এমন দেখা গেছে। তবে কোনোভাবেই অস্থিরতা তৈরির সুযোগ দেওয়া হবে না। জীবন ও জীবিকার প্রশ্নে কোনো অনিশ্চয়তা সামনে আনতে চায় না সরকার। তাই সবদিকেই কড়া নজর রাখা হচ্ছে।

করোনা নিয়ে গুজব ও মিথ্যা তথ্য ছড়ানোর অভিযোগে ৮ মার্চ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত ৮৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ।

এ বিষয়ে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক প্রথম আলোকে বলেন, খাদ্যের অভাব হলে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। আপাতত দেশে খাদ্যের কোনো ঘাটতি নেই। করোনা পরিস্থিতি আরও কয়েক মাস অব্যাহত থাকলে হয়তো ভবিষ্যৎটা বোঝা যাবে।

তবে গোবিন্দ চক্রবর্তী বলছেন, জীবন টিকে থাকবে জীবিকায়। সরকার কিন্তু বড়দের নিয়েই ভাবছে। ভিআইপি তোষণ বাদ দিতে হবে। ক্ষমতার বিভিন্ন ‘পকেটে’ প্রাধান্য না দিয়ে গণনীতি প্রণয়ন করে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

সরকারি দলের নেতারা বলছেন, করোনা কিছুটা পিছিয়ে দিলেও ‘উন্নয়নের রাজনীতি’ থেকে সরছে না আওয়ামী লীগ। বড় প্রকল্পের কয়েকটি বন্ধ হলেও চলছে পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ। অনিশ্চয়তা আড়াল করে উন্নয়নের রাজনীতি সামনে রেখেই এগোতে চায় দলটি। বাজেটেও তার প্রতিফলন হয়েছে। এ ছাড়া শুরুতেই প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক সেলিম মাহমুদ বলেন, সংকট থেকেই নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে যায়।

তবে মুনতাসীর মামুন মনে করেন, নজরদারি না থাকলে প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতি চাঙা হবে না। আর স্বাস্থ্য খাত ভঙ্গুর থাকলে জিডিপিও বাড়বে না।

রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকেরা ধারণা করছেন, আপাতত রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ নেই সরকারের সামনে। তবে ক্ষমতার যে কাঠামো তৈরি হয়েছে, এটা থেকে বের হওয়া কঠিন। ক্ষমতা ব্যবহার করে টাকা আয় ও পাচার করছে একটি গোষ্ঠী। তারা জিম্মি করে ফেলেছে সরকারকে। আর বেসরকারি হাসপাতাল যা করেছে, তা সভ্য সমাজের বাইরে। এদের কঠোর বিচার হওয়া দরকার। এদিকে এক দশক ধরে ম্রিয়মাণ হয়ে আছে নাগরিক সমাজ। মতপ্রকাশে দীর্ঘদিন ধরে বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা বুমেরাং হতে পারে। সরকারে আছে বড় রকমের সমন্বয়ের ঘাটতি।

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ মনে করছেন, গুণগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে শক্তিশালী বিরোধী দল গড়ে না উঠলে সরকারের সামনে রাজনৈতিক কোনো ঝুঁকি নেই। তবে তিনি বলেন, করোনার মধ্যেও দুর্নীতির কথা শোনা যাচ্ছে, যা অনাকাঙ্ক্ষিত। এ ক্ষেত্রে সরকারের আরও কঠোর অবস্থান নিতে হবে।